ভারতের রাজস্থানে আজমির শরিফে ভক্তদের ভিড়
ভারতের রাজস্থানে আজমির শরিফে ভক্তদের ভিড়

আলতাফ পারভেজের কলাম

ভারতে আজমির শরিফকে নিয়েও কেন রাজনীতি

ভারতের হিন্দুত্ববাদী রাজনৈতিক সংগঠনগুলো বরাবরই বিশ্বজুড়ে হিন্দুদের সুরক্ষাকারী হিসেবে নিজেদের দেখে থাকে। অথচ ভারতের ভেতরে অন্য ধর্মাবলম্বীদের ধর্মীয় ও নাগরিক স্বাধীনতার বিষয়ে তারা কেন অসহিষ্ণু? সম্প্রতি দেশটিতে আজমির শরিফ নিয়ে যে রাজনীতি শুরু হয়েছে, তা নিয়ে লিখেছেন আলতাফ পারভেজ

বিশ্বজুড়ে দেশে দেশে জাতিগত ও ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের দুর্গতি আর দুর্ভাগ্যের শেষ নেই; দক্ষিণ এশিয়ায় যা বাড়তি এক সত্য। যতই গণতন্ত্র থাকুক, বাংলাদেশ ও পাকিস্তানে কোনো হিন্দু, ভারতে কোনো মুসলমান বা খ্রিষ্টান, শ্রীলঙ্কায় কোনো তামিলের পক্ষে দেশের প্রধান নির্বাহী হওয়া সম্ভব কি না, সেই উত্তর বোধ হয় কারও অজানা নেই; অথচ এসব দেশে রাজনৈতিক উত্তাপ থেকে সাধারণ সংখ্যালঘুদের কারও বাঁচার উপায় নেই। প্রতিনিয়ত নানা সামাজিক-রাজনৈতিক নিম্নচাপ তৈরি হচ্ছে তাঁদের ঘিরে।

বাংলাদেশের চট্টগ্রামে সম্প্রতি আন্তসাম্প্রদায়িক উত্তেজনার সময়ই ভারতে শুরু হলো খাজা মইনুদ্দিন চিশতির দরগাহ নিয়ে হিন্দুত্ববাদীদের বিতর্ক। আগামী ৮১৩ ওরসের আগে এ রকম বিতর্ক বেশ শঙ্কায় ফেলেছে এই দরগাহের ভক্তদের। কেউ কেউ একে বাবরি মসজিদের মতো ভারতীয় সংখ্যালঘুদের ইবাদত-বন্দেগির আরেকটি জায়গা দখলের পরিকল্পিত অপচেষ্টাও বলছেন। তবে দখল-বেদখলের বাইরে হিন্দুত্ববাদীদের এসব ধারাবাহিক উদ্যোগে রয়েছে আরও বাড়তি রাজনৈতিক তাৎপর্য, যা আশপাশের সব দেশের সংখ্যালঘুদেরও বিপক্ষে যায় এবং যাচ্ছে।

কয়েক শ বছরের ঐতিহ্যের বিরুদ্ধে প্রশ্ন তোলা হলো

মইনুদ্দিন চিশতি দক্ষিণ এশিয়ায় ইসলামি ঐতিহ্যের সুপরিচিত এক বুজুর্গ। সুলতান-উল-হিন্দ এবং গরিবে নেওয়াজও বলা হয় এই সাধককে। চিশতিয়া তরিকার একজন গুরু তিনি। তাঁর অনুসারীদের মধ্যে বিখ্যাত কয়েকজন হলেন নিজামুদ্দিন আউলিয়া, বাবা ফরিদ, বখতিয়ার কাকী প্রমুখ। বখতিয়ার কাকি ছিলেন মইনুদ্দিন চিশতির পর চিশতিয়া তরিকার আধ্যাত্মিক ওস্তাদ।

বলা হয়, হজরত আবদুল কাদির জিলানী মইনুদ্দিন চিশতিকে দক্ষিণ এশিয়ায় গিয়ে ইসলাম প্রচার করতে বলেছিলেন। সেই সূত্রে পারস্যে পরিবারের যাবতীয় ধনসম্পদ গরিবদের মাঝে বিলিয়ে দক্ষিণ এশিয়ায় চলে আসেন তিনি। সর্বশেষ আজমিরে থিতু হন ৫২ বছর বয়সে। ১২৩৫ সালে এখানেই মারা যান। দিল্লিতে তখন শাসক ছিলেন শামসুদ্দিন ইলতুতমিশ।

ভক্তদের উদ্দেশে খাজা মইনুদ্দিনের শেষ অছিয়ত ছিল, ‘সবাইকে ভালোবাসো, কাউকে ঘৃণা করো না…নিজেকে ছাপিয়ে শান্তি আর আনন্দ বিলিয়ে দাও…।’ কিন্তু সেটা দক্ষিণ এশিয়ায় কীভাবে হতে পারে, খোদ মইনুদ্দিন চিশতির দরগাহকেই যখন সরাতে চাওয়া হচ্ছে?

‘হিন্দুসেনা’ নামের সংগঠন যা বলছে

মইনুদ্দিন চিশতির দরগাহ রাজ্যের হিসেবে রাজস্থানভুক্ত। তবে এটা ওয়াক্ফ স্থাপনা। সরকারকর্তৃক দরগাহ কমিটি এটা পরিচালনা করে। এদের বহু দাতব্য কাজ আছে; খাদেমরা আছেন সেসব দেখার জন্য। বর্তমানে দরগাহের দেওয়ান হলেন জয়নুল আবেদিন।

রজব মাসের প্রথম সপ্তাহে ছয় দিনব্যাপী ওরস হয় এখানে। দেশ-বিদেশ থেকে বাড়তি সংখ্যায় ভক্ত-অনুসারীরা আসেন তখন। এর বাইরেও প্রতিদিন বিপুলসংখ্যক ভক্ত আসেন এবং তাঁদের জন্য নিয়মিত অতিথিসেবাও হয়। বিশ্বের বহু জায়গা থেকে রাজনীতিবিদ ও শাসকেরা বহুকাল ধরে এই দরগাহে যাওয়া-আসা করছেন।

এর মধ্যেই সম্প্রতি ২৭ নভেম্বর ‘হিন্দুসেনা’ নামের সংগঠন রাজস্থানের আদালতে মামলা করে বলছে মইনুদ্দিন চিশতির দরগাহ আসলে একটা মন্দিরের ধ্বংসাবশেষের ওপর প্রতিষ্ঠিত। ‘সংকট মোচন মহাদেবের মন্দির’ নামে এই মন্দিরের একটা কল্পিত নামও হাজির করেছেন তাঁরা। অথচ প্রচলিত কাহিনি হলো ৮০০ বছর আগে এটা ছিল খোলা চত্বরমাত্র।

ওরসের ঐতিহ্য শুরুর পর থেকে নিয়মিত হিন্দু সম্প্রদায়ের অনেক মানুষও এখানে আসেন। সম্রাট হুমায়ুনের আমলে দরগাহ গড়ার কাজ শেষ হয়। কিন্তু হিন্দুসেনা মন্দিরের অস্তিত্বের দাবি তোলামাত্র রাজস্থান আদালত সেটা গ্রহণ করে বিভিন্ন জনকে এই দাবির বিপরীতে উত্তর দিতে নোটিশ জারি করে দিয়েছেন।

প্রায় এক যুগ আগে প্রতিষ্ঠিত হিন্দুসেনা সংগঠনটির এখনকার প্রধান বিষ্ণু গুপ্ত। তারাই একদা ডোনাল্ড ট্রাম্পের জন্মদিন উদ্‌যাপন করে এবং যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে তাঁর বিজয় কামনা করে প্রার্থনা সভার আয়োজন করেছিল। মূলত ট্রাম্পের মুসলমানবিরোধী কথাবার্তার জন্য তিনি সুদূর ভারতে হিন্দুসেনার কর্মীদের কাছে এত প্রিয়। ভারতে মোগলদের হাত থেকে শাসনদণ্ড কেড়ে এখানে সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার জন্য এই সংগঠন যুক্তরাজ্যের রাজপরিবারেরও নিয়মিতভাবে প্রশংসা করে। ইসরায়েল-হামাস যুদ্ধে এরা ইসরায়েলের পক্ষে যুদ্ধে মানবসম্পদ পাঠাতে চেয়েছিল।

২০২১ সালে হিন্দুসেনা দিল্লির অশোক রোডে মুসলমান রাজনীতিবিদ আসাদুদ্দিন ওয়াসির বাড়ি ভাঙচুর করে আরেক দফা শক্তি প্রদর্শন করে আলোচনায় আসে। সব মিলে হিন্দুসেনাকে একদম ভুঁইফোড় সংগঠন বলা যায় না।

গত বছরও দরগাহে চাদর দিয়েছিলেন নরেন্দ্র মোদি

মইনুদ্দিন চিশতির দরগাহর একটা প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো কেবল ওরসের সময় নয়, বছরজুড়ে এখানে বিভিন্ন ধর্মের মানুষ যান। দরগাহর এখনকার চাদরটি স্বয়ং ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর দেওয়া। এ বছর ১১ জানুয়ারি এ নিয়ে চারটি ছবি দিয়ে নরেন্দ্র মোদি ‘এক্স’ যোগাযোগমাধ্যমে টুইট করেছিলেন। সেটা এই লেখা তৈরির সময় পর্যন্ত ৬ হাজার ২০০ বার শেয়ার হয়েছে। মোদির টুইট সচরাচর বিজেপি কর্মী-সংগঠকেরাই শেয়ার করেন।

ঐতিহ্য মেনে প্রতিবছর ওরসের আগে ভারতের প্রধানমন্ত্রীরা একটা চাদর দেন দরগাহে। এ রকম সম্মান জানানোর অপর দিকটিও উল্লেখ করার মতো। দরগাহ কমিটি নরেন্দ্র মোদির জন্মদিনে ঐতিহাসিক ‘শাহি ডেগে’র রান্না করে কয়েক হাজার মানুষকে খাইয়েছিল গত ১৭ সেপ্টেম্বর।

এই দরগাহর এই শাহি ডেগের গল্পও বেশ মনকাড়া। এটিতে একসঙ্গে চার হাজার কেজি খাবার রান্না করা যায়। রাতভর যখন এ রকম রান্না চলে, তখন চারদিকে ভক্তরা ইবাদত-বন্দেগি করেন। তাতে গায়ক ও শ্রোতা হিসেবে থাকেন মুসলমান ছাড়াও ভিন্ন ধর্মের বিপুলসংখ্যক মানুষ। সম্রাট আকবর দরগাহে রান্নার জন্য এই ডেগ দিয়েছিলেন বলে কথিত আছে, ৫০০ বছর হলো যার বয়স। পরে সম্রাট জাহাঙ্গীর ছোট আয়তনের আরেকটি ডেগ দেন। ক্ষমতাসীন অবস্থায় আকবর প্রতিবছর সব ধর্মের প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের নিয়ে দরগাহে আসতেন।

বলাবাহুল্য, আজমিরের এই দরগাহ এবং তার শাহি ডেগে রান্না করে অতিথিসেবার সঙ্গে দিল্লি ও রাজস্থানের সামাজিক সম্প্রীতির ঐতিহ্য মিশে আছে। হিন্দুত্ববাদীদের অবশ্য সেসব পছন্দ নয় বলেই মনে হচ্ছে।

প্রচারে লস্কর-ই-তাইয়েবা, হামলায় আরএসএস কর্মীরা?

আজমির শরিফ নিয়ে হিন্দুত্ববাদীদের বিতর্ক তৈরির চেষ্টা এবারই প্রথম নয়। ২০০৭ সালেও এখানে পবিত্র রমজান মাসে ইফতারের সময় এক দফা হামলা হয়। তাতে সাতজন ভক্ত মারা যান। সেই মামলা প্রায় ১০ বছর ঝুলিয়ে শেষমেশ যখন দোষী ব্যক্তিদের শাস্তি দেওয়া হয়, তত দিনে কয়েকজন অপরাধীর স্বাভাবিক মৃত্যু হয়ে গেছে। মামলায় অভিযুক্ত দেবেন্দ্র গুপ্ত, সুনীল যোশী ও ভবেশ ভাই ছিলেন রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের (আরএসএস) সঙ্গে সম্পর্কিত।

এই মামলার তদন্তে দেখা গিয়েছিল উপরিউক্ত অভিযুক্ত ব্যক্তিরা হায়দরাবাদের মক্কা মসজিদসহ আরও অনেক স্থানে বোমা হামলায় জড়িত। অজ্ঞাত কারণে বিষয়টি ভারতীয় সংবাদমাধ্যমে খুব বেশি আলোচিত হয়নি। মক্কা মসজিদ হামলায় ১৬ ব্যক্তি মারা গিয়েছিলেন।

কৌতূহলোদ্দীপক দিক হলো, আজমির শরিফের ২০০৭-এর হামলার পরপর ভারতজুড়ে একে পাকিস্তানভিত্তিক লস্কর-ই-তাইয়েবার হামলা বলে হুলুস্থুল প্রচার চালানো হয়। পরে রাষ্ট্রীয় ন্যাশনাল ইনভেস্টিগেশন এজেন্সির তদন্ত ও বিচারে সাজা দিতে হয় আরএসএসের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিদের।

