মতামত

সরকারকে বাইডেনের চিঠি, স্বস্তি-অস্বস্তির প্রশ্ন

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ৪ ফেব্রুয়ারি একটি চিঠি পাঠিয়ে বাংলাদেশের উচ্চাভিলাষী অর্থনৈতিক লক্ষ্য অর্জনে সমর্থনের পাশাপাশি একটি অবাধ ও মুক্ত ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল প্রতিষ্ঠার অভিন্ন স্বপ্নপূরণে অংশীদারত্ব প্রতিষ্ঠায় ঢাকার সঙ্গে কাজ করার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন।

৭ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে বছরখানেকের বেশি সময় ধরে যুক্তরাষ্ট্র একটি ‘স্বচ্ছ, অংশগ্রহণমূলক ও গণতান্ত্রিক নির্বাচন’ অনুষ্ঠানের জন্য প্রকাশ্য বক্তব্য দিয়ে এসেছে। গণতন্ত্রকে বাধাগ্রস্ত করা হলে তার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ভিসা নিষেধাজ্ঞা আরোপের কথাও তারা ঘোষণা করেছিল। ফলে সরকারের সঙ্গে একধরনের টানাপোড়েন তৈরি হয় এবং যুক্তরাষ্ট্র এ দেশে ক্ষমতার পরিবর্তন ঘটাতে চায় বলে অভিযোগ করা হয়। এ পটভূমিতে প্রেসিডেন্ট বাইডেনের চিঠিতে সরকারের পক্ষে-বিপক্ষের অনেকেই চমকিত হয়েছেন।

অনেকেই এ চিঠিকে সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের শুরু হিসেবে বর্ণনা করছেন। আবার কেউ কেউ ভূরাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে একধরনের বাধ্যবাধকতা তৈরি হয়েছে বলেও বিষয়টি ব্যাখ্যা করছেন। আবার এক দল একে বাংলাদেশের গণতন্ত্রকামী মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষাকে বাণিজ্যিক স্বার্থে যুক্তরাষ্ট্রের জলাঞ্জলি দেওয়া হিসেবেও অভিহিত করেছেন। দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক যে কোনো একরৈখিক বিষয় নয়, সেটা বিস্মৃত হওয়ার প্রবণতা এদের সবার মধ্যেই প্রবল।

স্মরণ করা যাক ২০১৮ সালের নির্বাচনের কথা। তখন যদিও আন্তর্জাতিক বিষয়ে নিরাসক্ত বা অনাগ্রহী প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষমতায় ছিলেন, তবু বাংলাদেশে স্বচ্ছ ও অবাধ নির্বাচনের বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের কূটনৈতিক সক্রিয়তা একেবারে কম ছিল না।

যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন রাষ্ট্রদূত মার্শা বার্নিকাটের গাড়ির ওপর হামলার কথা হয়তো অনেকেই আমরা বিস্মৃত হয়েছি। কিন্তু তিনিও গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের বিষয়ে খোলামেলা কথাবার্তা বলে ক্ষমতাসীন দলের বিরাগভাজন হয়েছিলেন।

২০১৮ সালে ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচন কেমন হয়েছিল, তা নিয়ে খুব একটা বিতর্কের অবকাশ নেই। রাতের ভোট হিসেবে পরিচিতি পাওয়া সেই নির্বাচনের ১৯ দিন পর প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে চিঠি দিয়েছিলেন। এবার বাইডেনের চিঠি এল আরও দিন দশেক পর।

সুতরাং নির্বাচনের পর নতুন মেয়াদের শুরুতে সরকারপ্রধানের কাছে প্রেসিডেন্টের চিঠি দেওয়া কোনো ব্যতিক্রমী কিছু নয়। বরং কূটনৈতিক আচারে ব্যতিক্রম তখনই হতো, যদি এবার কোনো চিঠি না আসত। কিন্তু সপ্তাহ তিনেক আগে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের বিবৃতিতেই পরিষ্কার হয়ে যায়, যুক্তরাষ্ট্র নির্বাচন সুষ্ঠু ও স্বচ্ছ হয়নি বললেও তা প্রত্যাখ্যান করেনি।

বেলারুশ, ভেনেজুয়েলা কিংবা নিকারাগুয়ার নির্বাচনগুলোর ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র সরাসরি নির্বাচন প্রত্যাখ্যান করে এবং সে কারণে ওই সব দেশের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক মোটেও স্বাভাবিক নয়। তাদের সঙ্গে সব রকমের লেনদেন প্রায় বন্ধই বলা চলে।

ট্রাম্পের চিঠির সঙ্গে প্রেসিডেন্ট বাইডেনের চিঠির একটু তুলনা এখানে কিছুটা প্রাসঙ্গিক। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরকারের তৃতীয় মেয়াদের সাফল্য কামনা করেছিলেন। ফলে উচ্ছ্বসিত পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তখন সেই চিঠি সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ করে সেটিকে অভিনন্দনবার্তা হিসেবে বর্ণনা করেছিল।

কিন্তু সেই চিঠিতে ট্রাম্প লিখেছিলেন, ‘রাজনৈতিক বিরোধী ও তাদের সমর্থকদের ওপর হামলা এবং সাংবাদিকদের নির্যাতনের খবরগুলো অব্যাহত থাকায় জাতীয় নির্বাচন ও বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক ভাবমূর্তি কলঙ্কিত হচ্ছে।’ তিনি আরও লেখেন, ‘৩০ ডিসেম্বর ২০১৮-এর জাতীয় নির্বাচনের বিষয়ে স্বাধীন তদন্তের জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের আহ্বানের আলোকে আপনার অঙ্গীকার বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ।’

গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের মূল্যবোধের ওপর যেসব বিষয় নির্ভরশীল, সেগুলো দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের বিবেচ্য তালিকা থেকে একেবারেই বাদ পড়তে পারে। প্রেসিডেন্ট বাইডেনের চিঠির দুই দিন পর পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্রের ‘ভিসা নিষেধাজ্ঞার নীতি অস্তমিত হয়নি’ মন্তব্যের কথা এ ক্ষেত্রে উল্লেখ করা যায়। শ্রম অধিকারের বিষয়েও যুক্তরাষ্ট্রের নীতিতে কোনো পরিবর্তন আসেনি।

যুক্তরাষ্ট্র ও বাংলাদেশ—উভয়েই গণতান্ত্রিক নীতিমালার ওপর প্রতিষ্ঠিত উল্লেখ করে ট্রাম্প লেখেন, ‘বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক অগ্রগতি এবং অব্যাহত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও সমৃদ্ধির মধ্যে জোরালো যোগসূত্র রয়েছে। আমি আশা করি, আপনি বাংলাদেশের সম্প্রসারণশীল অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে নজর দেবেন, যার মধ্যে ন্যায্য ও পরিপূরক বাণিজ্য এবং বিনিয়োগের প্রসার ঘটানোর লক্ষ্যে পদক্ষেপ গ্রহণও অন্তর্ভুক্ত এবং মানবাধিকার, ব্যক্তির মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতি আপনার অঙ্গীকার নবায়ন করবেন।’

শান্তিপূর্ণভাবে ভিন্নমত প্রকাশকে রুদ্ধ করা হলে কারও কারও সহিংসতার পথ বেছে নেওয়ার ঝুঁকি তৈরি হবে বলেও প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প তাঁর চিঠিতে মন্তব্য করেছিলেন। বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ককে যুক্তরাষ্ট্র গুরুত্ব দেয় উল্লেখ করে মিয়ানমার থেকে বিতাড়িত রোহিঙ্গা শরণার্থীদের আশ্রয় দেওয়ায় বাংলাদেশ সরকারের প্রতি তাঁরা কৃতজ্ঞ বলেও ওই চিঠিতে লেখা হয়েছিল।

প্রেসিডেন্ট বাইডেনের চিঠিতেও কিছু কথার পুনরুচ্চারণ রয়েছে। যোগ হয়েছে মুক্ত ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল প্রতিষ্ঠার কথা। তিনি লিখেছেন, ‘বাংলাদেশের উচ্চাভিলাষী অর্থনৈতিক লক্ষ্য অর্জনে সমর্থন এবং একটি অবাধ ও মুক্ত ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল প্রতিষ্ঠার অভিন্ন স্বপ্নপূরণে বাংলাদেশের সঙ্গে অংশীদারত্ব প্রতিষ্ঠায় যুক্তরাষ্ট্র প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।’

