যাঁরা নৈতিকভাবে দেউলিয়া, তাঁরাই গাজায় নির্বিচার হত্যার পক্ষে

‘বেসামরিক জনগণের জীবনকে তোয়াক্কা না করে চলা ইসরায়েলের যেকোনো সামরিক অভিযান উল্টো ফল বয়ে আনতে পারে।’
ছবি: রয়টার্স

ইসরায়েলে হামাসের হামলায় নিরপরাধ নারী, শিশু ও বৃদ্ধসহ ১ হাজার ৪০০ মানুষ নিহত হওয়ার পর ১৭ দিন পেরিয়ে গেছে। এই অবর্ণনীয় বর্বরতার পর মার্কিন সরকারের মতো দেশের নাগরিকেরাও ভুক্তভোগীদের সঙ্গে শোকে একাত্ম হয়েছেন, স্বজনদের ফিরে আসার প্রত্যাশায় প্রার্থনা করেছেন এবং ইসরায়েলি জনগণের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করেছেন।

এর আগের পোস্টে আমি বলেছিলাম, এমন বেপরোয়া সহিংসতা থেকে জনগণকে সুরক্ষা দেওয়ার অধিকার ইসরায়েলের রয়েছে। হামাসের বিরুদ্ধে ইসরায়েলের অভিযানে সমর্থন দিতে প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের যে আহ্বান, আমি তার সঙ্গে একমত। যুক্তরাষ্ট্রের দীর্ঘকালীন মিত্র ইসরায়েল হামাসের সামরিক সক্ষমতাকে গুঁড়িয়ে দিতে এবং শত শত জিম্মিকে উদ্ধার করে তাঁদের পরিবারের কাছে ফিরিয়ে দিতে চায়।  

কিন্তু এত সমর্থনের পরও ইসরায়েল হামাসের বিরুদ্ধে যে যুদ্ধকৌশল ব্যবহার করছে, সে সম্পর্কে আমাদের পরিষ্কার ধারণা থাকা উচিত। বিশেষ করে, প্রেসিডেন্ট বাইডেন যে কথাটি বারবার জোর দিয়ে বলার চেষ্টা করেছেন, ইসরায়েলের সামরিক কৌশল যেন আন্তর্জাতিক আইন মেনে চলে, যে আইনে বেসামরিক জনগোষ্ঠীর মৃত্যু বা নির্যাতন যত দূর সম্ভব এড়িয়ে যাওয়ার কথা বলা হয়েছে। নৈতিকতার স্বার্থে এবং মানুষের জীবনের যে মূল্য আছে, সেই মূল্যবোধকে তুলে ধরা অত্যন্ত জরুরি। এই মূল্যবোধের ওপর ভিত্তি করে আমরা মৈত্রী গড়ি এবং মূল্যবোধের ভিত্তিতেই আন্তর্জাতিক ইস্যুতে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি কি তার প্রকাশ ঘটে। এদিকে নজর দেওয়া জরুরি ইসরায়েলের দীর্ঘমেয়াদি নিরাপত্তার জন্যই।    

এটা একটা অত্যন্ত জটিল কাজ। যুদ্ধ সব সময় দুঃখজনক এবং কখনো কখনো অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে সামরিক অভিযানের পরিকল্পনা করা হলেও বেসামরিক নাগরিকেরা ঝুঁকিতে পড়েন। প্রেসিডেন্ট বাইডেন ইসরায়েলে তাঁর সাম্প্রতিক অভিযানে একটা কথা বলেছিলেন যে, আমেরিকা নিজেও যুদ্ধের সময় তার উচ্চ মানবিক মূল্যবোধ ঠিক রাখতে পারেনি।

যাদের সঙ্গে আমরা একমত নই, তাদের নিকৃষ্ট ভাবা উচিত নয়। এই অন্তহীন বিদ্বেষ, ট্রল আর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অপতথ্য/ভুয়া তথ্যের কালে, অনেক রাজনীতিক ও দৃষ্টি আকর্ষণকারীরা আলোর চেয়ে তাপ ছড়াতে ব্যস্ত। এই রক্তাক্ত সময়ে দাঁড়িয়ে ভদ্রোচিত সংলাপের আশা করা হয়তো অবান্তর। কিন্তু আমরা যদি ইসরায়েলি ও ফিলিস্তিনি শিশু ও আমাদের নিজেদের সন্তানদের শান্তি, নিরাপত্তা ও  মর্যাদা নিশ্চিত করতে চাই, তাহলে দায় আমাদের।

৯/১১-এর পর যুক্তরাষ্ট্র আল-কায়েদার বিরুদ্ধে অভিযানে এমনকি মিত্রদের পরামর্শও কানে তোলেনি। এখন যখন হামাস ইসরায়েলি নাগরিকদের নির্বিচার খুন করেছে, তখন ইহুদিদের ওপর অতীতে সংঘটিত বর্বরতার স্মৃতি মনে করে শিহরিত হচ্ছেন অনেকেই। বুঝতে কষ্ট হয় না, অনেক ইসরায়েলি আর যেন এমন ঘটনা না ঘটে, তা নিশ্চিত করতে হামাসকে নিশ্চিহ্ন করার দাবি করছেন। এদিকে হামাসের সামরিক কার্যক্রম গাজায় কেন্দ্রীভূত। তাদের নেতারা বেসামরিক জনগোষ্ঠীর মধ্যে মিশে আছে। যে মানুষগুলোকে তারা প্রতিনিধিত্ব করে বলে দাবি করে, তাদের প্রত্যেককে এভাবে ঝুঁকিতে ফেলেছে হামাস।  

এই অঞ্চল যেদিকে এগোচ্ছে, গোটা বিশ্ব তার দিকে নজর রাখছে। বেসামরিক জনগণের জীবনকে তোয়াক্কা না করে চলা ইসরায়েলের যেকোনো সামরিক অভিযান উল্টো ফল বয়ে আনতে পারে। গাজায় বোমা হামলায় হাজার হাজার ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। তাঁদের অনেকে শিশু। লাখো মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছেন। ইসরায়েল সরকার অবরুদ্ধ সাধারণ মানুষের খাবার, পানি ও বিদ্যুৎ বন্ধ করে দিয়ে শুধু মানবিক সংকটকে বাড়িয়ে তোলেনি, প্রজন্মের পর প্রজন্ম ফিলিস্তিনিরা আরও কঠোর হবে, ইসরায়েলের প্রতি বৈশ্বিক সমর্থন কমবে, ইসরায়েলের শত্রুদের হাত আরও শক্তিশালী হবে এবং মোটের ওপর এই অঞ্চলের শান্তি ও স্থিতিশীলতা অর্জনের যে উদ্যোগ, তার অবমূল্যায়ন হবে।

আমরা যারা ইসরায়েলকে সমর্থন দিচ্ছি, তাদের জন্য এখন গুরুত্বপূর্ণ সময়। হামাসকে শক্তিহীন করতে ইসরায়েলকে যেকোনো কৌশল গ্রহণে আমরা উৎসাহ দেব, তেমনি বেসামরিক জনগণের প্রাণহানি ঠেকাতেও আমাদের উৎসাহ দিতে হবে। বাইডেন প্রশাসনের দূতিয়ালিতে ইসরায়েল গাজায় ত্রাণবাহী ট্রাক প্রবেশের অনুমতি দিয়েছে। এই উদ্যোগ প্রশংসনীয়।

গাজার দিশাহারা মানুষের কাছে জরুরি ত্রাণসহায়তা পৌঁছানোর কাজ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে অব্যাহত রাখতে হবে। আর যদিও এখন ইতিবাচক ভবিষ্যতের আশা দুরাশা, তবুও আমরা গুরুত্বপূর্ণ দেশগুলোর সঙ্গে কথা বলতে পারি। ইসরায়েলের টিকে থাকার অধিকার আছে, এমন বক্তব্যের সঙ্গে একমত ফিলিস্তিনি নেতা ও সংগঠনগুলোর সঙ্গে তারা বসতে পারে। ফিলিস্তিনিদের জাতিগত আত্মনিয়ন্ত্রণের যে বৈধ অধিকার, তা নিশ্চিতে তাঁরা একটা গ্রহণযোগ্য পথ খুঁজে পেতে পারেন। ইসরায়েলি এবং ফিলিস্তিনি পরিবাররা যে শান্তি ও নিরাপত্তা খুঁজছে, তা নিশ্চিতে এটাই সবচেয়ে ভালো উপায়।  

যেখানে বেদনার্ত মানুষের সংখ্যাটি বড়, ধরে নিতে হবে যেখানে আবেগের তাড়নাও গভীর। এটাই স্বাভাবিক। তবু আমাদের প্রত্যেকের উচিত ভয়ভীতির ঊর্ধ্বে উঠে মানবিক মূল্যবোধের সর্বোচ্চ প্রকাশ ঘটানো।

এর অর্থ ইহুদি বিদ্বেষকে সর্বত্র না বলা। এর অর্থ ইসরায়েলিরা যে যন্ত্রণা সহ্য করছে, তার জবাব শুধু সাধারণ মানুষকে নির্বিচারে হত্যার মধ্যেই এমন অবস্থানকে যাঁরা যৌক্তিক বলছেন, তাঁদের না বলা। কারণ যাঁরা নৈতিকভাবে দেউলিয়া, কেবল তাঁরাই এমন পরামর্শ দিতে পারেন।  

এর অর্থ মুসলিম, আরব ও ফিলিস্তিনবিরোধী মনোভাবকে প্রত্যাখ্যান করা। এর অর্থ ফিলিস্তিনিদের হামাস ও অন্যান্য সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর সঙ্গে গুলিয়ে ফেলা; গাজার মানুষকে অমানুষ বলে অভিহিত করার চেষ্টা, অথবা ফিলিস্তিনিদের যন্ত্রণা, সেটা গাজায় হোক অথবা পশ্চিম তীরে, তাকে ছোট করে দেখাকে না বলা। তাদের প্রতি এই মনোভাব অপ্রাসঙ্গিক, অবৈধ।

এর অর্থ ইসরায়েলের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার অধিকার আছে এই অবস্থানের স্বীকৃতি দেওয়া। ইহুদিরা যে ভূমিতে ঐতিহাসিকভাবে তাদের শিকড় প্রোথিত আছে বলে দাবি করে, সে ভূমিতে বসত গড়ার অধিকারকে হ্যাঁ বলা। এমন উদাহরণও আছে অতীতে ইসরায়েল সরকার অর্থবহ উদ্যোগ নিয়ে বিরোধ মিটিয়ে দুই-রাষ্ট্র গঠনে সমাধান খুঁজেছে। যে সমাধান আবার অন্য কোনো পক্ষ প্রত্যাখ্যান করেছে।  

এর অর্থ স্বীকার করে নেওয়া যে ফিলিস্তিনিরা বিতর্কিত অঞ্চলগুলোয় প্রজন্মের পর প্রজন্ম বাস করেছেন। ইসরায়েল গঠনের পর তাঁদের অনেকেই বাস্তুচ্যুত হয়েছেন। এখনো বসতি স্থাপনকারীরা তাঁদের জোর করে ভূমি থেকে উচ্ছেদ করছে। আর তাতে ইসরায়েলি সরকার কখনো পরোক্ষ, কখনো প্রত্যক্ষ সমর্থন দিয়েছে। ফিলিস্তিনি নেতা যাঁরা দুই রাষ্ট্র গঠনে ছাড় দিতে প্রস্তুত ছিলেন, তাঁদের কেউ উদ্যোগ শুরুই করতে পারেননি। ইহুদিবিদ্বেষী না হয়েও পশ্চিম তীর ও গাজায় ইসরায়েলি সরকার যা করেছে, তার বিরোধিতা করা সম্ভব। যারা ভালো মানুষ, তাদের পক্ষে ফিলিস্তিনিদের অধিকারের পক্ষে সরব হওয়া সম্ভব।

যাদের সঙ্গে আমরা একমত নই, তাদের নিকৃষ্ট ভাবা উচিত নয়। এই অন্তহীন বিদ্বেষ, ট্রল আর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অপতথ্য/ভুয়া তথ্যের কালে, অনেক রাজনীতিক ও দৃষ্টি আকর্ষণকারীরা আলোর চেয়ে তাপ ছড়াতে ব্যস্ত। এই রক্তাক্ত সময়ে দাঁড়িয়ে ভদ্রোচিত সংলাপের আশা করা হয়তো অবান্তর। কিন্তু আমরা যদি ইসরায়েলি ও ফিলিস্তিনি শিশু ও আমাদের নিজেদের সন্তানদের শান্তি, নিরাপত্তা ও  মর্যাদা নিশ্চিত করতে চাই, তাহলে দায় আমাদের। আমাদের কথা ও কাজই নির্ধারণ করে দেবে কেমন পৃথিবী তারা উত্তরাধিকার সূত্রে পেতে যাচ্ছে।  

  • বারাক ওবামা সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট

থটস অন ইসরায়েল অ্যান্ড গাজা শিরোনামে ওবামার এই লেখাটি ‘মিডিয়াম’-এ প্রকাশিত। তিনি তাঁর এক্স হ্যান্ডেলে লেখাটি শেয়ার করেছেন।