মতামত

রাজনৈতিক সংকট আরও ঘনীভূত হবে

২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারি বাংলাদেশে আরেকটি ‘একতরফা’ নির্বাচন হয়ে গেল। ২০১৪ সালের নির্বাচনটিও একতরফা ছিল, কিন্তু ২০১৮ সালের নির্বাচন সব দলের অংশগ্রহণমূলক হওয়া সত্ত্বেও নির্বাচনটি প্রহসনে পরিণত করেছিল ক্ষমতাসীনদের কারসাজিতে।

ফলে সংসদের তিন-চতুর্থাংশের বেশি আসন ক্ষমতাসীন জোটের দখলে চলে যাওয়ার পাশাপাশি বিরোধী দলগুলোর ৯৬ শতাংশ প্রার্থীর জামানত বাজেয়াপ্ত হয়ে গিয়েছিল। ক্ষমতাসীনেরা এই অভূতপূর্ব কারচুপির মাধ্যমে প্রমাণ করে দিয়েছিল যে ক্ষমতাসীন দলকে সরকারে রেখে এ দেশে সুষ্ঠু নির্বাচন হবে না। 

৭ জানুয়ারির নির্বাচনটি গ্রহণযোগ্যতা না পেলেও এর সাংবিধানিক বৈধতা থাকবে। ক্ষমতাসীন সরকারের অধীন অনুষ্ঠিত নির্বাচন এ দেশে ১৯৭৩ সাল থেকেই প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে আসছিল। এবারের নির্বাচনটা আবারও ক্ষমতাসীন সরকারের অধীন হওয়ায় বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলো বর্জন করেছে।

নির্বাচনে ভোট সম্পন্ন হয়ে ফলাফল ঘোষিত ২৯৮টি আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগ ২২৩টি আসনে জয়ী হয়েছে। কিন্তু ৬২ জন স্বতন্ত্র প্রার্থী, যাঁরা জয়ী হয়েছেন, তাঁদের মধ্যে ৬ জন ছাড়া ৫৬ জন আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী হওয়ায় ২৭৮টি আসনে আওয়ামী লীগই বিজয়ী হয়েছে বলা চলে।

নির্বাচনের দিন বেলা তিনটায় নির্বাচন কমিশন ঘোষণা করেছিল তখন পর্যন্ত ২৭ শতাংশের মতো ভোট পড়েছে, যেটাকে বিশ্বাসযোগ্য মনে হয়নি। ভোটের পর এখন তারা বলছে নির্বাচনে ৪১ দশমিক ৮ শতাংশ ভোট পড়েছে। শেষের ১ ঘণ্টায় ১৪ শতাংশের মতো বৈধ ভোট পড়ার বিষয়টি অবিশ্বাস্য! 

এবারের একতরফা নির্বাচনে ভোটার বাড়ানোর জন্য আওয়ামী লীগের নেতাদের ‘স্বতন্ত্র প্রার্থী’ হওয়ার জন্য উৎসাহিত করা হয়েছিল। নিঃসন্দেহে এ কৌশল ফলপ্রসূ হয়েছে। তবে সংবাদমাধ্যমের কল্যাণে দেখা গেল, অনেক অঞ্চলে প্রায় সারা দিন ভোটের কেন্দ্রগুলো জনবিরল ছিল। ২০০৮ সালের নির্বাচনে যে দীর্ঘ ভোটার লাইন দেখা গিয়েছিল, এবার তার ছিটেফোঁটাও দেখা যায়নি। প্রকাশিত ফলাফল থেকেও দেখা যাচ্ছে, যেসব আসনে কারসাজি হয়নি, সেখানে ভোটের অনুপাত ২০ শতাংশের আশপাশে ছিল। 

