আমাদের জনপ্রতিনিধিরা জনগণের প্রতি এতটাই দায়বদ্ধ যে, যে কেউ সমালোচনা করলেই তেলেবেগুনে জ্বলে ওঠেন। ভাবখানা এমন, জনগণের ভোটে যেহেতু ‘নির্বাচিত’ হয়েছি, তুমি সমালোচনা করার কে?
বর্তমান সংসদের এক সদস্যের মামলায় সাংবাদিক শফিকুল ইসলাম ওরফে কাজল বহুদিন জেল খেটেছেন। জামালপুরের সাংবাদিক গোলাম রাব্বানি হত্যার প্রধান আসামি ইউপি চেয়ারম্যান ও স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতা মাহমুদুল আলম। এঁরাও আমাদের জনপ্রতিনিধি।
চট্টগ্রাম–১৬ আসনের (বাঁশখালী) সংসদ সদস্য মোস্তাফিজুর রহমানের সমালোচনা তো দূরের কথা, কোনো প্রশ্ন করাও চরম বেয়াদবি মনে করেন তিনি। তিনি গত বৃহস্পতিবার বেলা সাড়ে ১১টার দিকে ১০ জন কর্মী নিয়ে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক ও রিটার্নিং কর্মকর্তা আবুল বাসার মোহাম্মদ ফখরুজ্জামানের কাছে মনোনয়নপত্র জমা দেন। কক্ষের বাইরে তখন আরও ১০ থেকে ১২ জন কর্মী দাঁড়িয়ে ছিলেন, যা নির্বাচনী আচরণবিধির লঙ্ঘন।
এ নিয়ে ইনডিপেনডেন্ট টিভির সাংবাদিক রাকিব উদ্দিন প্রশ্ন করলে এমপি মহোদয় তাঁর দিকে তেড়ে যান ও মারধর করেন। এ সময় চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবের জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি ও চ্যানেল আইয়ের ব্যুরোপ্রধান চৌধুরী ফরিদসহ আরও কয়েকজন সাংবাদিককে ধাক্কা দেন মোস্তাফিজ ও তাঁর কর্মীরা।
সাংবাদিক রাকিব উদ্দিন তাঁর কাছে শুধু জানতে চেয়েছিলেন, আপনি যে এতসংখ্যক দলীয় কর্মী-সমর্থক নিয়ে মনোনয়নপত্র জমা দিতে এলেন, সেটা আচরণবিধি ভঙ্গ কি না। আর যায় কোথা, কর্মী-সমর্থকদের নিয়ে তিনি সেই সাংবাদিকের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লেন।
মোস্তাফিজুর রহমান কাজটি করতে পেরেছেন সংসদ সদস্য পদে বহাল থাকার কারণে। এ কারণেই রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা এক সংসদ বহাল রেখে আরেকটি সংসদের নির্বাচনের যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। পঞ্চদশ সংশোধনীর আগপর্যন্ত সংসদ ভেঙে দেওয়ার পরই পরবর্তী সংসদের নির্বাচন হতো।
সাংবাদিককে মারধরের অভিযোগে চট্টগ্রাম-১৬ (বাঁশখালী) আসনে আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী মোস্তাফিজুর রহমানকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হয়েছে। তাঁকে রিটার্নিং কর্মকর্তার অফিস তলব করলেও তিনি আসেননি। পাঁচজন সহযোগীকে পাঠিয়েছেন। অথচ অভিযোগটি সরাসরি তঁার বিরুদ্ধে। তিনি জানেন সাংবাদিক মারলে কিছু হয় না।
চলতি বছরের ২৩ মে প্রথম আলোয় খবর বের হয়েছিল, পিস্তল হাতে নিয়ে মিছিল করেছেন চট্টগ্রাম-১৬ (বাঁশখালী) আসনের সংসদ সদস্য মোস্তাফিজুর রহমান চৌধুরী। মনোনয়নপত্র জমা দিয়েই যে প্রার্থী প্রশ্ন করার দায়ে সাংবাদিককে মারধর করতে পারেন, পুনর্নির্বাচিত হওয়ার পর তাঁর রোষ ও জোশ আরও বেড়ে যাবে।
ককটেল বিস্ফোরণ, বোমা হামলা ও পরিবহনে আগুন দেওয়া ইত্যাদি বাংলাদেশের রাজনীতির অনুষঙ্গ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিরোধী দলের নেতা–কর্মীদের বিরুদ্ধে সরকারি দলের এসবের অভিযোগ আমরা নিয়মিতই দেখছি। তাই বলে সরকারি দলও পিছিয়ে থাকবে কেন? সম্প্রতি ভোলার লালমোহনে এক ছাত্রলীগ নেতার বাসায় ‘বোমা বানাতে গিয়ে’ বিস্ফোরণে ‘কারিগর’ নিহত হন। এ রকম আর কত কারিগর আছে দেশে, তা অনুসন্ধান করা জরুরি।
বৃহস্পতিবার শরীয়তপুরের নড়িয়ায় শতাধিক ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী ও স্বতন্ত্র প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যকার সংঘাতে। এতে দুই পক্ষের পাঁচজন আহত হন। এ ঘটনায় পুলিশ বাদী হয়ে বিস্ফোরক দ্রব্য আইনে অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিদের আসামি করে একটি মামলা করেছে। কিন্তু কাউকে গ্রেপ্তার করার খবর পাওয়া যায়নি।
শরীয়তপুর-২ আসনে (নড়িয়া-সখীপুর) আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েছেন বর্তমান সংসদ সদস্য ও পানিসম্পদ উপমন্ত্রী এনামুল হক শামীম। স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন যুবলীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য খালেদ শওকত আলী। পুলিশ ও স্থানীয় লোকজনের বরাতে জানা যাচ্ছে, দুই পক্ষের সমর্থকেরা সংঘর্ষে জড়ালে উভয় পক্ষই এ ককটেল বিস্ফোরণ ঘটায়।
আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃত্ব বিএনপিবিহীন নির্বাচনকে প্রতিযোগিতামূলক দেখাতে স্বতন্ত্র প্রার্থীদের উৎসাহিত করছেন। তাঁরা বলেছেন, বিনা ভোটে জয়ী হওয়া যাবে না। এখন দেখা যাচ্ছে ভোটের আগেই প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের মধ্যে অন্য ধরনের প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে গেছে।
বিএনপির হরতাল বা অবরোধ কর্মসূচির সময় কোথাও ককটেল ফাটলে সরকার একে সন্ত্রাসী ঘটনা হিসেবে আখ্যায়িত করে এবং পুলিশ বাড়ি বাড়ি বাড়ি তল্লাশি চালিয়ে নেতা–কর্মীদের গ্রেপ্তার ও রিমান্ডে নিয়ে থাকে। কিন্তু একটি নির্বাচনী এলাকায় যখন নৌকা ও দলীয় স্বতন্ত্র প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে শতাধিক ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটল, তখন তারা কী করবে? আক্রান্ত ও আক্রমণকারী একই দলের। কাকে ধরবে? বিএনপি ককটেল ফাটালে যদি সেটা সন্ত্রাসের প্রতীক হয়, আওয়ামী লীগ ঘটালে তা শান্তি ও উন্নয়নের প্রতীক হয়ে যায় না।
বিএনপির যেসব নেতা সরকার ও আওয়ামী লীগের কঠোর সমালোচনা করতেন, শাহজাহান ওমর ছিলেন তাঁদের অন্যতম। তিনি এখন আওয়ামী লীগ প্রার্থী হিসেবে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে অংশ নিচ্ছেন ঝালকাঠি-১ আসন থেকে।
শাহজাহান ওমরকে গত ৪ নভেম্বর রাতে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। পরদিন তাঁকে ঢাকার নিউমার্কেট থানায় বাসে আগুন দেওয়ার একটি মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে আদালতে হাজির করা হয়। ওই মামলায় তাঁকে তিন দিন রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদও করে পুলিশ।
গত বুধবার ঢাকার প্রথম অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালত থেকে জামিন পান শাহজাহান ওমর। পরদিনই সংবাদ সম্মেলন করে এই সাবেক সেনা কর্মকর্তা ও বিএনপি সরকারের সাবেক প্রতিমন্ত্রী শাহজাহান ওমর নির্বাচনে যাওয়ার ঘোষণা দেন।
আওয়ামী লীগ প্রথমে এই আসনে বর্তমান সংসদ সদস্য বজলুল হক হারুনকে মনোনয়ন দিয়েছিল। পরে তাঁর মনোনয়ন বাতিল করে সাবেক বিএনপির নেতাকে বেছে নেয়।
এর মাধ্যমে আওয়ামী লীগ এটাই প্রমাণ করল যে তাদের বর্তমান সংসদ সদস্যদের চেয়ে বিএনপি থেকে আসা নেতারা মেধা ও যোগ্যতায় অনেক ওপরে। না হলে কয়েক দিন আগেও যাঁকে বাসে আগুন দেওয়ার ঘটনায় রিমান্ডে নেওয়া হয়েছিল, তাঁকে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী করা হবে কেন? আগুন–সন্ত্রাসের দায়ে অভিযুক্ত নেতা নৌকায় চড়ে নিজেকে শুদ্ধ করে নিলেন!
আওয়ামী লীগ নেতারা অনেক দিন ধরেই বলে আসছিলেন, চমক আছে। এরপর বিএনপির অনেক নেতার নাম বাতাসে ভাসছিল। কিন্তু তাঁদের কেউ বিএনপি ছেড়ে আওয়ামী লীগ কিংবা কিংস পার্টিতে যাননি। যাঁরা গেছেন, তাঁদের কেউ গুরুত্বপূর্ণ ভাবেননি। এই প্রথম একজন বিএনপির নেতাকে সরকার জেলখানা থেকে বের করে এনে নৌকায় ওঠাল।
২৮ অক্টোবরের ঘটনা সম্পর্কে শাহজাহজাহান ওমর বলেছেন, ‘আমরা যাঁরা মঞ্চে ছিলাম, সেদিনের ঘটনার দায় তাঁদের ওপর চাপানো যায় না। তাহলে মঞ্চে আসীন বিএনপির অন্য নেতাদেরও ছেড়ে দিতে হয়। কিন্তু মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার তারিখ তো চলে গেছে।’
● সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি
sohrabhassan55@gmail.com