ভারতজুড়ে মুসলমান বুজুর্গদের কয়েক শ দরগাহ আছে এখনো। এসব নিয়ে হিন্দুত্ববাদীদের নানামুখী রাজনীতি আছে। বেশ কিছুদিন ধরে বিজেপি দরগাহকেন্দ্রিক ওয়াক্‌ফ বোর্ডগুলোতে অমুসলমানদের সংযুক্ত করতে চাইছে। মূলত এসব দরগাহর স্বায়ত্তশাসিত চরিত্র খর্ব করে এগুলোতে প্রভাব বিস্তারের লক্ষ্যে ওয়াক্‌ফ আইনের সংশোধন চায় সরকার।

এই মাসেই বিতর্কিত এ রকম একটা বিল লোকসভায় উঠবে। তারই আগে আজমির শরিফ নিয়ে বিতর্ক তৈরি হতে দেখা গেল। বিজেপি ওয়াক্ফ বোর্ডগুলোর প্রধানের পদ মুসলমানদের জন্য সংরক্ষণের বাধ্যবাধকতাও তুলে দিতে চায়।

মুসলমানরা যে কারণে শঙ্কিত

প্রশ্ন উঠতে পারে, মইনুদ্দিন চিশতির দরগাহ যদি একটা খোলা চত্বরে ধীরে ধীরে গড়ে উঠে থাকে, তাহলে হিন্দুসেনা সংগঠনের আদালতে যাওয়ায় এত উদ্বিগ্ন হওয়ার কী আছে?

আসলে বিষয়টা এত সরল-সোজা নয়। রাজস্থানের যে আদালতে এই আরজি তোলা হয়েছে, তারা সেটা গ্রহণ করে যে তিনটি পক্ষকে উত্তর দিতে নোটিশ করেছে, তার একটা ভারতের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ তথা আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়া (এএসআই)। এই প্রতিষ্ঠানকে ঘিরে মুসলমানদের উদ্বেগ আছে।

বাবরি মসজিদসহ ভারতের বিভিন্ন স্থানে মন্দির-মসজিদ বিতর্কে হিন্দুত্ববাদীরা সব সময় দ্রুত প্রত্নতত্ত্ববিদদের শামিল করতে চায়। এই বিভাগে হিন্দুত্ববাদী ভাবাদর্শের প্রচুর অনুসারী আছেন। এ রকম প্রত্নতত্ত্ববিদদের অনেকের কথাবার্তা অনুমাননির্ভর বলে অভিযোগ থাকলেও সেসব সমাজকে তাৎক্ষণিকভাবে প্রভাবিত করে। আদালতও তার দ্বারা প্রভাবিত হয়।

মুসলমান সম্প্রদায়ের জন্য দুর্বলতার আরেকটি দিক হলো বাবরি মসজিদ থেকে শুরু করে আজমির শরিফ পর্যন্ত বিতর্কে তাঁদের পক্ষে দাঁড়ানোর মতো প্রশাসক ও রাজনীতিবিদ–স্বল্পতা। ভারতে মুসলমান জনসংখ্যা অতিরিক্ত বাড়ছে বলে প্রায়ই হইচই হলেও সেই জনসংখ্যার জনপ্রতিনিধি একদম বাড়ছে না। জনসংখ্যার অনুপাতে লোকসভায় এবং বিভিন্ন রাজ্যের বিধানসভায় মুসলমানদের প্রতিনিধিত্ব একদম কম।

জনসংখ্যায় মুসলমানদের হিস্যা ১৪ ভাগের বেশি হলেও লোকসভায় তাদের সংখ্যা ৫ শতাংশও নয় (২৪ জন)। শাসক দল বিজেপির সংসদ সদস্য তালিকায় মুসলমান কেউ নেই। স্বভাবত জাতীয় সিদ্ধান্তের আগে বিজেপির ওপর মহলে এবং লোকসভায় মুসলমানদের ইস্যুগুলো তাদের স্বার্থের জায়গা থেকে ব্যাখ্যা করার কাঠামোগত সুযোগ অনুপস্থিত।

যে রাজস্থানে বর্তমানে আজমির শরিফ নিয়ে বিতর্ক তোলা হয়েছে, সেখানে মুসলমান আছে ১০ ভাগ। লোকসভার এ রাজ্য থেকে সদস্য ২৫ জন। অথচ বিজেপি বা কংগ্রেস কেউ গত লোকসভায় এখানে কোনো মুসলমানকে প্রার্থী করেনি।

