চীনের প্রেসিডেন্টকে হারিয়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রী যেখানে চ্যাম্পিয়ন

ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং
এএফপি ফাইল ছবি

সম্প্রতি অনুষ্ঠিত হয়ে যাওয়া ব্রিকস (ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত, চীন ও দক্ষিণ আফ্রিকা) সম্মেলনে অর্থনৈতিক জোটটিতে ছয়টি নতুন দেশকে যুক্ত করার পর আমি বলেছিলাম ব্রিকস কিংবা শিল্পোন্নত দেশগুলোর জোট জি-৭ (কানাডা, ফ্রান্স, জার্মানি, ইতালি, জাপান, যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্র এবং এর সঙ্গে ইউরোপীয় ইউনিয়ন) কারোরই বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার মতো গ্রহণযোগ্যতা অথবা সামর্থ্য নেই। এ পরিস্থিতিতে জি-২০ (সবচেয়ে বড় অর্থনীতির ১৯ দেশ ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন) জোটই একমাত্র সত্যিকার অর্থে যাদের বৈশ্বিক সমস্যা সমাধানের সক্ষমতা আছে।

নয়াদিল্লিতে গত সপ্তাহে অনুষ্ঠিত জি-২০ সম্মেলনে যে যৌথ ঘোষণা এসেছে, তা আমার ধারণাকে আরও পোক্ত করল। এ সম্মেলনে সদস্যদেশগুলো এ ব্যাপারে ঐকমত্যে পৌঁছেছে যে তারা বড় পরিসর থেকে বৈশ্বিক বিষয়গুলোর দিকে মনোযোগ দেবে। অনিবার্য চ্যালেঞ্জ থাকা সত্ত্বেও এবার জি-২০ তাদের প্রাসঙ্গিকতাকে তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছে।

এর জন্য সবচেয়ে বেশি ভূমিকা যারা পালন করেছে, তাদের আমাদের সাধুবাদ জানানো উচিত। এটা অনস্বীকার্য যে ভারত ও যুক্তরাষ্ট্র বিবৃতি চূড়ান্ত করার ক্ষেত্রে ভূমিকা রেখেছে। নয়াদিল্লি ঘোষণা হতে পারে জলবায়ু পরিবর্তন, বিশ্বব্যাংক নতুন রূপে সাজানো, সংক্রামক রোগনিয়ন্ত্রণ, অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা, ইউক্রেন যুদ্ধসহ অন্যান্য বৈশ্বিক বিষয়ে প্রথম কোনো শক্তিশালী সমবেত প্রচেষ্টা।

যদিও রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ও চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংয়ের অনুপস্থিতিতেই সম্মেলনটি অনুষ্ঠিত হয়েছে। কিন্তু রাশিয়া ও চীনের যে প্রতিনিধিরা সম্মেলনে এসেছিলেন, তাঁরা তাঁদের সরকারের সম্মতি ছাড়া যৌথ ঘোষণায় স্বাক্ষর করেননি।

অনেকে মনে করেন, সি চিন পিং জি-২০ সম্মেলনে যোগ না দেওয়ার কারণ হলো তিনি চীনের অন্যতম প্রতিদ্বন্দ্বী ভারত ও দেশটির প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে অপমান করতে চেয়েছেন। উদ্দেশ্য যা–ই হোক না কেন, সি চিন পিংয়ের এই সিদ্ধান্ত সর্বশেষ ব্রিকস সম্মেলনের তাৎপর্যকে অনেকটাই খাটো করেছে। কেননা ব্রিকস সম্মেলনকে অনেকে চীনের বিজয় হিসেবে দেখেছিলেন।

গত মাসে আমার লেখায় আমি বলেছিলাম, ভারত-চীনের মধ্যে সংহতির যে ঘাটতি, সেটাই নতুন ব্রিকসের চলার পথে সবচেয়ে বড় বাধা। এখন জি-২০ সম্মেলনে সি চিন পিং না যাওয়ায় ভারত ও চীনের মধ্যে বিভক্তি গভীর হলো।  বর্তমান বাস্তবতায়, জি-২০ সম্মেলনের সাফল্য বলছে সম্মেলন কূটনীতিতে জিতে গেলেন মোদি। এখন মোদিকে সি চিনের তুলনায় বেশি স্বপ্নদর্শী রাষ্ট্রপ্রধান বলে মনে হচ্ছে।

এ ছাড়া এবারের জি-২০ সম্মেলনে আরেকটি ছোট হলেও গুরুত্বপূর্ণ অর্জন হয়েছে। আফ্রিকান ইউনিয়নকে জোটে যুক্ত করার ব্যাপারে সম্মতি এসেছে। এর ফলে জি-২০ থেকে জোটটি জি-২১ হবে। এই যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত মোদিকে পরিষ্কার কূটনৈতিক বিজয় এনে দিয়েছে। গ্লোবাল সাউথ বা বৈশ্বিক দক্ষিণের চ্যাম্পিয়ন হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে তাঁর ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হলো।

ব্রিকস সম্প্রসারণ হয়েছে এলোমেলোভাবে। এর বিপরীতে জি-২০ সম্প্রসারণের সিদ্ধান্ত পরিকল্পিত। ব্রিকসে মিসর ও ইথিওপিয়াকে নেওয়া হয়েছে কিন্তু আফ্রিকার গুরুত্বপূর্ণ অর্থনীতি যেমন নাইজেরিয়াকে নেওয়া হয়নি।

বৈশ্বিক অর্থনীতি, জলবায়ু পরিবর্তন, জনস্বাস্থ্য এবং অন্য আরও বিষয়ের প্রেক্ষাপট থেকে বিবেচনা করলে ইউক্রেন নিয়ে জি-৭ নয়, জি-২০-এর আওয়াজ অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। বৈশ্বিক বিষয়গুলোতে জি-৭-এর নেতারা নিজেদের এখনো প্রধান প্রভাবশালী হিসেবে দেখতে চাইতে পারেন। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন কিছুরই ইঙ্গিত দিচ্ছে। নয়াদিল্লি সম্মেলন থেকে এই শিক্ষাটা পাওয়া যাচ্ছে যে প্রধান প্রধান উদীয়মান শক্তিগুলোকে অন্তর্ভুক্ত না করতে পারলে বৈশ্বিক বড় চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করার সম্ভাবনা নেই।

ব্রিকস সম্মেলনের পর থেকে আমার অনেকের সঙ্গে কথা হয়েছে, যাঁরা মনে করেন, জি-২০–এর তুলনায় জি-৭ এখন পর্যন্ত অনেক বেশি কার্যকর। তাদের যুক্তি হলো, ইউক্রেন–রাশিয়ার যুদ্ধের মতো ইস্যুতে সংহতি জানাতে পারছে। কিন্তু আমি বিনম্রভাবে ভিন্নমত পোষণ করছি। যদিও জি-২০-এর যৌথ ঘোষণায় ইউক্রেনীয় নেতাদের প্রত্যাশামাফিক যুদ্ধ সম্পর্কে বক্তব্য আসেনি কিন্তু আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত সীমান্ত লঙ্ঘন না করার ব্যাপারে স্পষ্ট বার্তা সেখানে আছে।

এর মধ্য দিয়ে পুতিনের কাছে এই বার্তাও পৌঁছে গেল যে ব্রিকসের কয়েকটি সদস্যের কাছে পৃষ্ঠপোষকতা পাওয়ার যে আশা তিনি করেছিলেন সেটা পূরণ হবে না। একই সঙ্গে এ ঘোষণায় পশ্চিমা দেশগুলোর কিংবা যেসব নেতা যুদ্ধকে জোরালোভাবে নিন্দা জানাচ্ছে, তাদের আওয়াজের প্রতিফলন ঘটেনি।

বৈশ্বিক অর্থনীতি, জলবায়ু পরিবর্তন, জনস্বাস্থ্য এবং অন্য আরও বিষয়ের প্রেক্ষাপট থেকে বিবেচনা করলে ইউক্রেন নিয়ে জি-৭ নয়, জি-২০-এর আওয়াজ অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। বৈশ্বিক বিষয়গুলোতে জি-৭-এর নেতারা নিজেদের এখনো প্রধান প্রভাবশালী হিসেবে দেখতে চাইতে পারেন। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন কিছুরই ইঙ্গিত দিচ্ছে। নয়াদিল্লি সম্মেলন থেকে এই শিক্ষাটা পাওয়া যাচ্ছে যে প্রধান প্রধান উদীয়মান শক্তিগুলোকে অন্তর্ভুক্ত না করতে পারলে বৈশ্বিক বড় চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করার সম্ভাবনা নেই।

জি-২০-এর সমালোচকেরা আমার যুক্তির পাল্টা যুক্তি হিসেবে বলতে পারেন জোটটি এত বড় এবং জবরজং যে সেটিকে সক্রিয় করা কঠিন। এ ক্ষেত্রে আমি ২০০১ সালে ব্রিকসের ধারণাটি প্রথমবার নিয়ে আসার ক্ষেত্রে যা লিখেছিলাম, তারই পুনরাবৃত্তি করব।

ইউরোপের দেশগুলো যদি তাদের যৌথ প্রকল্পগুলোর স্থায়িত্ব সত্যিকার অর্থেই দেখতে চায়, তাহলে আমার পরামর্শ হলো, অবশ্যই জি-২০-এর মতো আন্তর্জাতিক সংঘে আলাদা প্রতিনিধি না পাঠিয়ে একজন প্রতিনিধি পাঠানো উচিত। তাহলে জি-২০ জবরজং না হয়ে বরং শক্তিশালী জোটের দৃষ্টান্ত হবে। ব্রিকসের মতো অন্য জোটও যদি একই দৃষ্টান্ত অনুসরণ করে, তাহলে সেগুলোও তাদের উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের উপযোগী হয়ে উঠবে।

স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট, ইংরেজি থেকে অনুবাদ

  • জিম ও’নিল যুক্তরাজ্যের সাবেক অর্থমন্ত্রী