ইউক্রেন সংকট থেকে আমরা এখন যে খবর পাচ্ছি, তার সময়োচিত মূল্যায়ন দরকার।
ইউক্রেন সংকট থেকে আমরা এখন যে খবর পাচ্ছি, তার সময়োচিত মূল্যায়ন দরকার।

ইউক্রেনকে নিয়ে গভীর সংকটে আমেরিকা–ইউরোপ

গত শতকের নব্বইয়ের দশকে পশ্চিমের সঙ্গে রাশিয়ার সম্পর্ক যখন স্থাপিত হলো, তখন ভ্লাদিমির পুতিন খোলাখুলিভাবে বলেছিলেন, পূর্ব ইউরোপের দেশগুলোর ন্যাটোতে যুক্ত হওয়া ঠিক হবে না। এরপর ১৯৯৯ সালে রাশিয়া ইউরোপের নিরাপত্তা–সনদে সই করেছিলেন পুতিন।

এই সনদে ছিল—স্বাক্ষরকারী প্রতিটি দেশের তাদের নিরাপত্তা ব্যবস্থাপনা বেছে নেওয়া ও বদলানোর এবং যেকোনো জোটে যুক্ত হওয়ার অধিকার থাকবে। কিন্তু সেই প্রতিশ্রুতি মৃত হয়ে গেছে।

ইউক্রেন সংকট থেকে আমরা এখন যে খবর পাচ্ছি, তার সময়োচিত মূল্যায়ন দরকার। রাশিয়া তার অবস্থান ধরে রাখার চেষ্টা করে যাচ্ছে এবং পশ্চিমকে একবিন্দু ছাড় দিতে মস্কো রাজি নয়। এর কারণ হলো, যুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী হলে টিকতে যে অসুবিধা হবে না, তা রাশিয়া বুঝে গেছে।

১৯৯৪ সালে ইউক্রেন যখন তাদের পারমাণবিক অস্ত্র রাশিয়াকে দিয়ে দেয়, তার বিনিময়ে রাশিয়া ইউক্রেনকে নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দিয়েছিল। এর ফলে ওয়াশিংটন ও লন্ডনের প্রভাব বিলুপ্ত হয়েছিল। ইউক্রেনের পারমাণবিক অস্ত্রের বিষয়টি বিস্মৃতির অতলে হারিয়ে গেছে। আর কখনো সেটা উল্লেখ করা হবে না।

যুদ্ধক্ষেত্রে ইউক্রেনের সফলতা বিক্ষিপ্ত ও বিচ্ছিন্ন। এরপরও তারা ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে রাশিয়া আগ্রাসন চালিয়ে ইউক্রেনের যতটা ভূখণ্ড দখলে নিয়েছিল, তার প্রায় ৫৪ শতাংশ ভূখণ্ড পুনরুদ্ধার করে নিয়েছে। যাহোক, রাশিয়া এখন পর্যন্ত ইউক্রেনের মোট ভূখণ্ডের ১৮ শতাংশ নিয়ন্ত্রণ করছে।

গত বছরে ইউক্রেনের বহু প্রত্যাশিত আক্রমণ অভিযান সামান্য কিছুটা ভূখণ্ড জয় করতে পারে। এ পরিস্থিতিতে আশা করা যায়, দুই পক্ষের কেউই আর নতুন কোনো ভূখণ্ড জয় করবে না। আর ক্রিমিয়াকে যে রাশিয়া নিজেদের অন্তর্ভুক্ত করে নিয়েছে, সেটা ভিন্ন বিষয়। এই ইস্যুকে ভিন্নভাবে মোকাবিলা করতে হবে।

যুদ্ধ শুরুর পর থেকে ইউক্রেন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতি অপরিবর্তিত রয়েছে। ইউক্রেন নিয়ে কী করবে, তা নিয়ে দ্বিধাগ্রস্ত ওয়াশিংটন। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতি দেখে মনে হচ্ছে, তারা ‘অপেক্ষা ও দেখার’ নীতি নিয়েছে।

পশ্চিমারা যদি কিয়েভকে বিপুল পরিমাণ সামরিক সহায়তা না দেয়, তাহলে ইউক্রেন সংকট সমাধানের কোনো পথ নেই। আবার রাশিয়ার নিয়ন্ত্রণে ইউক্রেন পরিচালিত হোক, সেটাও পশ্চিমারা হতে দেবে না। সে কারণে এই যুদ্ধ দীর্ঘকালব্যাপী সংঘটিত হতেই থাকবে। রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই লাভরভ গত সপ্তাহে যেমন বলেছেন, পশ্চিমা করদাতাদের অর্থ ইউক্রেন পেতেই থাকবে।

গাজা যুদ্ধ নয়, রাশিয়ার সঙ্গে আটলান্টিক মহাসাগরীয় দেশগুলোর লড়াই সামনে আরও তীব্র হবে। ইউক্রেন যুদ্ধ দুটি কারণে এখন একটু প্রশমিত অবস্থায় রয়েছে। প্রথমত, পশ্চিমা দেশগুলো তাদের সহায়তা গাজা যুদ্ধ ও ইউক্রেন যুদ্ধে ভাগাভাগি করে দিচ্ছে। দ্বিতীয়ত, ইসরায়েলের হামলা যে বৈধ, তা নিয়ে পশ্চিমাদের যে অসংগত দৃষ্টিভঙ্গি, তা দিন দিন বাড়ছে। যদি কোনো সংকটজনক মুহূর্ত এসে যায়, তাহলে যুক্তরাষ্ট্র সম্ভবত তাদের বেশির ভাগ সমর্থন ইসরায়েলকেই দেবে। সে ক্ষেত্রে ইউক্রেনের কাছ থেকে কিছুটা ভূখণ্ড আবার দখলে নেওয়ার সুযোগ পাবে রাশিয়া।

যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে ইউক্রেনকে কিছু সমস্যার মুখোমুখি হতে হচ্ছে। কয়েকটি পশ্চিমা দেশ ইউক্রেনকে আরও অর্থ ও অস্ত্র-গোলাবারুদ না দেওয়ার অজুহাত তৈরি করেছে। একই ধরনের সংকট তৈরি হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসে। ইউক্রেনকে সহায়তা দেওয়ার জন্য নির্দিষ্ট করে রাখা ৫০ বিলিয়ন ডলার আটকে দিয়েছে রিপাবলিকানরা।

আর এই তহবিল আটকে দেওয়ার ক্ষেত্রে অন্য আরেকটি কারণ কারণ রয়েছে, যেটি কিনা ইউক্রেনের কোনো যোগসূত্রহীন। রিপাবলিকানরা ইউক্রেনের তহবিল আটকে দিয়েছেন, তার কারণ হলো, লাতিন আমেরিকা থেকে যুক্তরাষ্ট্রে আশ্রয়প্রার্থীদের আসা বন্ধ করতে চান।

গাজা যুদ্ধ এবং মধ্যপ্রাচ্যের অন্য কোনো জায়গায় যে অস্থিতিশীলতা ছড়িয়ে পড়ছে, সেটাও ইউক্রেন থেকে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মনোযোগ সরিয়ে নিচ্ছে। এককভাবে গাজা যুক্তরাষ্ট্রের পুরোটা মনোযোগ পাচ্ছে। কূটনৈতিক প্রচেষ্টা ও সামরিক সহায়তা—দুই ক্ষেত্রেই যুক্তরাষ্ট্রের অগ্রাধিকারে রয়েছে ইসরায়েল। আর ইসরায়েলের প্রশ্ন যখন আসছে, তখন অর্থের প্রবাহে কোনো বাধা আসছে না।

ইউক্রেন ও গাজা যুদ্ধের পর, লোহিত সাগর ও মধ্যপ্রাচ্যের অন্যখানে যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ার একটা প্রবণতা দেখা দিয়েছে। এ প্রেক্ষাপটে হিংসাত্মক বিশ্বযুদ্ধ দেখা দেওয়ার শঙ্কা কম। কিন্তু ভবিষ্যতের যুদ্ধ হতে পারে একে অন্যকে ছাড় না দেওয়ার যুদ্ধ কিংবা প্রক্সি যুদ্ধ।

ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি গত মাসে ঘোষণা দিয়েছেন তার দেশের যুদ্ধ করার ক্ষমতা টেকসই করতে তিনি আরও সাড়ে চার থেকে পাঁচ লাখ সেনা নিয়োগ দেবেন। এটা করা মোটেই সহজ হবে না। কেননা, রাশিয়া ও ইউক্রেন দুদিকেই যুদ্ধক্লান্তি জাঁকিয়ে বসেছে।

এ ছাড়া নিয়মিতভাবে যুদ্ধে পরাজিত হওয়ার কারণে ইউক্রেনের অস্ত্র ও গোলাবারুদে টান ধরেছে। যুক্তরাষ্ট্রের একটি সরকারি নথিতে বলা হচ্ছে, ইউক্রেনের কাছে যেসব প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম দেওয়া হয়েছে, সেগুলো থেকে কিছু অন্যখানে অবৈধভাবে হস্তান্তর করা হয়েছে। যাহোক, যুক্তরাষ্ট্রের ইউরোপীয় কমান্ড এটা স্বীকার করেছে, কোনো অস্ত্র যদি অযথাযথভাবে ব্যবহৃত হয়, সেটা তদন্ত করার সুযোগ নেই।

রাশিয়া-ইউক্রেন সম্পর্কে আরও জটিলতা যুক্ত হয়েছে। গত সপ্তাহে ৬৫ জন ইউক্রেনীয় যুদ্ধবন্দীকে নিয়ে রুশ যুদ্ধবিমান বিধ্বস্ত হয়। তিন রুশ কর্মকর্তা ও ছয়জন ক্রুও নিহত হন। বিমানটিকে রাশিয়া ও ইউক্রেন সীমান্তে গুলি করে ভূপাতিত করা হয়।

এদিকে সুইডেনকে ন্যাটোতে যুক্ত হওয়ার ব্যাপারে তুরস্ক সম্মতি দিয়েছে। তুরস্কের পার্লামেন্টে গত সপ্তাহে বিষয়টি অনুমোদন দেওয়া হয়। এর বিনিময়ে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তর কংগ্রেসকে জানায় যে তুরস্কের সঙ্গে ২৩ বিলিয়ন ডলারের এফ-১৬ যুদ্ধবিমান বিক্রির চুক্তি সম্পাদিত হয়েছে।

পশ্চিমারা যদি কিয়েভকে বিপুল পরিমাণ সামরিক সহায়তা না দেয়, তাহলে ইউক্রেন সংকট সমাধানের কোনো পথ নেই। আবার রাশিয়ার নিয়ন্ত্রণে ইউক্রেন পরিচালিত হোক, সেটাও পশ্চিমারা হতে দেবে না। সে কারণে এই যুদ্ধ দীর্ঘকালব্যাপী সংঘটিত হতেই থাকবে। রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই লাভরভ গত সপ্তাহে যেমন বলেছেন, পশ্চিমা করদাতাদের অর্থ ইউক্রেন পেতেই থাকবে।

  • ইয়াসার ইয়াকিস তুরস্কের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী, তুরস্কের ক্ষমতাসীন একে পার্টির প্রতিষ্ঠাতা সদস্য
    আরব নিউজ থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত