বুয়েটে সাংগঠনিক রাজনৈতিক কার্যক্রম নিষিদ্ধ করে বুয়েট প্রশাসনের ২০১৯ সালে জারি করা জরুরি বিজ্ঞপ্তিটি স্থগিত করে আদালতের দেওয়া রায় যেদিন ঘোষিত হলো, সেদিন আমার অফিসে সামনাসামনি এবং পরবর্তী সময়ে ফোন করে একাধিক বর্তমান শিক্ষার্থী ঝরঝর করে কেঁদেছে।
এদের কারুরই কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সম্পৃক্ততা নেই, এরা কেউই ‘মৌলবাদী’ বা ‘পাকিস্তানের প্রেতাত্মা’ নয়, এরা আধুনিক প্রগতিশীল এবং দুর্দান্ত মেধাবী তরুণ-তরুণী। যেকোনো পরিবার, যেকোনো বিশ্ববিদ্যালয়, যেকোনো দেশ এ রকম তরুণ-তরুণীদের পেয়ে আনন্দিত হয়, গর্বিত হয়, তাদের যত্নে লালন করে।
কেন কাঁদছিল তারা? তাদের আকুতি হলো, ‘স্যার, আমরা আমাদের এত কষ্টে পাওয়া এই নিরাপদ আনন্দময় ক্যাম্পাস থেকে আবার সেই ভয়ংকর অন্ধকার সময়ে ফিরে যাব? আমরা আমাদের ফার্স্ট ইয়ারে ছাত্ররাজনীতির নামে যে ভয়ংকর পরিস্থিতি আর নির্যাতনের মধ্য দিয়ে গিয়েছি, সেখানে আবার ফিরে যাব আমরা?’
আবরার ফাহাদের মৃত্যুতে ২৬টি বা তারও বেশি দুর্দান্ত মেধাবী তরুণের সম্ভাবনার অপমৃত্যু ঘটেছে। চিরদিনের জন্য লন্ডভন্ড হয়ে গিয়েছে এদের সবার পরিবার। আবরার ফাহাদের মৃত্যু হয়েছে অবর্ণনীয় নির্যাতনে, আর সেই অপরাধে ২৫ জনের মতো তরুণ আজ জেলে বিচারের জন্য অপেক্ষা করছে।
এরা সবাই বর্তমানে প্রচলিত ধারার ছাত্ররাজনীতির নামে চলতে থাকা অপরাজনীতির বলি। এদের সম্ভাবনাময় উজ্জ্বল তরুণ থেকে নির্যাতক আর হত্যাকারী বানিয়েছে এ সময়ের কথিত ছাত্ররাজনীতি। আর আবরার ফাহাদ একা নয়, দীর্ঘকাল ধরে দিনের পর দিন বিভিন্ন রকম নির্যাতনের শিকার হয়েছিল আরও অনেক শিক্ষার্থী ক্ষমতার দাপটে দানবে পরিণত হওয়া কিছু ছাত্রনেতা বা কর্মীর হাতে। সেই বীভত্স স্মৃতি বুয়েটের শিক্ষার্থী আর শিক্ষকদের এখনো তাড়া করে বেড়ায়।
তাই আমাদের সন্তানসম বুয়েটের এই শিক্ষার্থীরা কেন তাদের ক্যাম্পাসে তথাকথিত সাংগঠনিক ছাত্ররাজনীতি চায় না, তা একবারও ভেবে দেখেছেন কি? ছাত্ররাজনীতিমুক্ত বুয়েটের ক্যাম্পাসে ছিল একাডেমিক, এক্সট্রা কারিকুলার আর কালচারাল কার্যক্রমে মুখর। প্রাণচঞ্চল, আতঙ্ক নির্যাতনহীন, নিরাপদ একটি ক্যাম্পাস।
বুয়েটের এই ক্যাম্পাসে এর শিক্ষার্থীরা যে রকম প্রগতিশীল সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও প্রযুক্তিনির্ভর কার্যক্রম বছরজুড়ে করে, তা অন্য অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনায় ঈর্ষণীয়।
বুয়েটের প্রতি দেশের মানুষের অগাধ ভরসা। দেশের শিক্ষার্থীদের একটা বড় অংশ এখানে পড়ার স্বপ্ন দেখে, সন্তানকে এখানে পাঠানোর স্বপ্ন দেখেন লাখো অভিভাবক। দেশের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারকদের প্রতি অনুরোধ, বুয়েটের তরুণ শিক্ষার্থীদের অনুভূতিগুলো বোঝার চেষ্টা করুন, তাদের ভীতি আর আতঙ্ক অনুধাবন করুন, একটি অবাধ আর নিরাপদ ক্যাম্পাসে তাদের শিক্ষাজীবন কাটানোর আকুতি শোনার চেষ্টা করুন—তাদের অভিভাবক হিসেবে, তাদের সন্তানের মতো করে দেখে।
গত চার বছরে যেকোনো সময়ে ক্যাম্পাসে কেউ এলেই তার প্রমাণ পাওয়ার কথা। সে ক্যাম্পাসেই ওরা থাকতে চায়, সে রকম উদার নিরাপদ, প্রাণবন্ত ক্যাম্পাসই ওরা রাখতে চায়। খুব কি অন্যায্য শোনাচ্ছে এই চাওয়া? অন্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সাধারণ শিক্ষার্থীদের বেছে নেওয়ার সুযোগ দিলে তারাও একই সুযোগ বেছে নেবে।
বুয়েটের শিক্ষার্থীদের ক্যাম্পাসে সাংগঠনিক ছাত্ররাজনীতিতে নিষিদ্ধ রাখতে চাওয়ার দাবি আর কর্মকাণ্ডকে স্বাধীনতাবিরোধী এবং মৌলবাদ ও ধর্মভিত্তিক রাজনীতির উত্থানের ট্যাগ অতীতে দেওয়া হয়, এখনো হচ্ছে।
আমাদের ভুলে গেলে চলবে না যে এ রকম মিথ্যা ট্যাগিংয়ের কারণেই হত্যার শিকার হয়েছিল আবরার ফাহাদ। সাংগঠনিক ছাত্ররাজনীতি না থাকলে একটি প্রগতিশীলতার শূন্যতা তৈরি হবে আর সেখানে মৌলবাদ মাথাচাড়া দিয়ে উঠবে, এ রকম যুক্তিতেই এ ধরনের ঢালাও অভিযোগ করা হয় কোনো রকমের জবাবদিহি ছাড়া।
ভিন্নমত প্রকাশের স্বাধীনতা রুদ্ধ হলেও তো সেখান থেকে জন্ম নিতে পারে নানা রকম সহিংস পথ, উগ্রবাদ—এ ব্যাপার অবশ্য সে রকম উচ্চবাচ্য শোনা যায় না। দেশে গোয়েন্দা সংস্থা আছে, সরকারের নির্বাচিত বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনসহ প্রশাসনিক আরও বিভিন্ন চ্যানেল আছে—যদি সত্যি মৌলবাদ বা নিষিদ্ধ কোনো রকমের চর্চা হয় বা সে রকম পরিবেশের আশঙ্কা থাকে, তাহলে তারা কাজ করুক, ব্যবস্থা নিক। নিজেদের মেধাবী সন্তানদের বিরুদ্ধে, দেশের শীর্ষস্থানীয় ও স্বনামধন্য একটি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে এ রকম ঢালাও আর অন্যায্য অভিযোগ খুবই অনভিপ্রেত।
বুয়েটের সাবেক অধ্যাপক, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ইমেরিটাস এবং বুয়েট অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট আইনুন নিশাত স্যার সেদিন একটি টিভি চ্যানেলের সঙ্গে সাক্ষাত্কারে খুব চমৎকারভাবে কিছু জিনিস বুঝিয়ে বলেছেন।
তিনি উদাহরণ দিয়ে দেখালেন যে আইআইটি দিল্লিতে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ, অথচ তার ঠিক পাশেই জওহরলাল নেহরু ইউনিভার্সিটিতে (জেএনইউ) ছাত্ররাজনীতিকে উৎসাহ দেওয়া হয়। কারণ, দুটি বিশ্ববিদ্যালয়ের চরিত্রগত ভিন্নতা। সবাইকে তো এক পাল্লায় মাপার দরকার নেই! তিনি আরও দেখালেন যে নিজেদের মতামতের সঙ্গে না মিললে বা প্রতিবাদ করলেই তাকে মৌলবাদ আর স্বাধীনতাবিরোধী ট্যাগ দেওয়ার সংস্কৃতি কতটা অসাড় আর বিপজ্জনক।
আমাদের দেশের সম্মানিত নীতিনির্ধারকেরা তো নিজেদের সন্তান বা সন্তানসম কেউ আছে? তাঁরা কি নিজের মনের কাছে প্রশ্ন করেছেন যে তিনি যখন তাঁর সন্তানকে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্যাম্পাসে পাঠান বা পাঠিয়েছেন, তখন সেখানে কি তিনি একটি নিরাপদ, র্যাগিং-বুলিং-গণরুম সংস্কৃতি-নির্যাতনমুক্ত একটি ক্যাম্পাস কামনা করেন না বা করেননি? দূর মফস্সল থেকে বাবা-মা তাঁদের সন্তানকে যখন স্বপ্নের সেই বুয়েটে (বা অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে) পড়তে পাঠান, একটু সমীক্ষা করে দেখবেন কি যে তাঁরা তাঁদের সন্তানের জন্য এই প্রচলিত ছাত্ররাজনীতিমুক্ত ক্যাম্পাস চান কি না? এর উত্তর আমাদের সবারই জানা। দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের চাওয়া পূরণ করা কি গণতান্ত্রিকি প্রক্রিয়ায় নীতিনির্ধারকের দায়িত্ব নয়?
বুয়েটের প্রতি দেশের মানুষের অগাধ ভরসা। দেশের শিক্ষার্থীদের একটা বড় অংশ এখানে পড়ার স্বপ্ন দেখে, সন্তানকে এখানে পাঠানোর স্বপ্ন দেখেন লাখো অভিভাবক। দেশের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারকদের প্রতি অনুরোধ, বুয়েটের তরুণ শিক্ষার্থীদের অনুভূতিগুলো বোঝার চেষ্টা করুন, তাদের ভীতি আর আতঙ্ক অনুধাবন করুন, একটি অবাধ আর নিরাপদ ক্যাম্পাসে তাদের শিক্ষাজীবন কাটানোর আকুতি শোনার চেষ্টা করুন—তাদের অভিভাবক হিসেবে, তাদের সন্তানের মতো করে দেখে।
কি করলে তাদের মঙ্গল হয়, এই প্রতিষ্ঠানের মঙ্গল হয়, তা অনুধাবন করুন। কোনো অহংবোধ বা দলীয় স্বার্থ থেকে না চিন্তা করে এবং দেশের আপামর শিক্ষার্থী, অভিভাবক আর সচেতন মানুষের আকাঙ্ক্ষাকে মূল্য দিন। আপনাদের সঠিক বিবেচনা আর শুভ বোধের প্রার্থনা করছি।
মো. আশিকুর রহমান অধ্যাপক, যন্ত্রকৌশল বিভাগ, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট)