‘প্ল্যানেট আর্থ’-খ্যাত স্যার ডেভিড অ্যাটনবরার ফলোয়ার হয়েছি। এ জন্যই হয়তো ফেসবুকে প্রাণিজগতের ওপর বিভিন্ন ক্লিপস আসে আমার কাছে। সেখানে প্রায়ই দেখি, একদল সিংহ কীভাবে ধাওয়া করে বিচ্ছিন্ন করে ফেলে কোনো বাফেলোকে। ধাওয়া খাওয়া বাফেলো তার বিশাল শিং দিয়ে আত্মরক্ষার চেষ্টা করে কিছুক্ষণ। এরপর গলা চেপে ধরে কামড়ে লুটিয়ে পড়ে।
বিস্ময়কর বিষয় হচ্ছে, এই হৃদয়বিদারক ঘটনা ঘটে বিপুলসংখ্যক বাফেলোর চোখের সামনে। আকৃতিতে সিংহের প্রায় দ্বিগুণ সাইজের একেকটা বাফেলো, কারও কারও মাথায় আছে বিশাল এক জোড়া চোখা শিং।
আমার প্রায়ই মনে হয়, যদি একবারমাত্র একসঙ্গে তারা তাড়া করত আক্রমণকারী সিংহকে, কখনোই মারা পড়ত না তাদের সঙ্গী। কিন্তু এরা বোকা চোখে নিথর হয়ে দাঁড়িয়ে এই হত্যাযজ্ঞ দেখে, এরপর নিজেই হয়তো কোনো এক দিন হয় সিংহের শিকার। হরিণের মতো ছোট প্রাণীর নীরব আত্মসমর্পণের তবু ব্যাখ্যা থাকতে পারে। কিন্তু কেন বাফেলো কখনো রুখে দাঁড়ায় না একসঙ্গে, ভেবে একটা সময় রাগ লাগত মনে।
এখন আর রাগ লাগে না তেমন। কারণ, মনে হয়, সবচেয়ে বুদ্ধিমান জীব হয়ে আমরা নিজেরাই তো ‘বাফেলো’ হয়ে যাই কখনো কখনো।
নিজেদের জ্ঞানবুদ্ধি নিয়ে আমাদের কারও কারও অহংকারের শেষ নেই। অথচ আমাদের এই ‘বুদ্ধিমান’ নাগরিক সমাজের একেকজন যখন আক্রান্ত হন, অন্যরা তা দেখেন নিরাপদ দূরত্বে বসে। কারও বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা হয়, কারও পত্রিকা বা প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়, কেউ গুম হন, কাউকে দেশান্তর হতে হয়, কেউ জেলে যান, কারও সারা জীবনের অর্জনের ওপর কালিমা লেপন করা হয়।
শক্তিশালী শাসকদের এসব আক্রমণে আমরা একপাল নাগরিক চুপচাপ থাকি। হয়তো ভাবি, নিজে তো নিরাপদে আছি, ঝামেলায় যাওয়ার দরকার কী। তারপর আমরা আরেকজন আক্রান্ত হই, তারপর আরও একজন। আমাদের হুঁশ হয় না আজকাল এসবে। অথচ আমাদের সামনে নজির আছে, একসঙ্গে রুখে দাঁড়ানো বা প্রতিবাদ করার এবং শিকারিকে হটিয়ে দেওয়ার। আমাদের মুক্তিযুদ্ধ তো আছেই, এরপর গণতন্ত্র ও মানবাধিকার রক্ষার সংগ্রামে বিজয়ী হওয়ার নজিরও আছে।
একদলের শাসন, সামরিক শাসন, স্বৈরাচারী শাসনের বহু ক্রান্তিকাল কাটাতে হয়েছে আমাদের। আমরা যখন একত্র থাকতে পেরেছি, একত্রে রুখে দাঁড়াতে পেরেছি, গলায় কামড় খেয়ে লুটিয়ে পড়ার পরিণতি হয়নি আর একসময়।
বহুবছর হলো আমাদের সেই একসঙ্গে রুখে দাঁড়ানো আর হয়ে ওঠে না। বেশ খানিকটা দূরে দাঁড়িয়ে আমাদের কেউ কেউ একটু আওয়াজ তুলি বটে মাঝেমধ্যে। কিন্তু এটি এতই দুর্বলভাবে যে তা আমাদের শিকারিদের নিবৃত্ত করতে পারে না। বরং তারা এতে রাগান্বিত হয়ে তাকালে আমাদের অনেকে সিটিয়ে পড়েন ভয়ে, বাকিদের স্বর আরও ক্ষীণ হয়। আরেকটা শিকারের পর আরও ক্ষীণ হয়।
নাগরিক সমাজের মধ্যে কেউ কেউ আমাকে বেশ স্নেহ করেন। এই সুযোগে তাঁদের বলি, ঘরে যখন আগুন লাগে, সেই আগুন নেভাতে যদি সবাই ছুটে আসেন, আমরা কি জনে জনে জিজ্ঞাসা করি, ভাই আপনার রাজনৈতিক মতাদর্শ কী, আপনি যথেষ্ট প্রগতিশীল কি না? নাকি আমরা সবাই মিলে আগুনটা নেভাই আগে? এই রাষ্ট্রের গণতন্ত্র, প্রতিষ্ঠান ও সিস্টেম যখন হুমকির মুখে, তখন কি তাকে রক্ষা করতে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার প্রয়োজন নেই আমাদের?
আমি এই নাগরিক দলের সঙ্গে কাজ করছি বহু বছর। তাঁদের কেউ কেউ বিপদে পড়লে যেসব প্রতিবাদের উদ্যোগ নেওয়া হয়, তার সঙ্গে থাকি। দেখি, এখন আর রাস্তায় দাঁড়ানো বা সভা-সমিতি দূরের কথা, একটা বিবৃতিতে সই করে প্রতিবাদ জানাতেই নানা ধরনের অনীহা কাজ করে অনেকের মধ্যে।
কেউ ই-মেইলের জবাব দেন না, ফোন করলে ধরেন না। কেউ আবার নানান অজুহাত দেন। যেমন আক্রান্ত ব্যক্তি কি আমাদের সঙ্গে ছিলেন আগে বা আক্রান্ত ব্যক্তির রাজনৈতিক সংস্রব আসলে কী? আক্রমণের প্রতিবাদের বদলে আক্রান্ত ব্যক্তির ঘাটতির দিকে তখন নজর দেওয়া শুরু করেন অনেকে।
মাঝেমধ্যে ঘটে আরও অদ্ভুত ঘটনা। সর্বশেষ বিতর্কিত নির্বাচনের আগে নাগরিক সমাজের এক আক্রান্ত ব্যক্তির পক্ষে বিবৃতি সংগ্রহের চেষ্টা করেছিলাম। আক্রান্ত ব্যক্তি বর্তমান শাসকগোষ্ঠীর অপছন্দের মানুষ। তাই ভয়ে অনেকে স্বাক্ষর করছিলেন না।
হঠাৎ মনে পড়ল, আক্রান্ত ব্যক্তির পক্ষে দাঁড়ান, এমন একজনের সঙ্গে যোগাযোগই করিনি আমরা। বিবৃতির জনৈক উদ্যোক্তাকে জিজ্ঞাসা করলাম, সেই একজনের সঙ্গে আমি যোগাযোগ করব কি না? তিনি সঙ্গে সঙ্গে বললেন, না না, দরকার নেই। জানতে চাইলাম, কেন, সমস্যা কী?
উদ্যোক্তা বললেন, তাঁকে তো আমাদের কেউ কেউ ‘বিএনপি’ ভাবেন। আমি হেসে বললাম, ওই কেউ কেউ কিন্তু আমাকে, এমনকি আপনাকেও বিএনপি ভাবেন। প্রমাণ হিসেবে একটা ঘটনা বললাম, বোঝালাম, বিএনপি ভাবলে সমস্যা নেই কোনো। তিনি এটা নিয়ে পরে আলাপ করবেন বলে গম্ভীরভাবে ফোন রেখে দিলেন।
আমি ভাবি, বাফেলোরা অন্তত আমাদের মতো আজব নয়। তারা আক্রান্ত বাফেলোকে উদ্ধার করতে যায় না বুদ্ধি আর সাহসের অভাবে, ঐক্যের অভাবে নয়। আমাদের বুদ্ধি কম নয়, সাহস দেখানোর ভানও কম নয়। তাহলে কেন এমনভাবে নিজেরা বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকি আমরা?
নাগরিক সমাজের মধ্যে কেউ কেউ আমাকে বেশ স্নেহ করেন। এই সুযোগে তাঁদের বলি, ঘরে যখন আগুন লাগে, সেই আগুন নেভাতে যদি সবাই ছুটে আসেন, আমরা কি জনে জনে জিজ্ঞাসা করি, ভাই আপনার রাজনৈতিক মতাদর্শ কী, আপনি যথেষ্ট প্রগতিশীল কি না? নাকি আমরা সবাই মিলে আগুনটা নেভাই আগে?
এই রাষ্ট্রের গণতন্ত্র, প্রতিষ্ঠান ও সিস্টেম যখন হুমকির মুখে, তখন কি তাকে রক্ষা করতে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার প্রয়োজন নেই আমাদের?
আমি সামান্য মানুষ। আমার কথায় কাজ হয় না তেমন। মৃদু কিছু বিষয়ে (যেমন স্পর্শকাতর জায়গায় পাবলিক টয়লেট কেন হচ্ছে বা গাছ কেন কাটা হচ্ছে) একসঙ্গে প্রতিবাদ এখনো হয়। কিন্তু সরকারের জন্য বিব্রতকর কোনো প্রতিবাদ করতে গেলে অনেককেই পাশে পাওয়া যায় না। ভিন্নমতের মানুষের বিচ্যুতিতে (যেমন কোনো নারীর প্রতি অবমাননামূলক বক্তব্য) আমরা খুব উৎসাহ দেখাই। অথচ এর চেয়েও অবমাননাকর বক্তব্য শাসক দলের নেতাদের মুখ থেকে করা হলে প্রতিবাদের কথা ভুলেও ভাবতে চাই না।
খারাপ কাজের প্রতিবাদ করার প্রশ্ন এলে আমরা অনেকেই হিসাব করি, কাজটা কে করেছে, কার বিরুদ্ধে করা হয়েছে। সেটা অনুসারে প্রতিক্রিয়া জানাই বা চুপ করে থাকি। এই কাজটা যাঁরা করেন, তাঁদের মধ্যে রয়েছেন মানবাধিকারকর্মী হিসেবে পরিচিতি পাওয়া কিছু স্বনামধন্য মানুষও!
বহু বছর আগে আমি প্রথম আলোতে সিংহ আর হায়েনার গল্প লিখেছিলাম। সাধারণ জনগণকে তুলনা করেছিলাম হরিণের সঙ্গে। অপরপক্ষ অবশ্য বিরক্ত হয়েছিল। এই লেখা পড়েও ‘সিংহদের’ কেউ কেউ রাগান্বিত হতে পারেন, ‘বাফেলো’দের অনেকে হতে পারেন বিব্রত। সেই বাফেলোদের বলি, সিংহের সামনে আপনিও কিন্তু নিরাপদ নন। কোনো না কোনোভাবে একদিন আক্রান্ত হতে পারেন আপনিও।
আমাদের তাই উচিত, বাফেলো অভিব্যক্তি ত্যাগ করে বুদ্ধিমান আর বিবেকবান মানুষের মতো আচরণ করা। যেকোনো সময়ে যেকোনো অন্যায়ের প্রতিবাদ করা, প্রতিবাদে ঐক্যবদ্ধ থাকা।
আসিফ নজরুল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক