আনিসুল হকের কলাম

প্রান্তিক মানুষের সংগ্রাম বনাম কোটিপতি ক্লাব

চরম অস্বস্তি নিয়ে গার্ডিয়ান–এর ২৩ ডিসেম্বর ২০২৩-এর প্রতিবেদনটা পড়ছি। শিরোনামটা এমন দেয়া হয়েছে, যাকে বলা যেতে পারে ক্লিক-বেইট, যুক্তরাজ্যের জন্য যে নারী ক্রিসমাসের জাম্পার বানাচ্ছেন, তিনি যৌনকর্মী হয়ে যাচ্ছেন খরচ জোগানোর জন্য। কাহিনি বাংলাদেশের। কেরানীগঞ্জের নদীর ধারের।

এক গার্মেন্টসশ্রমিক, তারা ছদ্মনাম দিয়েছে রুবি রফিক। তাঁর ১৬ বছরের এক ছেলে আছে, ১৩ বছরের এক মেয়ে। তিনি স্বামী পরিত্যক্তা। রোজ রাতে সন্তান ঘুমিয়ে পড়লে ঘর ছেড়ে বের হন, রাস্তায়-বাজারে দাঁড়ান, খদ্দের খোঁজেন। ৪০০ টাকা পান, ২০০ পান।

একবার এক খদ্দের তাঁকে ৫০০ টাকা দেবার কথা বলে নিয়ে যায়, ১০ জনের দলে হাজির করে, তাঁকে মারধর করে। করুণ কাহিনি। তাঁর এই কষ্টকর জীবনের কারণ, যে আট হাজার টাকা তিনি পোশাক কারখানায় কাজ করে পান, তা দিয়ে তাঁর সংসার চলে না।

প্রথমে তিনি নিজের খাওয়া কমিয়ে দিয়ে সন্তানদের খাওয়াতেন, পরে তা–ও সম্ভব হচ্ছে না। শেষে তিনি অতিরিক্ত আয়ের জন্য রাতে ঘর থেকে বের হওয়া শুরু করেন।

গার্ডিয়ান বলছে, তিনি এবং তাঁর মতো শ্রমিকেরা সেই সব কারখানায় কাজ করেন, যারা যুক্তরাজ্যে বড় বড় ব্র্যান্ডে পোশাক সরবরাহ করে, ক্রিসমাসের সান্তার ছবি সেলাই করা জাম্পার তারাই বানায়। এই পোশাকশ্রমিকেরা পৃথিবীর সবচেয়ে কম মজুরি পান। প্রতি ঘণ্টায় তাঁদের বেতন আধা পেনিরও কম।

অস্বস্তির কথা বলছিলাম। ৪০ লাখ গার্মেন্টসকর্মীর দুঃখ-কষ্ট, দাবি-সংগ্রাম, বৈষম্য-শোষণের কথা বলার জন্য যে একজন রুবি রফিকের কাহিনি গার্ডিয়ান বলল, তার মর্মকথা, তার অন্তর্নিহিত আবেদনের প্রতি সহমর্মিতা জানিয়েও এ কথা কি বলা যায় না যে, এই প্রতিবেদন বাংলাদেশের সংগ্রামশীল পোশাককর্মীদের সম্পর্কে ভুল বার্তা পৌঁছাবে পৃথিবীব্যাপী।

আমি বলছি না যে রুবি রফিকের গল্প বানানো। কিন্তু ৪০ লাখ পোশাককর্মী রুবি রফিক হয়ে গেছেন, এই রকম ভুল সরলীকরণের বিপদ কি এই প্রতিবেদন সৃষ্টি করে না?

তবে বাংলাদেশের সমাজটা বৈষম্য ও অমানিবকতার আকর হয়ে উঠছে দিন দিন। গতকাল (২৮ ডিসেম্বর ২০২৩) দ্য ডেইলি স্টার–এর প্রথম পৃষ্ঠায় বড় করে ছাপা হয়েছে ‌‘শীর্ষ ১০ ভাগের হাতে ৪০ ভাগ আয়।’

সরকারের ‘খানার আয়-ব্যয় জরিপ ২০২২’ ধরে তারা দেখিয়েছে, বাংলাদেশের বড়লোক ৫ ভাগের হাতে চলে যায় ৩০ ভাগ আয়। অন্য দিকে গরিব যে ৫ ভাগ, তাঁদের হাতে আয় যায় দশমিক ৩৭ শতাংশ এবং এই বৈষম্য দিন দিন বাড়ছে।

বৈষম্যের গিনি সহগ ২০১৬ থেকে আরও বেড়েছে, দশমিক ৪৮২ থেকে বেড়ে হয়েছে দশমিক ৪৯৯।

এই সব জটিল গণিত, পরিভাষা, চার্ট বাস্তবতার কমই বোঝায়। বৈষম্য যে বাড়ছে, তা আমরা খোলাচোখেই দেখতে পাই।

টিআইবি বলছে, আমাদের এক মন্ত্রীর বিদেশে ২ হাজার ৩১২ কোটি টাকার ব্যবসা আছে এবং তিনি তাঁর নির্বাচনী হলফনামায় সেই তথ্য গোপন করেছেন।

যাঁর বিদেশে দুই হাজার কোটির বেশি টাকার ব্যবসা আছে, দেশে তাঁর কী পরিমাণ সম্পদ বা অর্থ আছে, সেটা আমাদের মতো আদার ব্যাপারীরা কল্পনাও করতে পারব না।

আমাদের সংসদ সদস্য পদপ্রার্থীরা বেশির ভাগই কোটিপতি এবং যাঁরা নির্বাচনে দাঁড়িয়েছেন, তাঁদের বেশির ভাগেরই পেশা হলো ব্যবসা। মানে সংসদ হতে যাচ্ছে কোটিপতি ব্যবসায়ীদের ক্লাব। সেই রাজনীতিবিদেরা কই? যাঁরা খদ্দর ছাড়া পরতেন না। এমন নেতাও ছিলেন, যিনি একটা জামা ধুয়ে দিয়ে বাতাসে শুকিয়ে তারপর ঘর থেকে বের হতেন, অথচ তাঁর বাবা ছিলেন জমিদার

আমাদের সংসদ সদস্য পদপ্রার্থীরা বেশির ভাগই কোটিপতি এবং যাঁরা নির্বাচনে দাঁড়িয়েছেন, তাঁদের বেশির ভাগেরই পেশা হলো ব্যবসা। মানে সংসদ হতে যাচ্ছে কোটিপতি ব্যবসায়ীদের ক্লাব।

সেই রাজনীতিবিদেরা কই? যাঁরা খদ্দর ছাড়া পরতেন না। এমন নেতাও ছিলেন, যিনি একটা জামা ধুয়ে দিয়ে বাতাসে শুকিয়ে তারপর ঘর থেকে বের হতেন, অথচ তাঁর বাবা ছিলেন জমিদার, তিনি শ্রেণিচ্যুত হয়েছিলেন স্বেচ্ছায়, শ্রেণিহীন সমাজ গড়ে তুলবেন বলে!

মাওলানা ভাসানী খড়ের ঘর, কাঁচা মাটির মেঝে—এই রকম বাড়িতে থাকতেন। নিজের সব জমিজিরেত দান করে দিয়েছিলেন নানা দাতব্য প্রতিষ্ঠান গড়ার জন্য।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর অসমাপ্ত আত্মজীবনী–তে লিখেছিলেন, ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে নিজ এলাকার একটা ঘটনা:
‘আমার মনে আছে, খুবই গরিব বৃদ্ধ এক মহিলা কয়েক ঘণ্টা রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে, শুনেছে এই পথে আমি যাব। আমাকে দেখে আমার হাত ধরে বলল, “বাবা আমার এই কুঁড়েঘরে তোমাকে একটু বসতে হবে।” আমি তার হাত ধরেই তার বাড়িতে যাই। অনেক লোক আমার সঙ্গে, আমাকে মাটিতে একটা পাটি বিছিয়ে বসতে দিয়ে এক বাটি দুধ, একটা পান ও চার আনা পয়সা এনে আমার সামনে ধরে বলল, “খাও বাবা, আর পয়সা কয়টা তুমি নেও, আমার তো কিছুই নাই।” আমার চোখে পানি এল। আমি দুধ একটু মুখে নিয়ে সেই পয়সার সাথে আরও কিছু টাকা তার হাতে দিয়ে বললাম, তোমার দোয়া আমার জন্য যথেষ্ট, তোমার দোয়ার মূল্য টাকা দিয়ে শোধ করা যায় না। টাকা সে নিল না, আমার মাথায়-মুখে হাত দিয়ে বলল, “গরিবের দোয়া তোমার জন্য আছে বাবা।” নীরবে আমার চক্ষু দিয়ে দুই ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়েছিল, যখন তার বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসি, সেই দিনই আমি মনে মনে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, মানুষেরে ধোঁকা আমি দিতে পারব না।’

এই মানুষদের আমরা ধোঁকা দিচ্ছি কি না! অপমান করছি কি না! কুড়িগ্রামের চরের মানুষেরা কী রকমভাবে বেঁচে আছেন, কত সামান্য আয়ে চলছেন, কেমন আছে উপকূলে বাঁধের ওপরে আশ্রয় নেওয়া পরিবারগুলো, কেমন আছেন তাঁরা, যাঁরা রোজ তরঙ্গবিক্ষুব্ধ সাগরে যান মাছ ধরতে, যাঁরা সুন্দরবনে যান মধুর খোঁজে বা গোলপাতা সংগ্রহ করতে!

নেটফ্লিক্সে একটা সিরিজ আছে টেলস বাই লাইট, প্রামাণ্য ছবিটা শুরু হয় ঢাকার শিশুদের বিপজ্জনক শিশুশ্রমের দৃশ্য দেখিয়ে, আমাদের চোখ ফেটে আসে যখন দেখি, আমাদের ঢাকা শহরে শিশুরা গনগনে গরম ধাতু দিয়ে বাসনকোসন বানাচ্ছে, রবার গলিয়ে বেলুন বানাচ্ছে, আস্তাকুঁড়ে গিয়ে বর্জ্য ঘাঁটছে!

অত দূর যেতে হবে না, আমাদের বাড়ির নিচে, অফিসের নিচে যে নিরাপত্তারক্ষীরা কাজ করছেন, তাঁদের মাসিক বেতন কত, একবারও কি কেউ জিজ্ঞাসা করেছেন?

আমাদের অফিসগুলোয় যে পরিচ্ছন্নতাকর্মীরা ইউনিফর্ম পরে কাজ করেন, তাঁদের মাসিক বেতন কত, জানতে চেয়েছেন? ৮ হাজার থেকে ১২ হাজার টাকা মাসিক আয়ে তাঁরা চলেন কী করে?

এসব মানুষ এই আয় দিয়ে নিজেরা খান কী? পরিবারকে দেন কী? তাঁরা যাতায়াতের টাকা কোথায় পান, তাঁদের বাসাভাড়া আসে কোত্থেকে? অসুখবিসুখ হলে তাঁরা খরচা জোগাড় করেন কীভাবে? তাঁদের দুঃখ-কষ্ট চোখের সামনে চোখের আড়াল হয়ে আছে। কিন্তু বেসরকারি কিন্ডারগার্টেনের একটা শিক্ষকের বেতন কত কম হতে পারে, সে ধারণা কি আমাদের আছে? কেন আমাদের ন্যায্যমূল্যের ট্রাকের সামনে এত ভিড়, সহজেই বোঝা যায়।

এই দেশে কিছু লোকের হাজার হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে আছে ঘুষের টাকা, ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে মেরে দেওয়া টাকা, আছে ই-বাণিজ্য বা শেয়ারমার্কেটে গণপ্রতারণার মাধ্যমে মানুষকে সর্বস্বান্ত করে পুঞ্জীভূত টাকা; নিয়োগ-বাণিজ্য, টেন্ডার–বাণিজ্যের টাকা; সিন্ডিকেট ব্যবসা করে এক রাতে মরিচ-পেঁয়াজ–আলুর দাম বাড়িয়ে আত্মসাৎ করা টাকা, জমি-পানি-বনদস্যুতার টাকা, মাদক ব্যবসা, ক্যাসিনো ব্যবসা, চোরাচালান, হুন্ডির মাধ্যমে অর্জিত টাকা—যার বেশির ভাগটা চলে যায় বিদেশে, পাচার হয়ে। বাংলাদেশ তো দুটো বিষয়ে রেকর্ড বইয়ে নাম তুলেছে। এক. কোটিপতি উৎপাদনে, দুই. বিদেশে টাকা পাচারে।

উল্টো দিকে আছেন গরিব মানুষ। এখনো চার কোটি মানুষ গরিব। এই দেশে কী নিয়ে আমরা গর্ব করি! স্বাধীনতার ৫২ বছর পেরিয়ে গেল!

গার্ডিয়ান–এর প্রতিবেদনটা আমাদের কাছে প্রতিনিধিত্বমূলক মনে হচ্ছে না, তা যেমন স্পষ্ট ভাষায় বলব, তেমনি বলব, এই দেশে এত বৈষম্য চলতে পারে না, বৈষম্য কমাতেই হবে।

গরিব মানুষের জন্য, দরিদ্র এলাকাগুলোর জন্য রাষ্ট্রকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে কর্মসূচি নিতেই হবে। কিন্তু সংসদে জনগণের প্রতিনিধিত্ব করতে আসছেন কারা? বাণিজ্য সংগঠনগুলোর নেতারা!

তাঁরা কি এই দেশের চার কোটি গরিব মানুষের দুঃখের মর্ম বুঝতে পারবেন? ‘হে মোর দুর্ভাগা দেশ, যাদের করেছ অপমান, অপমানে হতে হবে তাহাদের সবার সমান!’

  • আনিসুল হক প্রথম আলোর ব্যবস্থাপনা সম্পাদক ও সাহিত্যিক