১৯৫২ থেকে গত সাত দশকে যত লোকসভা নির্বাচন হয়েছে, রাজস্থান থেকে মাত্র দুজন মুসলমান লোকসভায় যেতে পেরেছেন। রাজস্থানের বিধানসভাতেও মুসলমান সদস্য ৫ শতাংশের কম। ১০ ভাগের বেশি মুসলমান থাকার পরও লোকসভায় এত কম প্রতিনিধিত্বের নজির ভারতের আর কোনো রাজ্যে নেই।

ফলে কেবল আজমিরের দরগাহ ইস্যু নয়, স্থানীয় মুসলমানদের অধিকাংশ বিষয়ে কথা বলার মতো নিজস্ব নেতার ঘাটতি পড়েছে এখানে; যদিও আজমির দরগাহর বিষয়টা কেবল মুসলমানদের ইস্যু নয়। এর পেছনে জাতীয় রাজনীতিরও প্রবল যোগ আছে। এ রকম বিতর্ক তৈরি করে হিন্দুত্ববাদীরা এখানকার সমাজকে ভবিষ্যতে এমনভাবে আরও ভাগ করতে চাইছে যে কংগ্রেসের মতো দলগুলো স্থানীয় নির্বাচনেও যাতে মুসলমানদের আর মনোনয়ন না দেয়। এতে মুসলমান ভোট ব্যাংক হয়তো কালে কালে কংগ্রেসের চৌহদ্দি ছেড়ে চলে যাবে—এমনটিই ভাবে বিজেপির কৌশলবিদেরা।

বাবরি মসজিদের জায়গায় রামমন্দির নির্মাণের পরও উত্তর প্রদেশে লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি ভালো না করায় অনেকে ভেবেছিলেন এ ধরনের কৌশল থেকে আরএসএস পরিবার হয়তো সরে আসবে। কিন্তু কার্যত তা হয়নি। আজমির শরিফ ছাড়াও আরও কয়েকটি মসজিদ নিয়ে একের পর এক বিতর্ক তোলার মাধ্যমে আরএসএসের বিভিন্ন অঙ্গসংগঠন মুসলমানবিরোধী প্রচার আন্দোলন চালু রাখার ইঙ্গিত দিচ্ছে।

তারা মনে করছে, উত্তর প্রদেশে রামমন্দির বানিয়েও জাতীয় নির্বাচনে সেখানে খারাপ করার কারণ হলো বিজেপি-আরএসএস অন্তর্দ্বন্দ্ব; বরং ভোট ও আসন যা পাওয়া গেছে, সেটা হিন্দুত্ববাদ ও মুসলমানদের চাপে রাখার কৌশলের মাধ্যমেই। তা ছাড়া আরএসএস পরিবার দেশজুড়ে মসজিদ ও দরগাহগুলো নিয়ে যে বিতর্ক জারি রাখতে চায়, সেটা তাদের তথাকথিত ‘ইতিহাস পুনর্নির্মাণ’ কর্মসূচিরও দরকারি জায়গা।

দক্ষিণ এশিয়ায় হিন্দুরাষ্ট্র কায়েম করতে হিন্দুত্ববাদী একটা পূর্ণাঙ্গ বয়ান তৈরি এবং মুসলমানদের ‘দখলদার’ দেখানোর প্রকল্প থেকে বাবরি মসজিদের পর বারানসিতে জ্ঞানবাপি মসজিদ নিয়েও বিতর্ক তোলা হয়। সর্বশেষ শুরু হলো আজমির শরিফ নিয়ে।

হিন্দুত্ববাদী রাজনৈতিক সংগঠনগুলো বরাবরই বিশ্বজুড়ে হিন্দুদের সুরক্ষাকারী হিসেবে নিজেদের দেখায়। অথচ ভারতের ভেতরে অন্য ধর্মাবলম্বীদের ধর্মীয় ও নাগরিক স্বাধীনতার বিষয়ে তাদের অসহিষ্ণুতা যে অন্যান্য দেশে অপর ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে হিন্দুদের প্রতি বৈরিতা বাড়ায়, সেটা তারা অগ্রাহ্য করছে। এভাবে বিশেষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় অতি ঘনবসতির দক্ষিণ এশিয়ায় সব সম্প্রদায়ের একসঙ্গে বসবাসের অতি দরকারি সংস্কৃতি।

  •  আলতাফ পারভেজ ইতিহাস গবেষক