আমেরিকানসহ বিশ্বের অনেক বিশ্লেষকের যুক্তি হলো, ওয়াশিংটনের পক্ষ থেকে বেইজিংয়ের উদ্বেগগুলো কতটা গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে, তার ওপর যুক্তরাষ্ট্র-চীন সম্পর্কের অগ্রগতির বিষয়টি নির্ভর করে। সম্পর্ক উন্নয়নে বেইজিংয়েরও যে সমান দায়িত্ব রয়েছে—এই ধরনের যুক্তি সেই ধারণা থেকে বেইজিংকে অব্যাহতি দিয়ে দেয়। এ ছাড়া গুরুত্বপূর্ণ আরেকটি বিষয় সামনে নিয়ে আসে। সেটা হলো, দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক মেরামতে চীনের তাদের নীতি বদলানোর দরকার নেই।
ফরেন অ্যাফেয়ার্স ম্যাগাজিনে সম্প্রতি প্রকাশিত কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জেসিকা চেন ওয়াইসের বহুল আলোচিত একটি নিবন্ধে চীনের কমিউনিস্ট পার্টির ‘আগ্রাসন’ ও ‘জবরদস্তি’র বিপদকে স্বীকার করে নেওয়া হয়েছে। সম্পর্ক মেরামতে যুক্তরাষ্ট্রের নীতি কী হওয়া উচিত, তা নিয়ে নিবন্ধিত সুনির্দিষ্ট সুপারিশ করা হয়েছে। সেগুলো হলো,
ক. ওয়াশিংটনের এমন সব কর্মকাণ্ড থেকে বিরত থাকতে হবে, যেগুলো তাইওয়ানের স্বাধীনতা উৎসাহিত হয়।
খ. চীনের আন্তর্জাতিক উদ্যোগগুলোর বিরোধিতা বন্ধ করতে হবে।
গ. চীনের প্রযুক্তি কোম্পানিগুলোকে লক্ষ্যবস্তু করা বন্ধ করতে হবে।
ঘ. চীনকে বাদ দিয়ে নয়, বরং চীনকে অন্তর্ভুক্ত করেই আন্তর্জাতিক জোট গঠন করতে হবে।
এরপরের বিপজ্জনক ইস্যু হচ্ছে দক্ষিণ চীন সাগর। এই সাগরকে চীন তাদের ভূখণ্ড বলে দাবি করে। আর যুক্তরাষ্ট্র দক্ষিণ চীন সাগরকে আন্তর্জাতিক জল ও আকাশসীমা বলে মনে করে। দক্ষিণ চীন সাগরে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার জন্য তিন দশক ধরে খুব আগ্রাসী অবস্থান বজায় রেখে চলেছে চীন সরকার। যুক্তরাষ্ট্রের নেতাদের কাছে এটা উদ্বেগের কারণ। উইঘুরদের ওপর চালানো দমনপীড়ন নিয়েও উদ্বিগ্ন তাঁরা।
২০২২ সালের ডিসেম্বর মাসে যুক্তরাষ্ট্রের থিঙ্কট্যাংক কিউইনসি ইনস্টিটিউট সুপারিশ করেছে, ওয়াশিংটনকে শেষ পর্যন্ত দক্ষিণ কোরিয়া থেকে সেনা প্রত্যাহার করে নিতে হবে। যুক্তরাষ্ট্র-দক্ষিণ কোরীয় জোট রদ করতে হবে। এইউকেইউএস প্রকল্প পরিত্যাগ করতে হবে। কোয়াডের কার্যক্রম বেসামরিক পর্যায়ে সীমিত রাখতে হবে। ভারতকে নিরাপত্তা অংশীদার করার ভাবনা থেকে বের হয়ে আসতে হবে। তাইওয়ান প্রণালি থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে সরে আসতে হবে। কেননা, সেখানে ‘যুক্তরাষ্ট্রের পরাজয়’ প্রায় নিশ্চিত হয়ে উঠতে পারে এবং তাইওয়ানকে রক্ষা করা যুক্তরাষ্ট্র ও জাপান কারও পক্ষেই গুরুত্বপূর্ণ কোনো স্বার্থ নয়।
নাথান জে রবিনসন ও নোয়াম চমস্কির মতো বিশ্লেষকেরা আমেরিকানদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, অভ্যন্তরীণ রাজনীতির উদ্দেশ্য সিদ্ধির কাজে চীনকে কাল্পনিক শত্রু বানানো ঠিক নয় এবং ‘আমাদের আধিপত্য চিরস্থায়ীভাবে ধরে রাখার আকাঙ্ক্ষাও ছাড়তে হবে’। ফরেন পলিসি ম্যাগাজিনের সাবেক সম্পাদক জনাথন টেপারম্যানের উপদেশ হলো, চীনের খারাপ ব্যবহারের বিরুদ্ধে পাল্টা ব্যবস্থা নিতে হবে যুক্তরাষ্ট্রকে। কিন্তু সেটা করার সর্বোত্তম পথ হচ্ছে, মতাদর্শিক বাখোয়াজি বন্ধ করা এবং একই সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের অর্থনীতিকে পৃথক করার প্রচেষ্টা বন্ধ করতে হবে।
কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জেফরি স্যাক্সের মন্তব্য হলো, ‘সি চিন পিং, তাইওয়ান ও হংকংকে চীনের সঙ্গে সম্পর্কের কেন্দ্র বানানো’ যুক্তরাষ্ট্র সরকারের জন্য উচিত হবে না। জলবায়ু পরিবর্তনের মতো বৈশ্বিক সমস্যাগুলো সমাধানে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে।
এই বিশ্লেষণগুলো কোনো না কোনোভাবে চীন সরকারের অবস্থানের প্রতিধ্বনি করে। দুর্বল দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের জন্য যুক্তরাষ্ট্রকে দোষারোপ করে সম্পর্ক উন্নয়নের দায়িত্বটা পুরোপুরি যুক্তরাষ্ট্রের ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে।
চীন-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক পুনর্জীবনের ক্ষেত্রে ওয়াশিংটনের একতরফা ছাড় দেওয়ার প্রস্তাবটি ভুল। ওয়াশিংটনের আইনসম্মতভাবে আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক স্বার্থ রয়েছে। এর কিছু চীনের অ্যাজেন্ডা ও আচরণের সঙ্গে না-ও মিলতে পারে। ওয়াশিটনের এই স্বার্থগুলোর মধ্যে রয়েছে তাদের বন্ধু ও মিত্রদেশগুলোকে রক্ষা করা। এ ছাড়া আন্তর্জাতকি আইনসংগত ও নৈতিক মূল্যবোধগুলোর পক্ষে দাঁড়ানো।
কোনো সরকার আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রত্যাশা করতে পারে, তাদের শতভাগ দাবি পূরণ করা হোক। কিন্তু নিশ্চিতভাবেই এই দাবি চীনের কমিউনিস্ট পার্টির সরকার করতে পারে না। বেইজিং ধারাবাহিকভাবে অস্বচ্ছ আচরণ করে আসছে। চীনের স্বার্থের প্রশ্ন যখন সামনে আসে, তখন তারা খোলাখুলিই আন্তর্জাতিক আইন ও চুক্তি লঙ্ঘন করে এবং অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে অন্য দেশের ওপর জবরদস্তি করে।
২০২০ সালে চীন সরকার অস্ট্রেলিয়ার কাছে তাদের অসন্তুষ্টি জানিয়ে ১৪ দফা অভিযোগ দিয়েছিল। এক বছর পর যুক্তরাষ্ট্রের উপপররাষ্ট্রমন্ত্রীকে চীনের বিরুদ্ধে ‘অন্যায় কাজ’ বন্ধ করার জন্য একটি তালিকা ধরিয়ে দিয়েছিল।
বাস্তব রাজনৈতিক প্রয়োজন থেকেই অনেক সময় দুর্বল কোনো দেশ তুলনামূলকভাবে শক্তিশালী দেশের অভিযোগ মানতে বাধ্য হয়। কিন্তু চীনের অভিযোগ যুক্তরাষ্ট্র মানতে বাধ্য নয়। অর্থনৈতিক, সামরিক ও কূটনৈতিক শক্তির দিক থেকে যুক্তরাষ্ট্র চীনের চেয়ে শ্রেয়। যুক্তরাষ্ট্রের হাতে চীনের তুলনায় উন্নত মানের সফট পাওয়ার রয়েছে। শক্তিশালী নিরাপত্তাসঙ্গীও রয়েছে ওয়াশিংটনের।
এসব সত্ত্বেও বেইজিং ও ওয়াশিংটনের মধ্যে বিরোধ কমিয়ে আনা উচিত, এ প্রত্যাশা যৌক্তিক। দুই পক্ষই যেন ছাড় দিয়ে শান্তি প্রতিষ্ঠা করে, সেটাও যৌক্তিক প্রত্যাশা। চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তারাও সম্পর্ক মেরামতের আকাঙ্ক্ষা ব্যক্ত করেছেন। কিন্তু দুই পক্ষ কিংবা এক পক্ষ যদি তাদের নীতিগুলো সমন্বয় না করে, তাহলে সেটা কথার কথা হিসেবেই থেকে যাবে। এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হলো, চীন-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কে সবচেয়ে বেশি উত্তেজনা সৃষ্টি হচ্ছে, এমন কোনো বিষয়ে সমঝোতা করতে বেইজিং কি আগ্রহী?
চীন-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বিপজ্জনক ও গুরুত্বপূর্ণ অগ্নিস্ফুলিঙ্গ হলো তাইওয়ান। চীন তাদের সামরিক বাহিনীকে এমনভাবে তৈরি করেছে, যেন প্রয়োজনে বলপ্রয়োগ করে হলেও তাইওয়ানকে বেইজিংয়ের শাসনের অধীন রাখা যায়।
বেইজিংয়ের এই নীতি যুক্তরাষ্ট্রের জন্য উদ্বেগের। চীনের কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্ব বিশ্বাস করে, সামরিক বাহিনীর হুমকি তুলে নেওয়া হলে তাইওয়ানের জনগণ আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীনতা ঘোষণা করে বসবে।
এরপরের বিপজ্জনক ইস্যু হচ্ছে দক্ষিণ চীন সাগর। এই সাগরকে চীন তাদের ভূখণ্ড বলে দাবি করে। আর যুক্তরাষ্ট্র দক্ষিণ চীন সাগরকে আন্তর্জাতিক জল ও আকাশসীমা বলে মনে করে। দক্ষিণ চীন সাগরে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার জন্য তিন দশক ধরে খুব আগ্রাসী অবস্থান বজায় রেখে চলেছে চীন সরকার। যুক্তরাষ্ট্রের নেতাদের কাছে এটা উদ্বেগের কারণ। উইঘুরদের ওপর চালানো দমনপীড়ন নিয়েও উদ্বিগ্ন তাঁরা।
এ ছাড়া বেইজিং তাদের শাসনব্যবস্থার কোনো মূলনীতি কি বদলাতে রাজি হবে? বেইজিং কি তাদের অগ্রসর প্রযুক্তির ক্ষেত্রে বিশ্বে নেতৃত্ব দেওয়ার আকাঙ্ক্ষা, নিজস্ব অর্থনৈতিক ব্যবস্থা এবং রাজনীতিতে কমিউনিস্ট পার্টির একচেটিয়াতন্ত্রের পথ থেকে বেরিয়ে আসতে পারবে?
চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের পারস্পরিক বৈরিতা বহুমুখী। কৌশলগত, অর্থনৈতিক ও মতাদর্শিক। নীতিগতভাবে দুই দেশের নেতারা সম্পর্ক মেরামতের আকাঙ্ক্ষা ব্যক্ত করলেও বাস্তবে সেটা অর্জনের সহজ কোনো রাস্তা নেই।
ডেনি রয় সিনিয়র ফেলো, ইস্ট-ওয়েস্ট সেন্টার, হুনুলুলু
এশিয়া টাইমস থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনুবাদ মনোজ দে