সময় এখন রাশিয়ার সবচেয়ে বড় মিত্র। রাশিয়াকে এখন ইউক্রেনের যুদ্ধক্ষেত্রে তাদের সৈন্যদের মৃত্যুর সংখ্যা যতটা সম্ভব কমিয়ে আনতে হবে। ইউক্রেনে সামরিক দিক থেকে যত দিন পর্যন্ত সম্ভব সক্রিয় থাকতে হবে।
ভ্লাদিমির পুতিনের জন্য এখন সবচেয়ে বড় সহযোগিতা হতে পারে যদি কিয়েভের অস্ত্র সরবরাহে বাধা তৈরি হয়। যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন যে সামরিক সহায়তা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, বাস্তবে সেটার পরিমাণ যেন কমে যায়। মধ্যপ্রাচ্যে যদি ইউক্রেনের মিত্ররা বড় কোনো যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে, তাহলে সেটা ঘটবে।
৭ অক্টোবর গাজা থেকে ইসরায়েলে হামাসের সহিংস আক্রমণের পর যুক্তরাষ্ট্র কূটনৈতিকভাবে এরই মধ্যে বিভ্রান্তির মধ্যে পড়েছে। এ পরিস্থিতিতে হামাস–ইসরায়েল সংঘাতে ইউক্রেন থেকে সামরিক সরবরাহ মধ্যপ্রাচ্যের দিকে চলে যেতে পারে। অবশ্য ইসরায়েল গাজা দখলে নেওয়ার চেষ্টা করবে কি না, তার ওপর নির্ভর করবে অস্ত্রের চালান কতটা ইউক্রেন থেকে ইসরায়েলের দিকে যাবে। এ ধরনের কোনো যুদ্ধ শুরু হলে মিত্ররা ইউক্রেনের বেশি পরিমাণ অর্থায়ন করতে উৎসাহ হারাবে। মধ্যপ্রাচ্যে যদি বড় আকারের সংঘাত বেধে যায় অথবা সুযোগ বুঝে চীন যদি তাইওয়ানে আক্রমণ করে বসে, তাহলে সেখানকার হিংসা ইউক্রেন ছাপিয়ে যাবে।
ইসরায়েল–হামাস সংঘাতে রাশিয়ার কূটনৈতিক অবস্থান এখনো পরিষ্কার নয়। ঐতিহাসিকভাবে রাশিয়া ইসরায়েলের প্রতি বন্ধুভাবাপন্ন। সে কারণেই ইউক্রেনে আগ্রাসনের পর ইসরায়েল রাশিয়াকে নরম সুরে সমালোচনা করেছে। রাশিয়া সম্প্রতি ইরানের প্রতি বন্ধুত্ব দেখাচ্ছে। কারণ, ইরান থেকে তারা সামরিক সরঞ্জাম কিনছে। ইসরায়েলের আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থা ফাঁকি দিয়ে হামাস যেসব অস্ত্র ব্যবহার করে দেশটির ভেতরে হামলা চালিয়েছে, তার উৎস ইরান হতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে। ইসরায়েলের গোয়েন্দাব্যবস্থাকে ফাঁকি দেওয়ার জন্য যে পাল্টা গোয়েন্দা কৌশল প্রয়োগ করেছে, তার উৎসও ইরান হতে পারে। রাশিয়া বিশ্বের বিভিন্ন দেশে গোয়েন্দাপ্রযুক্তি বিক্রি করে, সে কারণে ইরানে পাল্টা–গোয়েন্দা প্রযুক্তিতে রাশিয়ার প্রভাব থাকাটা স্বাভাবিক। রাশিয়া দীর্ঘদিন ধরে বহুস্তরিক কূটনীতি বজায় রেখে চলেছে। এর মাধ্যমে মস্কো মধ্যপ্রাচ্যে প্রতিদ্বন্দ্বী এবং এমনকি যুদ্ধরত দেশগুলোর মধ্যে ইতিবাচক সম্পর্ক বজায় রেখে চলেছে। সেটা তারা ভবিষ্যতেও অব্যাহত রাখবে।
কোনো কিছু লুকোছাপা না করে পরিষ্কার করে বলার একটা দীর্ঘ ইতিহাস আছে পুতিনের। তিনি কী করতে চান, সেটা সব সময় স্পষ্ট করে বলেন, কিন্তু আমরা ধরে নিই সেগুলো বাগাড়ম্বর। কিন্তু বাস্তবে তিনি তাঁর পরিকল্পনা আমাদের বলে যান এবং দেখিয়ে দেন তার মধ্যে কয়টা শেষ করতে পারছেন।
বেশির ভাগ আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম ৫ অক্টোবর রাশিয়ার বার্ষিক নিরাপত্তা সম্মেলনে (ভলদাই ডিসকাশন ক্লাব নামে যেটা পরিচিত) ভ্লাদিমির পুতিনের দেওয়া বক্তব্য প্রকাশ করেছে। সেখানে তিনি এমন বিশ্বব্যবস্থা গড়ে তোলার ইচ্ছা প্রকাশ করেন, যা হবে ‘সভ্যতাভিত্তিক’। এই বিশ্বব্যবস্থায় আঞ্চলিক পার্থক্য ও বিভিন্ন জাতির মধ্যকার সাধারণ স্বার্থকে গুরুত্ব দেওয়া হবে। পুতিনের এই বক্তব্য পশ্চিমা ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদের পরিষ্কার প্রত্যাখ্যান। উন্নয়নশীল বিশ্বের প্রতি এই বার্তা দিলেন যে রাশিয়ার সত্তা আর তাদের সত্তায় কোনো পার্থক্য নেই।
পুতিন তাঁর ভাষণে বলেন, ২০ বছর ধরে রাশিয়া খুব ইতিবাচকভাবে বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জগুলো সমাধানে সহযোগিতা করার পথ অনুসন্ধান করছে। কিন্তু অভিযোগ করেন যে এই সম্পৃক্ততাকে পশ্চিমারা তাদের আকাঙ্ক্ষা ও মূল্যবোধের প্রতি বশ্যতা বলেই মনে করে। পুতিন এরপর যুক্তি দেন যে পশ্চিমা ধরনের অর্থনৈতিক শোষণ ও মতাদর্শিক আধিপত্য অনুসরণ না করে বিশ্বে অনেকগুলো ক্ষমতার কেন্দ্র থাকা প্রয়োজন এবং বিশ্বকে দেখার ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি থাকা প্রয়োজন।
রাশিয়া আরও একটি ক্ষেত্রে লাভবান হবে। কেননা, যুক্তরাষ্ট্রের প্রসিডেন্ট নির্বাচনে আলোচনার একেবারে কেন্দ্র থেকে রাশিয়া গুরুত্ব হারাবে। ইউক্রেনকে দেওয়া সমর্থনের ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রে অসন্তোষ বাড়ছে। মধ্যপ্রাচ্যে ইসরায়েলকে সমর্থন দিতে হবে যুক্তরাষ্ট্রকে। এসব বাস্তবতা ইউক্রেন সংঘাত অবসানে নিষ্পত্তিমূলক ভূমিকা পালন করতে হতে পারে।
যুক্তরাষ্ট্র ও চীনকে পুতিন বৈশ্বিক ক্ষমতা ও বিশ্ব দৃষ্টিভঙ্গির বিকল্প বলে বর্ণনা করেন। পুতিনের সভ্যতাভিত্তিক বিশ্বব্যবস্থার এই তত্ত্ব অনুযায়ী, ইউক্রেনে তার আগ্রাসন দেশটির ভূখণ্ড দখলের চেষ্টা নয়। বরং ন্যাটো ও ইউরোপীয় ইউনিয়নকে প্রতিহত করার প্রচেষ্টা।
পুতিনের ভালদাই বক্তৃতার মূল বিষয় হলো, উপনিবেশের হাত থেকে মুক্তি। কিন্তু ইউক্রেনীয়দের কাছে এই বক্তব্য মূল্যহীন। মধ্যপ্রাচ্য প্রসঙ্গে পুতিন বলেন, আরব দেশগুলোর সঙ্গে ন্যাটো বেছে বেছে সম্পর্ক গড়ে তুলছে। যারা অনুগত তাদেরই সুরক্ষা দিচ্ছে, তাদের মূল্যবোধ ও ঐতিহ্যকে মূল্যায়ন করছে না।
ইসরায়েল ও হামাসের মধ্যে নতুন যে সংঘাত জন্ম হলো, তাতে রাশিয়া নিশ্চিত করেই লাভবান হবে, কিন্তু এতে ক্রীড়নকের ভূমিকায় আসতে পারবে না।
রাশিয়া আরও একটি ক্ষেত্রে লাভবান হবে। কেননা, যুক্তরাষ্ট্রের প্রসিডেন্ট নির্বাচনে আলোচনার একেবারে কেন্দ্র থেকে রাশিয়া গুরুত্ব হারাবে। ইউক্রেনকে দেওয়া সমর্থনের ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রে অসন্তোষ বাড়ছে। মধ্যপ্রাচ্যে ইসরায়েলকে সমর্থন দিতে হবে যুক্তরাষ্ট্রকে। এসব বাস্তবতা ইউক্রেন সংঘাত অবসানে নিষ্পত্তিমূলক ভূমিকা পালন করতে হতে পারে।
২০২৫ সালেও যদি ইউক্রেন সংঘাত চলতে থাকে, তাহলে রাশিয়া নিশ্চিতভাবেই এগিয়ে থাকবে।
এশিয়া টাইমস থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত
● রবার্ট এম ডোভার ইউনিভার্সিটি অব হালের গোয়েন্দা ও জাতীয় নিরাপত্তা বিষয়ে অধ্যাপক