চট্টগ্রাম বন্দর: ঘরের চাবি কি পরের হাতে তুলে দেওয়া হচ্ছে

চট্টগ্রাম বন্দরের পতেঙ্গা কনটেইনার টার্মিনালটি (পিসিটি) পরিচালনার ভার বিদেশি অপারেটরের হাতে দেওয়ার সরকারি সিদ্ধান্ত নিয়ে নানামুখী আলোচনা-সমালোচনা চলছে। সৌদি আরবের রেড সি গেটওয়ে টার্মিনালকে অপারেটর নিয়োগ করার নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপ (পিপিপি) অথরিটি এ বিষয়ে সব ধরনের প্রক্রিয়া সম্পন্ন করেছে বলেও জানা গেছে। কিন্তু এ উদ্যোগের যথার্থতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে একটি পক্ষ।

সম্প্রতি অনুষ্ঠিত এক গোলটেবিল বৈঠকে একজন বক্তা ‘ঘরের চাবি পরের হাতে তুলে দেওয়া হচ্ছে’ দাবি করে বলেন, ‘এখন বলা হচ্ছে, দুটি টার্মিনাল বিদেশি অপারেটরের হাতে দেওয়ার কথা। আস্তে আস্তে পুরো বন্দর তাদের নিয়ন্ত্রণে চলে যাবে। তখন বিদেশ থেকে আর স্যাংশন দিতে হবে না, এই বিদেশি অপারেটররাই স্যাংশন দিয়ে দেবে। এই বিদেশিরা যদি তেলের জাহাজ এক মাস অপারেট না করে, ভোগ্যপণ্যের জাহাজ সাগরে ভাসিয়ে রাখে, তাহলে দেশের পরিস্থিতি কী হবে, ভাবতে হবে।’

তবে এ ধরনের বক্তব্যকে ‘অহেতুক আশঙ্কা’ উল্লেখ করে বন্দর ব্যবহারকারী ব্যবসায়ীরা বলছেন, বিদেশি প্রতিষ্ঠান মানেই ‘ষড়যন্ত্র’, এই প্রাচীন ধারণা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। দেশে এখন বহু বিদেশি প্রতিষ্ঠান তাদের কর্মকাণ্ড পরিচালনা করছে, তারা মুনাফা করছে এবং সরকারকে প্রাপ্য রাজস্ব বুঝিয়ে দিচ্ছে। এতে কর্মসংস্থানের সুযোগও সৃষ্টি হচ্ছে।

দেশে বিভিন্ন অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তুলে সরকার যেখানে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আহ্বান জানাচ্ছে, সেখানে একটি বিদেশি প্রতিষ্ঠান বন্দরের টার্মিনাল পরিচালনার দায়িত্ব পেলেই আমাদের দেশের স্বার্থবিরোধী কর্মকাণ্ড শুরু করবে, এমন ভাবনার কোনো ভিত্তি নেই। বরং বিদেশি দক্ষ অপারেটর নিয়োগের ফলে চট্টগ্রাম বন্দরে প্রতিযোগিতা ও গতিশীলতা বাড়বে, সেবার মান বাড়বে বলে মনে করেন ব্যবসায়ীরা। পৃথিবীর অধিকাংশ দেশে বন্দরের টার্মিনাল পরিচালনার ভার যে বন্দর কর্তৃপক্ষ বা রাষ্ট্র নিজের হাতে রাখে না, উদাহরণটিও এখানে আসছে।

পিসিটি টার্মিনাল পরিচালনার ভার সৌদি প্রতিষ্ঠানকে দেওয়ার পাশাপাশি নিউমুরিং টার্মিনালটিও (এনসিটি) একটি দুবাইভিত্তিক প্রতিষ্ঠানকে দেওয়ার প্রক্রিয়ায়। আসলে দুটি বিষয় এখানে বিশেষভাবে আমলে নেওয়া হচ্ছে। একটি হচ্ছে আর্থিক সামর্থ্য, অন্যটি হচ্ছে দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা। যেমন ইতিপূর্বে পিসিটি পরিচালনার জন্য যন্ত্রপাতি ক্রয়বাবদ দুই হাজার কোটির বেশি টাকার প্রয়োজন হবে বলে বন্দর কর্তৃপক্ষ নিজেরা এটি পরিচালনার দায়িত্ব থেকে সরে এসেছে।

আর দক্ষতা ও প্রতিযোগিতার বিষয়টি সম্পর্কে বন্দর চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল মোহাম্মদ শাহজাহান সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘বর্তমানে কেবল দেশীয় প্রতিষ্ঠান টার্মিনাল পরিচালনা করছে। ফলে তাদের ইচ্ছা অনুযায়ী চার্জ আদায় করছে। বিদেশি প্রতিষ্ঠান কাজ শুরু করলে দেশীয় প্রতিষ্ঠানের সক্ষমতা যাচাইয়ের সুযোগ থাকবে।’ তাঁর বক্তব্যের সঙ্গে দ্বিমত করার বিশেষ কিছু নেই, তবে একটি বিষয়ে সবাই প্রায় একমত, তা হচ্ছে বিদেশি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তির বিষয়ে স্বচ্ছতা, দেশের স্বার্থ নিয়ে দর-কষাকষির ব্যাপারে যোগ্যতা ও আন্তরিকতা থাকা দরকার।

দর-কষাকষি নিয়ে স্বচ্ছতা, দক্ষতা বা আন্তরিকতার প্রশ্নটি আসছে। কারণ, আমাদের এ বিষয়ে তিক্ত অভিজ্ঞতা আছে। ২০০০ সালে স্টিভিডোর সার্ভিসেস অব আমেরিকার (এসএসএ) সঙ্গে একটি অসম চুক্তির মাধ্যমে বন্দরের কনটেইনার টার্মিনাল তাদের হাতে তুলে দেওয়ার চুক্তি রুখে দিয়েছিলেন চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের তৎকালীন মেয়র মহিউদ্দিন চৌধুরী।

নির্মাণের পর ২০০ বছর পর্যন্ত এর মালিকানা এসএসএ ভোগ করবে—এমন একটি চুক্তি সম্পাদিত হতে যাচ্ছিল তখন। কিন্তু নিজের দল আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকা সত্ত্বেও মহিউদ্দিন চৌধুরীর কালাপাহাড়ি মনোভাব ও সচেতন নাগরিকদের আন্দোলনের কারণে সেই এসএসএ-ই প্রথমে ৯৯ বছর এবং পরে ৩৩ বছর মালিকানা পেলেও চুক্তি সই করতে সম্মত হয়ে প্রমাণ করেছিল জেনে বা না জেনে কত বড় ভুল করতে যাচ্ছিল সরকার। শেষ পর্যন্ত অবশ্য উচ্চ আদালতের রায়ে এসএসএর সঙ্গে চুক্তির উদ্যোগটি ভেস্তে যায়।

২০০৭ সালে দেশীয় বেসরকারি প্রতিষ্ঠান সাইফ পাওয়ারটেককে চট্টগ্রাম বন্দরের দুটি টার্মিনাল পরিচালনার সুযোগ দেওয়ার ক্ষেত্রেও পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ উঠেছিল। বন্দরের অবকাঠামো ও যন্ত্রপাতি ব্যবহার করেই বেসরকারি প্রতিষ্ঠানটি কনটেইনার টার্মিনাল পরিচালিত করেছে। কিন্তু এখানে এমনভাবে কিছু শর্ত জুড়ে দেওয়া হয়েছিল, যাতে অন্য প্রতিষ্ঠান প্রতিযোগিতায় আসতে না পারে।

পতেঙ্গা কনটেইনার টার্মিনাল বছরে ৫ লাখ টিউ এস কনটেইনার পরিচালনা করতে পারবে। সৌদি রাজপরিবারের মালিকানাধীন রেড সি গেটওয়ে নামের কোম্পানিটি টার্মিনালের যন্ত্রপাতি ক্রয়, স্থাপনসহ যাবতীয় কর্মকাণ্ড সম্পাদন করবে এবং নির্দিষ্ট সময় শেষে বিল্ড ওন ট্রান্সফার (বিওটি) নিয়মানুযায়ী বন্দর কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তর করে ফিরে যাবে বলে জানা গেছে। সরকারের পিপিপি অথরিটি এই টার্মিনালের অপারেটর নিয়োগের জন্য বিশ্বব্যাংকের সহযোগী প্রতিষ্ঠান ইন্টারন্যাশনাল ফিন্যান্স করপোরেশনকে (আইএফসি) পরামর্শক নিয়োগ দিয়েছে।

মনে রাখতে হবে, এই আইএফসি একসময় মার্কিন স্টিভিডোর সার্ভিসেসকে বন্দরের বেসরকারি টার্মিনালের কাজ দেওয়ার ব্যাপারেও সুপারিশ করেছিল। সুতরাং এ ধরনের পরামর্শক কোম্পানির সব পরামর্শই সব সময় দেশের স্বার্থের অনুকূল হবে, এটা মনে করার কোনো কারণ নেই।

বড় বড় প্রকল্পে বিনিয়োগের জন্য অন্যের দ্বারস্থ হওয়া ছাড়া আমাদের যেমন উপায় নেই, তেমনি চুক্তি সম্পাদনের ক্ষেত্রে নয়-ছয় করার নজিরও কম নয়। চট্টগ্রাম বন্দর বাংলাদেশের অর্থনীতির মূল চালিকা শক্তি। দেশের সিংহভাগ আমদানি-রপ্তানি এই বন্দর দিয়েই হয়ে থাকে। বন্দরের টার্মিনাল পরিচালনার জন্য বিদেশি অপারেটর নিয়োগকে যাঁরা সন্দেহের দৃষ্টিতে দেখেন, তাঁরা ‘ঘর-পোড়া গরু’, তাই ‘সিঁদুরে মেঘ দেখলেই ভয়’ পান। নানা সময়ে অসম চুক্তির খেসারত দিতে হয়েছে এই দেশকে। কোনো চুক্তির ব্যাপারে তাই ঢাক ঢাক গুড় গুড় করার চেয়ে শর্তগুলো জনসমক্ষে আনা উচিত।

  • বিশ্বজিৎ চৌধুরী প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক, কবি ও সাহিত্যিক

    bishwabd@yahoo.com