কার মিছিলে কত লোক, কার বাহুতে কত বল, তার শোডাউনেই ভোটের শোভা। সেই শোভা অনেক বছর চোখে পড়ে না।
একটা সময় ছিল যখন ‘ছালা মার্কায় দিলে ভোট, শান্তি পাবে দেশের লোক’; ‘মায়ের কোলে শিশুর ডাক, তালা মার্কা জিতে যাক’ টাইপের স্লোগানমুখর মাইকিংয়ে এলাকাবাসীর কানে তালা লেগে যেত।
ওই সময়টাতে ছালা ভালো নাকি তালা ভালো, তা নিয়ে বোবা-কালাদেরও বাহাস হতো। কোন মার্কার মিছিল বড় ছিল; ছালার, নাকি তালার, তা নিয়ে কথা-কাটাকাটি হতো। লাঠালাঠি হতো। ফাটাফাটি হতো।
পাড়ায়-মহল্লায় টিনের চালা কিংবা তেরপলের তাঁবু খাঁটিয়ে ছালা মার্কা, তালা মার্কা, থালা মার্কার ‘অফিস’ খোলা হতো। সেই অফিসে সকাল-সন্ধ্যা চুলা জ্বলত। মাগনা চায়ের সঙ্গে ‘টা’ থাকত। ভোটার আসত। ভোটার যেত।
অনেক ভোটার সকালে ছালা মার্কার অফিসে ঢুকে থোড় বড়ি খাড়ার মতো চা-বিড়ি-পান খেয়ে বিকেলে তালা মার্কার অফিসে গিয়ে খাড়া-বড়ি-থোড়ের মতো পান-বিড়ি-চা খেয়ে ঘরে ফিরতেন। বাজার–ঘাট বা চায়ের দোকানে বসা আড্ডাবাজদের ভোটের হিসাবনিকাশমূলক ‘টক শো’ হতো।
দল এবং বলসহ প্রার্থীরা বাড়ি বাড়ি ঢুঁ মারতেন। গেরস্ত দরজা খুলতেন। সেকেন্ডের মধ্যে প্রার্থীর গোবদা মুখে ভাব-ভালোবাসা মার্কা হাসি ছড়িয়ে পড়ত। মিনিটখানেকের মধ্যে ‘কেমন আছেন? ছোট মেয়েটা কোন ক্লাসে উঠল? বড় ছেলেটার খবর কী?’ পর্ব শেষ হতো।
এরপর প্রার্থী কাতর মিনতিমাখা চোখে ভোটারের কাছে ভোট চাইতেন। দোয়া চাইতেন। ভোটার বেচারা অতি বিনয়ে আশ্বাসসূচক ঘাড় নাড়তেন।
একের পর এক ছালা-তালা-থালা মার্কার প্রার্থীরা আসতেন। ভোটারও একই কায়দায় প্রত্যেককেই ভোট দেবেন বলে কথা দিতেন।
এ ছবি সাধারণত দেখা যেত ইউপি-পৌর-উপজেলা পরিষদের ভোটে। তখন স্থানীয় ভোটে নৌকা, ধানের শিষ, লাঙ্গল কিংবা দাঁড়িপাল্লা প্রতীক ছিল না।
যে প্রার্থীদের মধ্যে ‘পাল্লাপাল্লি’ চলত, তাঁদের মধ্যে সরকারি দলের নেতা থাকতেন, বিরোধী দলের নেতা থাকতেন, সত্যিকারের স্বতন্ত্র (ডামি না) নেতাও থাকতেন। এসব প্রার্থীর কেউ কেউ ঢাকায় এসে দলের ওপরের সারির নেতাদের কদমবুছি করে যেতেন। তবে ‘প্রচারে: এলাকাবাসী’ সংবলিত ভোটের পোস্টারে সেই নেতাদের ছবি থাকত না।
২০১৫ সালে সেই ছবি বদলে গেল। সে বছর থেকে রাজনৈতিক দলগুলো প্রতীক দেওয়া শুরু করল। সেই থেকে ইউপি-পৌর-উপজেলার ভোটে হাঁকডাক থাকল না। মিছিল থাকল না। মাইক থাকল না। মাগনা চা থাকল না। মাগনা ‘টা’ থাকল না। ঘরে ঘরে প্রার্থীদের ঢুঁ মারা থাকল না।
মূলত স্থানীয় ভোটে যখন থেকে আওয়ামী লীগ মনোনয়ন দেওয়া শুরু করল এবং সেই মনোনীত প্রার্থীরা নৌকা প্রতীক নিয়ে ভোটে দাঁড়াতে শুরু করলেন, তখন থেকে এসব মিছিল, মাইক, ভোটভিক্ষা—সব ‘নাই’ হয়ে যেতে শুরু করল।
সিটি করপোরেশনের মতো বড় নির্বাচনে বিএনপি কোনো কোনো জায়গায় প্রার্থীদের ধানের শিষ দিয়েছিল। কিন্তু ইউপি বা পৌরসভা পর্যায়ে ধানের শিষ, লাঙ্গল বা দাঁড়িপাল্লা বলে কিছু সেভাবে দৃশ্যমান ছিল না।
অধিকাংশ ইউপি এবং পৌরসভার নির্বাচনে ‘নৌকা যার জয় তার’—এটি একরকম ফাইনাল কথা হয়ে দাঁড়িয়েছিল।
তার মানে, ওই এলাকায় আওয়ামী লীগের যত জনপ্রিয় নেতাই থাকুন না কেন, তাঁর পক্ষে আর নৌকা মার্কা পাওয়া ক্যান্ডিডেটকে সমর্থন না করার সুযোগ থাকত না। নৌকার প্রার্থীর বিরুদ্ধে কেউ কাজ করলে তাঁকে কড়া সাজা দেওয়া হতো।
যেহেতু নৌকার সামনে কারও টিকে থাকা সম্ভব হতো না, সেহেতু ভোটার বুঝতে পারতেন, নৌকার জয় ঠেকানোর কেউ নেই। সুতরাং ভোটকেন্দ্রে তাঁর না গেলেও চলবে।
নৌকার প্রার্থীও বুঝতেন, তাঁর জয় যেহেতু মনোনয়ন পাওয়ার দিনেই ফাইনাল হয়ে গেছে, সেহেতু খালি খালি ভোটারের বাড়ি গিয়ে ‘কেমন আছেন?
ছোট মেয়েটা কোন ক্লাসে উঠল? বড় ছেলেটার খবর কী?’ করার কোনো মানে হয় না। প্রার্থীর কাছে তখন মাগনা ‘চা-পান-সিগারেট’ সাপ্লাই বিরাট বাজে খরচার ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছিল।
এবার মনে হয় পুরোনো সেই ছবি কিছুটা হলেও ফিরে আসছে। কারণ, আওয়ামী লীগ স্থানীয় নির্বাচনে কাউকে নৌকা দিচ্ছে না। উপজেলা পরিষদ দিয়ে ব্যাপারটা শুরু হচ্ছে। এপ্রিলের শেষ সপ্তাহ থেকে মে মাসের শেষ সপ্তাহের মধ্যে উপজেলা নির্বাচন শেষ করার ইঙ্গিত দিয়েছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)।
জনসাধারণের সাধারণ ধারণা, এই নৌকাবিহীন ভোট আওয়ামী লীগ তথা সরকারের ‘এক ঢিল’। তাই দিয়ে তারা বহু ‘পাখি’ মারতে চাচ্ছে।
প্রথম কথা হলো, স্থানীয় নির্বাচনে নৌকা মার্কা উঠিয়ে দিলে দলের পিঠ চাপড়ানি ছাড়াই এলাকায় দলের মধ্যে আসলে কে বড় পালোয়ান তা সহজে বুঝতে পারবে আওয়ামী লীগ।
দল যেহেতু এবার একজনকে টিকিট দিয়ে সবাইকে তাঁর হয়ে প্রচারে নামতে বলছে না, সেহেতু স্থানীয় যেকোনো নেতা আগের আমলের মতো ছালা-তালা-থালা মার্কা নিয়ে দাঁড়াতে পারবেন।
এতে পাড়ায়-মহল্লায় তাঁদের আলাদা আলাদা ‘অফিস’ বসবে। সেসব অফিসে নিজেদের অনুসারী ও সমর্থকেরা আসবেন। পাশাপাশি কোনো দলাদলির মধ্যে না থাকা লোকও সেখানে আসা-যাওয়া করতে পারবেন। সকাল-বিকেল পাল্টাপাল্টি মিছিল বের হবে।
রামের মিছিলে এক হাজার লোক হলে শাম দেড় হাজার লোকের মিছিল বের করবেন। যদু এবং মধুও কী করে বড় মিছিল করা যায়, সেই চেষ্টা করবেন। সংখ্যা দিয়ে সংখ্যার টক্কর হবে। পরস্পরকে ‘দেখিয়ে দেওয়ার’ প্রত্যয় থাকবে। একাধিক হুংকার–ব্যবস্থা থাকবে। সব মিলিয়ে একটা ‘ভোট-ভোট’ ভাব তৈরি হবে।
এ ধরনের পরিবেশ তৈরি হলে কে জিতবে, কে হারবে সেটি আগের আমলের মতো ভোটার আগেভাগেই নিশ্চিত সিদ্ধান্তে আসতে পারবেন না।
ফলে বিএনপির বা সরকারবিরোধী দলের সমর্থকেরা ভোট দিতে যদি না–ও আসেন, অন্তত সরকার সমর্থকদের মধ্যে ভোট নিয়ে আগ্রহ পয়দা হবে। নিজেদের ক্যান্ডিডেটকে জেতাতে ভোটাররা তখন ভোট দিতে যাবেন।
বিএনপি যেহেতু সংসদ নির্বাচন বর্জন করেছে, সেহেতু এই নির্বাচনে এলে একদিকে তার ‘মুখ’ থাকবে না; অন্যদিকে এর মাধ্যমে সরকারের বৈধতাও মেনে নেওয়া হবে।ভোটে নৌকা না থাকলে বিএনপির স্থানীয় নেতাদের স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে দাঁড়ানো থেকে ঠেকিয়ে রাখা কঠিন হবে।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোটারের আকাল নিয়ে সম্ভবত সরকারি দলের মধ্যে কিছুটা হলেও লজ্জা লজ্জা ভাব আছে। ভোটার উপস্থিতি বাড়লে সেই ভাবটা তখন কেটে যাওয়ার একটা সুযোগ তৈরি হবে। এটি সরকারকে একটি মোরাল ন্যারেটিভ দাঁড় করাতে সাহায্য করবে।
নৌকা প্রতীকের বরাদ্দ চালু করার পর থেকে লোকাল নেতারা এলাকার রাম-শাম-যদু-মধুর কাছে না গিয়ে বেশি যেতেন ঢাকায়। সেখানে বড় নেতারা থাকেন। সেখান থেকে টিকিট দেওয়া হতো। এই টিকিট পাওয়া নাকি অনেক খরচাপাতির ব্যাপার ছিল।
এর সুবাদে ‘মনোনয়ন বাণিজ্য’ বলে একটা শব্দবন্ধ ইতিমধ্যে তৈরি হয়ে গেছে। নৌকা তুলে দেওয়ায় এখন প্রার্থীদের সেই বাণিজ্য এড়িয়ে ইলেকশন-খরচা বাঁচানোর একটা সুযোগ হয়েছে।
আওয়ামী লীগের নৌকা প্রতীক তুলে দেওয়াটা বিএনপির জন্য যে শাঁখের করাত হবে, তা আন্দাজ করা যাচ্ছে। নৌকা মার্কাবিহীন ভোটে বিএনপির গেলেও বিপদ, না গেলেও বিপদ।
বিএনপি যেহেতু সংসদ নির্বাচন বর্জন করেছে, সেহেতু এই নির্বাচনে এলে একদিকে তার ‘মুখ’ থাকবে না; অন্যদিকে এর মাধ্যমে সরকারের বৈধতাও মেনে নেওয়া হবে।
ভোটে নৌকা না থাকলে বিএনপির স্থানীয় নেতাদের স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে দাঁড়ানো থেকে ঠেকিয়ে রাখা কঠিন হবে।
যখন কোনো নেতা দলের সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে দাঁড়াবেন, চক্ষুলজ্জায় পড়ে হলেও তখন দলীয়ভাবে তাঁকে সাজা দেওয়ার বিষয়টি সামনে আসবে। এতে বিএনপির মধ্যে ঝগড়াঝাঁটি বাড়বে।
জাতীয় নির্বাচনের আগে ব্যাপক ধরপাকড়ের কারণে বিএনপির এখন চিড়েচ্যাপ্টা দশা। এর মধ্যে তৃণমূলে কোন্দল লাগলে তা দলটির সাংগঠনিক বাঁধনকে আরও আলগা করে দিতে পারে।
নৌকা মার্কাবিহীন নির্বাচনের এই ঢিল দিয়ে সবচেয়ে যে বড় পাখিটা সরকার মারতে চায়, সেটি হলো সদ্য শেষ হওয়া সংসদ নির্বাচনের বৈধতা ও ভোটার উপস্থিতি বিষয়ক যাবতীয় আলাপকে আপাতত চাপা দেওয়া।
আন্দাজ করি, নৌকা মার্কা না থাকায় সব দলের স্থানীয় নেতারা উপজেলা নির্বাচনে আগ্রহ দেখাবেন। যাঁরা মনে করেন, এলাকায় তাঁদের জনসমর্থন আছে, তাঁদের একটি বড় অংশ দাঁড়াতে চাইবেন। এতে একটা ‘পাল্লাপাল্লি’র পরিবেশ তৈরি হবে।
সাধারণ মানুষ উপজেলা নির্বাচনের তাৎক্ষণিক উত্তেজনায় সংসদ নির্বাচনের ইস্যু ভুলে যাবে।
উপজেলা নির্বাচনে কে জিতবে, কে হারবে, তাই নিয়ে পাবলিক মেতে উঠবে। সেই মাতামাতিতে একদিকে ইতিমধ্যেই মুষড়ে পড়া বিএনপিসহ বিরোধীদের আরও হতাশার দিকে নিতে পারে।
অন্যদিকে, তা সরকারের এক তরফা সংসদ নির্বাচন বিষয়ক অস্বস্তির ক্ষতে মলমের মতো কাজ করতে পারে।
সারফুদ্দিন আহমেদ প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক
ইমেইল: sarfuddin2003@gmail.com