প্রেসিডেন্ট বাইডেন আরও লিখেছেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র-বাংলাদেশ অংশীদারত্বের পরবর্তী অধ্যায় শুরুর পর্বে আমি বলতে চাই, আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক নিরাপত্তা, অর্থনৈতিক উন্নয়ন, জলবায়ু পরিবর্তন ও জ্বালানি, বৈশ্বিক স্বাস্থ্য, মানবিক সহায়তা, বিশেষ করে রোহিঙ্গা শরণার্থীসহ আরও অনেক ইস্যুতে আমাদের প্রশাসনের একসঙ্গে কাজ করার ঐকান্তিক ইচ্ছার কথা আমি তুলে ধরছি।’

উভয় চিঠিতেই দেখা যাচ্ছে, অর্থনৈতিক সম্পর্ক, অর্থাৎ বিনিয়োগ ও বাণিজ্যের প্রসার ঘটানোর আকাঙ্ক্ষার কথা আছে। রোহিঙ্গা শরণার্থীসহ মানবিক সহায়তার প্রসঙ্গ আছে। এবার বাড়তি হিসেবে আছে বৈশ্বিক নিরাপত্তা ও জলবায়ু পরিবর্তনের মতো বিষয়। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প নির্বাচনের অনিয়ম ও বিরোধীদের ওপর হামলায় বাংলাদেশের ভাবমূর্তি কলঙ্কিত করার কথা বললেও প্রেসিডেন্ট বাইডেন গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও নির্বাচনের বিষয়গুলো পুরোপুরি এড়িয়ে গেছেন। এটা সরকারের দিক থেকে স্বস্তির বিষয় হতে পারে।

তবে বাইডেন প্রশাসন গণতন্ত্র ও মানবাধিকারকে তার পররাষ্ট্রনীতির মূল ভিত্তি হিসেবে গত তিন বছর ধরে তাঁর প্রশাসনের যে মূল্যবোধের কথা বলে এসেছেন, তার আলোকে বাংলাদেশকে আর গণতন্ত্র হিসেবে গণ্য না করার প্রতিফলন হিসেবেও এ চিঠিকে ব্যাখ্যা করার অবকাশ রয়েছে।

যেহেতু গণতন্ত্রের পথে ফেরানোর চেষ্টায় তারা ব্যর্থ হয়েছে, সেহেতু ওই প্রসঙ্গের উল্লেখ তাঁর প্রশাসন অপ্রয়োজনীয় বলে সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকতে পারে। বহুদলীয় গণতন্ত্র পুনরুজ্জীবনকামীদের জন্য সেটি হতাশার বিষয় ঠিকই। তবে তা বাংলাদেশের জন্য অশনিসংকেতও হতে পারে।

গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের মূল্যবোধের ওপর যেসব বিষয় নির্ভরশীল, সেগুলো দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের বিবেচ্য তালিকা থেকে একেবারেই বাদ পড়তে পারে। প্রেসিডেন্ট বাইডেনের চিঠির দুই দিন পর পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্রের ‘ভিসা নিষেধাজ্ঞার নীতি অস্তমিত হয়নি’ মন্তব্যের কথা এ ক্ষেত্রে উল্লেখ করা যায়। শ্রম অধিকারের বিষয়েও যুক্তরাষ্ট্রের নীতিতে কোনো পরিবর্তন আসেনি।

আর ৫ ফেব্রুয়ারি পররাষ্ট্রমন্ত্রী ব্লিঙ্কেন ভিন্নমত দমনে আড়ি পাতা প্রযুক্তি ব্যবহারের বিষয়ে নতুন করে ভিসা নীতি প্রয়োগের কথা ঘোষণা করেছেন। এসব নিষেধাজ্ঞার কোনটি কখন প্রয়োগ করা হবে বা হবে না, তা নিয়ে জল্পনা অর্থহীন। তবে ঝুঁকি যে অপসারিত হয়নি, বরং বেড়েছে, সেটা উপেক্ষা করাও যৌক্তিক নয়।

● কামাল আহমেদ সাংবাদিক