ফুলপরী কেন ছাত্রলীগের ডাকে সাড়া দেবে

ভুক্তভোগী শিক্ষার্থী ফুলপরী খাতুন
ছবি: প্রথম আলো

‘তদ’ মানে ‘তার’; ‘অন্ত’ মানে ‘শেষ’। সে হিসেবে ‘তদন্ত’ মানে ‘তার শেষ’। কার শেষ? অপরাধের অভিযোগ অনুসন্ধানের শেষ।

কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর আবাসিক হলে ছাত্রলীগের নেতাদের হাতে কেউ মারধর খেলে, এমনকি মারা গেলে ছাত্রলীগ সাধারণত ‘তদন্ত’ নামক যে বস্তুটি নিয়ে ঘোঁট পাকিয়ে থাকে তার আদি আছে, অন্ত নাই। অনন্তকালীন গুটি চালাচালিতে কী তদন্ত, কেন তদন্ত, কার বিরুদ্ধে তদন্ত—এসব অবজেকটিভ প্রশ্ন একসময় সাবজেক্টিভ ঘূর্ণিপাকে হারিয়ে যায়। সেই নজির আমরা ঢাবি, কুবি, চবি, রাবিতে বহু দেখেছি। ফুলপরী খাতুনকাণ্ডে এবার ইবিতেও যে তেমন হবে না, সেই ভরসা কই!

সবাই জানে, আবাসিক হলে আসা নতুন ছাত্রছাত্রীদের ‘সিট’ পেতে হলে ছাত্রনেতাদের নজরানা দিতে হয়। অত বড় একেকটা হল! সেগুলো দখল করা; এর মধ্যে কে খেল, কে না খেল; কার শোবার জায়গা দরকার, কাকে সারা রাত মেঝেতে বসিয়ে রাখা উচিত—এসব দেখেশুনে রাখা তো আর চাট্টিখানি কথা নয়। এতসব সামাল দেওয়ার পর নতুন আসা ছাত্র বা ছাত্রী যদি সালাম–কালাম না দেয়, যদি সামান্য ‘সার্ভিস চার্জ’টাও দিতে না চায়, তাহলে মাথা ঠিক থাকে? চর দখলের মতো করে এই হলটাও যে দখল করতে হয়, দখলে রাখতে হয়, সবকিছু ম্যানেজ করে রাখতে হয়, সেই জিনিসটা বুঝতে হবে না!

অতি আমোদের কথা, বেশির ভাগ ছেলেমেয়ে বুঝদার। হলে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে তারা ময়মুরব্বি চিনে ফেলে। তাদের সালাম–কালাম দেয়। কদমবুচি করে। নজরানা দেয়। কিন্তু সমস্যা বাধায় ফুলপরী খাতুনের মতো নাবুঝ বেবোধ ছেলেমেয়ে। তারা কাউকে কিছু না বলে হলটাকে নিজের মামাবাড়ি মনে করে ফট করে উঠে পড়ে। তখন তাদের পিটিয়ে–পাটিয়ে আদবকায়দা শেখানো ছাড়া ছাত্রলীগের আর তো কোনো উপায় থাকে না।

ফিন্যান্স বিভাগের প্রথম বর্ষের ছাত্রী ফুলপরী খাতুন কুষ্টিয়ার ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের দেশরত্ন শেখ হাসিনা হলের গণরুমে ১২ ফেব্রুয়ারি উঠেছিলেন। নানা পক্ষের কথা থেকে জানা যাচ্ছে, ওই রাতে সিনিয়রদের না জানিয়ে হলে ওঠায় সিনিয়ররা মন খারাপ করেছিলেন এবং বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সহসভাপতি সানজিদা চৌধুরীর নেতৃত্বে তাঁর অনুসারীরা ফুলপরীকে চার ঘণ্টা আটকে রেখে, তাঁকে বিবস্ত্র করে ও আরও নানাভাবে নির্যাতন করে তাঁকে হলজীবনের আদবকেতা শেখানোর চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু শাসনের পর তাঁরা সোহাগ করেন কি না, তা দেখার অপেক্ষা না করেই ফুলপরী বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাছে নালিশ–টালিশ করে যাচ্ছেতাই অবস্থা করে ফেলেছেন।

এ ঘটনায় হাইকোর্টকে পর্যন্ত তদন্তের নির্দেশ দিতে হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে তদন্ত চলছে। তদন্ত কমিটির লোকদের সওয়ালের জবাব দিতে ফুলপরীকে নিয়ে যেতে চার ঘণ্টা আসতে চার ঘণ্টার রাস্তা পাড়ি দিতে হচ্ছে তাঁর ভ্যানচালক বাবাকে। কিন্তু এর মধ্যে বরাবরের মতোই বিদ্যুৎগতির তৎপরতা দেখা যাচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের মধ্যে। তারা যথারীতি তদন্ত কমিটি করে ফেলেছে। সেই কমিটি ‘এবার আর কাউকে ছাড়ব না!’ টাইপের একটা ভাব নিয়ে তদন্ত চালাচ্ছে। আজ রোববার (২৬ ফেব্রুয়ারি) তদন্ত কমিটির ফাইনাল কথা জানানোর কথা। কিন্তু দুঃখজনকভাবে ফুলপরী ও তাঁর পরিবার এই তদন্তের ওপর বিশ্বাস রাখতে পারছে না। উল্টো তাদের ভয়, আবার যদি বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর ওপর হামলা হয়, তখন কী হবে। নিরাপত্তার অভাব বোধ করায় ক্যাম্পাসে যাচ্ছেন না তিনি।

কে হলে থাকতে পারবে, কে ক্যাম্পাসে অবস্থান করে শিক্ষাজীবন শেষ করতে পারবে, সেটা তাদের চাওয়ার ওপর নির্ভর করে। কেউ ত্যাড়ামি করলে তাঁকে শিবির বা ছাত্রদল ট্যাগ দিয়ে দিলে তাঁকে আর বাকি জীবন মাথা তুলে দাঁড়াতে হবে না। এই বিষয় সাধারণ শিক্ষার্থীরা যত তাড়াতাড়ি বুঝবে, ততই তাঁদের লাভ।

সমস্যা হলো, ছাত্রলীগের তদন্তের ওপর ফুলপরী যে ভরসা পাচ্ছে না, তার জন্য তাঁকে দোষ দেওয়া কঠিন হয়ে যাচ্ছে। কারণ, একই ধরনের নির্যাতন ও একই ধরনের তদন্তের কথা আমরা মাসে-চান্দে শুনে থাকি। এবং পরবর্তী মাসে-চান্দে তা ভুলে যাই।

এই ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় একসময় ছাত্রশিবিরের দখলে ছিল। ২০১৭ সালের ১৪ আগস্ট তাদের ভাগিয়ে দিয়ে ছাত্রলীগ দখল নেয়। এখন সেখানে ছাত্রলীগের একক দখলদারি আছে। শিক্ষার্থীরা বলছে, সবাই এখন কুমির তাড়ায়ে বাঘের কবলে পড়েছে।

এখানে প্রায় ১৮ হাজার শিক্ষার্থীর বিপরীতে আটটি আবাসিক হল (পাঁচটি ছাত্র ও তিনটি ছাত্রী) আছে। হলগুলোয় প্রায় পাঁচ হাজার শিক্ষার্থীর আবাসন ব্যবস্থা রয়েছে। এই পাঁচ হাজারের সবার পুরো বিশ্ববিদ্যালয়–জীবন ছাত্রলীগের মর্জির ওপরে নির্ভর করে থাকে। কে হলে থাকতে পারবে, কে ক্যাম্পাসে অবস্থান করে শিক্ষাজীবন শেষ করতে পারবে, সেটা তাদের চাওয়ার ওপর নির্ভর করে। কেউ ত্যাড়ামি করলে তাঁকে শিবির বা ছাত্রদল ট্যাগ দিয়ে দিলে তাঁকে আর বাকি জীবন মাথা তুলে দাঁড়াতে হবে না। এই বিষয় সাধারণ শিক্ষার্থীরা যত তাড়াতাড়ি বুঝবে, ততই তাঁদের লাভ।

  • সারফুদ্দিন আহমেদ প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক
    sarfuddin2003@gmail.com