বিশেষত, ঢাকা নগরী ও আশপাশের জেলাগুলোয় এ রকম ভোটার অনুপাত দেখা যাচ্ছে। কিন্তু দেড় থেকে আড়াই লাখ বা তারও বেশি ভোট যেসব প্রার্থী পেয়েছেন, সেখানে সুষ্ঠু ভোট হয়েছে কি না, সেটি দেখার বিষয়।

দলীয় সরকারের অধীন নির্বাচন কখনোই ‘নৈতিক গ্রহণযোগ্যতা’ পাবে না এ দেশে। এ ধরনের নির্বাচন আওয়ামী লীগের ক্ষমতাকে দীর্ঘায়িত করতে পারছে বারবার, কিন্তু জনগণের কাছে সরকার পরিবর্তনের কোনো বৈধ সুযোগ বা সাংবিধানিক অধিকার থাকছে না

ভোটকেন্দ্রগুলোয় দায়িত্বরত প্রিসাইডিং কর্মকর্তা, পোলিং কর্মকর্তা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পক্ষ থেকে ক্ষমতাসীন দলের কর্মীদের মোকাবিলা করার সাহস দেখানো মানে তাঁদের চাকরির জন্য নিশ্চিত বিপদ ডেকে আনা। তাই ক্ষমতাসীন দলের অধীন নির্বাচন হলে ভোট নিয়ে অনিয়ম চলতেই থাকবে। 

নির্বাচনী অনিয়ম ও কারচুপির এই সংস্কৃতি থেকে মুক্তিলাভের উদ্দেশ্যেই ১৯৯৬ সালে সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী পাস করে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার অধীন নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা চালু হয়েছিল। ১৯৯৬ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার আইন পাস হওয়ার পর ১৯৯৬, ২০০১ ও ২০০৮ সালের তিনটি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীন। কিন্তু ১৯৯১ থেকে ২০০৮ সালের নির্বাচন পর্যন্ত চারটি নির্বাচনেই বাংলাদেশের জনগণ ক্ষমতাসীন দল বা জোটকে প্রত্যাখ্যান করেছিল। 

এরপরও দুঃখজনক হলো, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ‘পরিকল্পিত ম্যানিপুলেশনের’ শিকার হয়েছে ১৯৯৬, ২০০১ ও ২০০৬-২০০৮ সালে। ১৯৯৬ সালের জুনের নির্বাচনটি অবাধ ও নিরপেক্ষ হয়েছিল বলে দেশে-বিদেশে বহুল প্রশংসিত হলেও পরাজয় মেনে নেয়নি বিএনপি।

২০০১ সালে বিচারপতি লতিফুর রহমান যখন নিশ্চিত হয়ে গেলেন যে তিনিই প্রধান উপদেষ্টা হতে যাচ্ছেন, তখন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ক্ষমতা গ্রহণের মাসখানেক আগেই তিনি তাঁর ‘হোমওয়ার্ক’ শুরু করে দেন।

আলোচনায় আছে, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কয়েকজন উপদেষ্টাও তাঁর ওই হোমওয়ার্কে অংশগ্রহণ করেছেন আনুষ্ঠানিক দায়িত্ব লাভের আগেই। দুই মাসের কম সময়ে ১ হাজার ৫২৬ জন কর্মকর্তার বদলি সুসম্পন্ন করার কাহিনি পরবর্তী সময়ে তাঁদের কয়েকজনের পত্রপত্রিকায় দেওয়া জবানিতেই খোলাসা হয়ে গেছে। এরপর বিএনপির দাবি মেনে ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা দিয়ে সেনাবাহিনী মোতায়েন করা হয় সারা দেশে। 

সেনাবাহিনী মাঠে গিয়ে ধাওয়া দিল আওয়ামী লীগের মাস্তান-পাতিমাস্তান-ক্যাডারদের, পালিয়ে বাঁচল বীর-পুঙ্গবরা। কিন্তু আওয়ামী ‘দুষ্টলোকদের’ খালি করা মাঠ যে বিএনপি-জামায়াতের ক্যাডার ও মাস্তানরা দখল করে নিয়েছিল, ওই সত্যটাও এত দিনে খোলাসা হয়ে গেছে। ১৯৯৬ ও ২০০১ সালে ক্ষমতাসীন দলের নির্বাচনী বিপর্যয়ের মাধ্যমে প্রমাণ হয়ে গিয়েছিল যে চরিত্রগতভাবেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা ক্ষমতাসীন দলবিরোধী (অ্যান্টি-ইনকামবেন্সি) হয়ে গেছে।

বিএনপির প্রাথমিক পর্যায়ের আন্তর্জাতিক সম্পাদক বিচারপতি কে এম হাসানকে পুরস্কার হিসেবে হাইকোর্টে বিচারপতি করা হয়েছিল বলে আলোচনায় আছে। তাঁকেই ২০০৬ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা করার অঙ্ক কষে বিএনপির ‘চাণক্য-প্রবররা’ সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদের অবসর গ্রহণের বয়স ২ বছর বাড়িয়ে ৬৭ বছর নির্ধারণ করে দিয়েছিল।

এই ‘অতিচালাকি’ জনগণের কাছে ধরা পড়ে যায় এবং শুরু হয় হাসানবিরোধী আন্দোলন-সংগ্রাম। আন্দোলনের তীব্রতা উপলব্ধি করে ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর দুপুরেই বিচারপতি হাসান প্রধান উপদেষ্টা হওয়ার ব্যাপারে তাঁর অসম্মতি জানিয়ে দেন রাষ্ট্রপতিকে। 

এরপর সংবিধানের তত্ত্বাবধায়ক সরকারসংক্রান্ত বিধান অনুসারে বিচারপতি মাহমুদুল আমিন চৌধুরীকে প্রধান উপদেষ্টা হওয়ার অনুরোধ না জানিয়ে রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন নিজেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হয়ে যান। এমন একটি অস্বস্তিকর পরিস্থিতিতে চারজন উপদেষ্টা পদত্যাগ করায় নতুন চার উপদেষ্টা নিয়োগ করে রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন ২০০৭ সালের ২২ জানুয়ারি একতরফা নির্বাচন করতে এগিয়ে যান।

 ২০১০ সালে সুপ্রিম কোর্ট রায় ঘোষণা করলেন অনির্বাচিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার অসাংবিধানিক, কিন্তু আরও দুটি নির্বাচন ওই ব্যবস্থায় হতে পারে। সুযোগ বুঝে ২০১১ সালে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থাই বাতিল করে দিল ক্ষমতাসীন দল।

তখন থেকেই বিরোধী দলগুলো তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার পুনর্বহালকে আন্দোলন-সংগ্রামের মূল দাবিতে পরিণত করে আসছে। তাদের সেই আন্দোলন–সংগ্রাম এবং যুক্তরাষ্ট্রসহ বিদেশিদের বিরোধিতাকে তোয়াক্কা না করে চলতি বছরের ৭ জানুয়ারি আওয়ামী লীগ আরেকটি নির্বাচন করে ফেলল। বোঝা প্রয়োজন, গণ-অভ্যুত্থানে বাধ্য না হলে কোনো সরকার তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা চালু করবে না। জেনেশুনে পরবর্তী নির্বাচনে নিশ্চিত পরাজয় কি কোনো সরকার চাইতে পারে? 

অথচ দলীয় সরকারের অধীন নির্বাচন কখনোই ‘নৈতিক গ্রহণযোগ্যতা’ পাবে না এ দেশে। এ ধরনের নির্বাচন আওয়ামী লীগের ক্ষমতাকে দীর্ঘায়িত করতে পারছে বারবার, কিন্তু জনগণের কাছে সরকার পরিবর্তনের কোনো বৈধ সুযোগ বা সাংবিধানিক অধিকার থাকছে না। 

ড. মইনুল ইসলাম অর্থনীতিবিদ ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক