ভয়কে জয় করতে সরকারকে যে তালা ভাঙতে হবে

একদল যোগ্য ও বুদ্ধিমান মানুষ একত্র হয়ে ঠিক করলেন, তাঁরা একটি আদর্শ নগর গড়ে তুলবেন। এই দলে নগরবিদ আছেন, স্থপতি, প্রকৌশলী, ঠিকাদার, বিনিয়োগকারী, ব্যাংকার, ল্যান্ডস্কেপার, পরিবেশবিদ সবাই আছেন। একটি আদর্শ নগর নির্মাণের জন্য যাঁদের দরকার, তাঁরা সবাই আছেন। তাঁরা বসেছেন একটি বড়সড় হলঘরে। ঘরের দরজাটি বাইরে থেকে তালা দেওয়া, তাঁরা চাইলেই এই ঘর থেকে বের হতে পারবেন না।

স্থপতি নগরের নকশা তৈরি করতে গিয়ে হতাশ হয়ে যান। কী হবে নকশা করে? আমরা তো এই ঘর থেকেই বেরোতে পারব না, কীভাবে নগর গড়ে তুলব? তবু মনের জোর ঠিক রেখে বিরতি দেওয়া কাজে আবার মনোযোগ দেন।

ল্যান্ডস্কেপার একটি প্রবহমান নদীর কথা ভাবেন, নদীটি নগরকে বৃত্তাকারে প্রদক্ষিণ করবে। নদীর দুই পাড় ধরে ছুটে যাবে নয়নাভিরাম রাস্তা। রাস্তার দুই পাশে থাকবে কৃষ্ণচূড়া গাছের সারি। গাছে এসে বসবে পাখি, গান করবে। নদীর ভেতরের দিকে, রাস্তার সমান্তরাল, ছুটে যাবে ততোধিক নয়নাভিরাম এলিভেটেড ওয়াকওয়ে, ঝিরিঝিরি হাওয়ায় নগরবাসী সেই সুসজ্জিত ভাসমান ওয়াকওয়ে ধরে সকাল-বিকেল হেঁটে বেড়াবে। হঠাৎ তাঁর মনে হয়, ধুর ছাই, কী হবে এত সুন্দর পরিকল্পনা করে, আমরা তো এই ঘর থেকেই বেরোতেই পারব না, কীভাবে নগর গড়ে তুলব?

বিনিয়োগকারী দারুণ এক প্রজেক্ট তৈরি করতে গিয়ে হতাশায় নিমজ্জিত হন, আমরা তো এখান থেকে বেরোতেই পারব না, কী করে নগর নির্মাণ করব?

একই প্রশ্ন প্রকৌশলীর, ব্যাংকারের, পরিবেশবিদের। তাঁরা একটু কাজ করেন, আবার থেমে যান, ক্ষণে ক্ষণেই মনে হয়, কী লাভ এত সব পরিকল্পনা করে, আমরা কী এখান থেকে কোনো দিন বের হতে পারব?

আমাদের অন্তর্বর্তী সরকারের অবস্থা এখন অনেকটা এ রকম। তারা অসাধারণ সব সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছে, কিন্তু ক্ষণে ক্ষণেই ভাবছে, এগুলো কী সংবিধানসম্মত হচ্ছে? প্রচলিত সংবিধান হচ্ছে বন্দী হলঘরের সেই বিশাল তালা। সরকারের এখন সবার আগে এই তালা ভাঙতে হবে, না হলে তারা কিছুই করতে পারবে না। তারা কিন্তু একটি বিশাল তালা ভেঙেই এই ঘরে ঢুকেছে। এরপরে কেউ একজন এসে বাইরে থেকে আবার একটি তালা লাগিয়ে দিয়ে গেছেন। এবার তারা তালাটি আবার ভেঙে বের হতে ভয় পাচ্ছে।

তাদের এখন ভয়কে জয় করে তালাটি ভেঙে ফেলতে হবে। কারণ, তারা বের হতে না পারলে জনমানুষের স্বপ্নের বাংলাদেশ নির্মিত হবে না। আগের চেয়ে তাদের এখন অনেক বেশি সাহসী হতে হবে, সব বাধাবিপত্তি উপেক্ষা করে ‘সংবিধান’ নামের তালাটি ভেঙে উন্মুক্ত প্রান্তরে বেরিয়ে আসতে হবে। তাদের বুঝতে হবে, দেশের প্রায় ১৮ কোটি মানুষ তাদের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে, তারা ব্যর্থ হলে এই জাতি আর স্বপ্নের বাংলাদেশ, বৈষম্যহীন বাংলাদেশ, ন্যায়বিচারের, ইনসাফের বাংলাদেশ গড়ে তোলার সুযোগ পাবে না।

গণমানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটে, এমন একটি সংবিধান রচনাই এই সরকারের প্রধান কাজ। সংস্কার একটি চলমান প্রক্রিয়া, এ কথা অনেকেই বলছেন। হ্যাঁ, এটা ঠিক, বাংলাদেশের বহু কিছু সংস্কার করতে হবে, যেমন আয়করব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাতে হবে, শিক্ষাব্যবস্থাকে সংস্কার করতে হবে, চিকিৎসাব্যবস্থায় ব্যাপক সংস্কার প্রয়োজন, এমনই অসংখ্য সেক্টরে সংস্কার লাগবে, সংস্কার হয়ে গেলে সেটিকেও আবার ভবিষ্যৎ সময়ের সঙ্গে, পরিবর্তিত পৃথিবীর সঙ্গে সংগতিপূর্ণ করার জন্য নতুন করে সংস্কার দরকার হবে। এই প্রক্রিয়া চলতেই থাকবে, এর কোনো শেষ নেই। কিন্তু এই সরকারকে ঠিক করতে হবে, তারা কতটুকু সংস্কার করে বিদায় নেবে।

শুরুতে ছয়টি সংস্কার কমিশন গঠন করে তারা মোটাদাগে তাদের সীমানা সঠিকভাবেই নির্ধারণ করে ফেলেছে। যদিও পরে আরও কয়েকটি সংস্কার কমিশন গঠন করা হয়েছে। সুতরাং জায়গাটি থেকে তারা যেন পিছপা না হয়। এসব খাতে সংস্কার ঠিকমতো করে দিয়ে যেতে পারলে, যে স্বপ্ন এ দেশের তরুণ ছাত্র-জনতা আমাদের দেখিয়েছেন, ফ্যাসিবাদমুক্ত বাংলাদেশ, বৈষম্যহীন বাংলাদেশ, আমরা অনেকটাই সেই জায়গায় পৌঁছে যাব।

এই কর্মযজ্ঞে পুরোপুরি আত্মনিয়োগের একটি বড় বাধা বাহাত্তরের সংবিধান। কিছু সংশোধনী বাতিল করেও একে বহাল রেখে আপনারা বেশি দূর এগোতে পারবেন না। কাজেই এই সংবিধান পুরোপুরি রহিত করে বিকল্প পথেই এগিয়ে যেতে হবে। যদি বর্তমান রাষ্ট্রপতিকে অব্যাহতি দিয়ে নতুন রাষ্ট্রপতি নিয়োগ দিতে হয়, দিন।

আপনাদের কাজ সহজ ও নিষ্কণ্টক করার জন্য যা যা করতে হয়, করুন। আমাদের সবাইকে মনে রাখতে হবে, সংবিধানের কারণে জাতির আকাঙ্ক্ষা আপস করা ন্যায়সংগত নয়; বরং জাতির আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে সংগতি রেখে সংবিধানকেই সমন্বয় করতে হবে। এটিই সঠিক রাস্তা।

  • কাজী জহিরুল ইসলাম কবি ও জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক কর্মকর্তা