‘সর্বনাশের পর হম্বিতম্বি’ শিরোনামটি পড়ে আপনাদের কী মনে হয়েছে জানি না। কিন্তু আমার কাছে এই তিন শব্দে বেইলি রোডের মর্মান্তিক আগুনে ৪৬ জনের প্রাণহানির পর দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ ক্ষমতাবানদের হঠাৎ দাপট দেখানোর প্রতিযোগিতা শুরুর একটি যথাযথ প্রতিফলন আছে।
রাজধানীর ভবনগুলোর নকশাগত ত্রুটি এবং কোন কাজে ভবন ব্যবহৃত হচ্ছে, তা দেখার দায়িত্ব রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক)। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, অনুমোদনহীনভাবে রেস্তোরাঁ পরিচালনার জন্য ও আগুনের ঝুঁকি বিবেচনায় ভবন তালাবদ্ধ করা এবং কথিত লঙ্ঘনকারীদের গ্রেপ্তারে এগিয়ে আছে পুলিশ। তারা যে রাজউকের তত্ত্বাবধানে কাজটি করেছে, তা নয়।
আলাদাভাবে রাজউকেরও একটি অভিযান চলছে। সমান্তরালে আরেকটি অভিযান চালাচ্ছে সিটি করপোরেশন। ২০১৯ সালের বনানীর এফ আর টাওয়ারের আগুনে ২৭ জনের মৃত্যুর পর পাঁচ বছর এ তিন কর্তৃপক্ষের কেউ কোনো অভিযান চালিয়েছেন বলে জানা যায় না।
রাজউকের ভবন পরিদর্শকেরা বিচ্ছিন্নভাবে হয়তো দু-একটা অভিযান চালিয়েও থাকতে পারেন। কিন্তু এখন যেভাবে কাজ হচ্ছে, তার সঙ্গে তুলনীয় কিছু হয়নি। অথচ গত পাঁচ বছরে রাজধানীতে রেস্তোরাঁর সংখ্যা দ্বিগুণ হয়েছে বলে অনুমান করা হলেও খুব একটা ভুল হবে বলে মনে হয় না। আবার শুধু প্রচলিত অর্থে রেস্তোরাঁ নয়, অনেক ভবনে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে খাবার সরবরাহের হেঁশেলও খোলা হয়েছে।
কোভিড-উত্তর ঢাকায় রেস্তোরাঁ ব্যবসা, বিশেষ করে উচ্চবিত্ত ও উচ্চমধ্যবিত্তের জন্য বিশেষ বিশেষ খাবারের দোকান নাটকীয়ভাবে বেড়েছে। হৃদ্রোগের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে উচ্চমাত্রার স্নেহজাতীয় খাবারের রেস্তোরাঁ খোলা হয়েছে। আর মহানগরীর সম্প্রসারণ যখন ঊর্ধ্বমুখী হওয়া ছাড়া বিকল্প নেই, তখন বহুতল ভবন ছাড়া রেস্তোরাঁ খোলার বিকল্প জায়গা কই?
চাহিদার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে সরবরাহের ব্যবস্থা না থাকায় যেভাবে কালোবাজারি ও মুনাফাবাজি হয়, এ ক্ষেত্রেও তার কোনো ব্যতিক্রম ঘটেনি। ভবনমালিকেরা বাড়তি চাহিদার সুযোগ নিয়ে বেআইনিভাবে আবাসিক কিংবা অফিস ভবনেও বাণিজ্যিক হেঁশেল খুলতে দিয়েছেন। এসব অন্যায়–অনিয়ম সবার চোখের সামনেই হয়েছে, কিন্তু কেউ আইন প্রয়োগের তাড়না অনুভব করেনি।
পুলিশ কখনো এককভাবে দেশের কোথাও ভবনের নিরাপত্তা যাচাইয়ের কোনো অভিযান পরিচালনা করেছে বলেও শোনা যায়নি। প্রকৌশলবিদ্যায় বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি নিয়ে অনেকে পুলিশের চাকরিতে যোগ দেন বলে জানা যায়, কিন্তু তাঁরা সবাই যে ভবন নির্মাণে বিশেষজ্ঞ, সেটা নিশ্চিত করে বলা যাবে না।
তাহলে তাঁরা এখন যে অভিযান চালাচ্ছেন, এর ভিত্তি কী? গ্রেপ্তারের সংখ্যা দেখে তো মনে হয় ভবনবিষয়ক আইন লঙ্ঘনের সন্দেহে সেখানে যাঁরা নিতান্ত পেটের দায়ে চাকরি করতে গেছেন, তাঁদেরও ঝাড়ে-মূলে আটক করা হয়েছে। প্রথম আলোর খবর অনুযায়ী সোম, মঙ্গল ও বুধবার—তিন দিনে প্রায় ১ হাজার ৫০ জনকে আদালতে হাজির করেছে পুলিশ।
রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের দমন-পীড়নে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এবং আদালতের ওপর যে চাপ তৈরি করা হয়েছে, তাতে ভবন নির্মাণ আইন লঙ্ঘনের অপরাধীর বিচার তো অগ্রাধিকার পাওয়ার কথা নয়। রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের ধরপাকড়ের অভিযান আর বিচারের জন্য রাতের বেলায় আদালত বসানো যে সরকারের কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ, তার প্রমাণ তো ইতিমধ্যেই মিলেছে।
ভবনমালিকেরা গ্রেপ্তার হলেন না, রেস্তোরাঁমালিকেরাও অধিকাংশই আত্মগোপনে চলে গেলেন, কিন্তু সব দোষ কেষ্ট ব্যাটাদের, যারা ঝুঁকি মাথায় নিয়ে কষ্ট করে অতিথিদের জন্য রান্না করে, সেবা দেয়। তারা বললেও কি মালিকেরা কথা শুনতেন? পোশাক কারখানার অভিজ্ঞতা কী বলে? পোশাক কারখানায় আগুনের জন্য কি পোশাকশ্রমিকদের দায়ী করা সম্ভব? তাহলে বাবুর্চি আর অন্য কর্মীদের হয়রানি কেন?
অবশ্য নিম্ন আয়ের দেশ থেকে মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হওয়ার প্রক্রিয়ায় এখন বাবুর্চিদের শেফ বলে পরিচয় দেওয়ার রেওয়াজ পুরোদস্তুর চালু হয়ে গেছে। অর্থনীতির এই অগ্রযাত্রায় গড় আয় বৃদ্ধির ভাগ পেতে ভবনমালিক, ব্যবসায়ী এবং উপরি আয়ের দাবিদার সরকারি কর্মচারীরাও যে প্রতিযোগিতায় শরিক হবেন, তাতে অবাক হওয়ার কিছু নেই।
অতএব সব অনিয়মই নিয়ম হয়ে যায়, যতক্ষণ না একটা বড় অঘটন ঘটে। রাজউক কিংবা সিটি করপোরেশনের মতো সেবামুখী প্রতিষ্ঠানে যাঁরা কোনো ফাইলের পেছনে ঘুরেছেন, তাঁরা জানেন কীভাবে কী হয়।
এখন রেস্তোরাঁয় দুর্ঘটনার কারণে অভিযান হচ্ছে রেস্তোরাঁর বিরুদ্ধে। কিন্তু বাণিজ্যিক ভবনগুলোর ত্রুটি দূর কি করা হবে? পুরু কাচের দেয়ালে ঘেরা ঝকঝকে ভবনগুলো শীতাতপব্যবস্থার কারণে যেভাবে আবদ্ধ থাকে, তাতে দুর্ঘটনার সময় সেখান থেকে বেরোনোর কোনো বিকল্প নেই।
বহুতল আবাসিক ভবনগুলোর বেলাতেও অনেক ক্ষেত্রে এ প্রশ্ন তোলা যায়। কেউ কেউ দাবি করেছেন, রাজধানীর ৯০ শতাংশ ভবন অনিরাপদ। এগুলো নিরাপদ করার জন্য তো কোনো অভিযান হচ্ছে না? নাকি আরেকটি এফ আর টাওয়ারের মতো ঘটনা ঘটলে আবার সবাই একটু নড়েচড়ে উঠবেন? কর্তৃপক্ষের হম্বিতম্বি দেখা যাবে?
প্রথম আলোর খবরেই রাজধানীর সবচেয়ে জনপ্রিয় ও পুরোনো কয়েকটি বিপণিবিতানের নাম উল্লেখ করে জানানো হয়েছে যে সরকারি টাস্কফোর্স এগুলোকে উচ্চ ঝুঁকির হিসেবে চিহ্নিত করেছে। এক বছর আগে নিউ সুপার মার্কেটের আগুনের পর গঠিত টাস্কফোর্স এসব বিপণিকেন্দ্র চিহ্নিত করলেও কোনোটিই ত্রুটিমুক্ত হয়নি।
এরপর বঙ্গবাজারের আগুনের ঘটনার পরও কিছুদিন বেশ কথাবার্তা হয়েছে, যদিও সে আবেগ বেশি দিন টেকেনি। আগুন নেভানোর জন্য সবচেয়ে জরুরি পানির উৎস বাড়ানোর কথা তখনো বেশ জোরেশোরে আলোচনা হয়েছে, কিন্তু রাস্তার ধারে বা কোনো মহল্লায় ওয়াসা ফায়ার হাইড্রেন্টের ব্যবস্থা করেছে বলে জানা যায় না।
দুই দিন আগে সমকাল ‘রাজউকের ইন্সপেক্টররা এক একজন “জামাই”’ শিরোনামে ছাপানো খবরে ডজনখানেক ভবন পরিদর্শকের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট দুর্নীতির অভিযোগ তুলে ধরেছে। ওই প্রতিবেদনের আরও বিস্ময়কর তথ্য হচ্ছে, বনানীর এফ আর টাওয়ারের আগুনের ঘটনায় সরকারি তদন্তে দোষী সাব্যস্ত হওয়া পরিদর্শক দায়মুক্তি এবং পদোন্নতি পেয়ে রাজউকে প্রধান পরিদর্শক হয়েছেন।
ওই মর্মান্তিক দুর্ঘটনার সময়ে গণপূর্তমন্ত্রীর দায়িত্ব পালনকারী শ ম রেজাউল করিম গত রোববার বলেছেন, ‘তদন্ত করে ৬২ জনের বিরুদ্ধে আমরা রিপোর্ট দিয়েছিলাম। দুর্ভাগ্য, সর্বোচ্চ পর্যায়ের একটি কমিটি রিপোর্ট দেওয়ার পরও সবার বিরুদ্ধে মামলা হয়নি। তারপর চার্জশিট দেওয়ার সময় অনেককে বাদ দেওয়া হয়েছে। এখানেই শেষ নয়, আজ পর্যন্ত সে মামলার অভিযোগ গঠন পর্যন্ত হয়নি।’
যদিও পরের বছরেই শ ম রেজাউল করিমকে গণপূর্ত মন্ত্রণালয় থেকে সরিয়ে অন্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেওয়া হয়, তবু তাঁর বক্তব্যে তদন্তে অভিযুক্ত ব্যক্তিরা কীভাবে দায়মুক্তি পেলেন, এর কোনো ব্যাখ্যা মেলে না। তিনি আরও জানিয়েছেন, তাঁরা সে সময় ১ হাজার ৩০০ ভবন চিহ্নিত করেছিলেন, যেগুলোর অধিকাংশ ফ্লোর অননুমোদিতভাবে করা হয়েছে, কিন্তু সে ভবনগুলো ভাঙা সম্ভব হয়নি।
তিনিই একে ‘একপ্রকার দায়মুক্তি দেওয়া’ বলে অভিহিত করেছেন। রাজনীতিকেরা যখন দায়মুক্তি দেওয়ার বিষয়টি বুঝতে পারেন, স্বীকার করেন, তখন এর দায় তো তাঁদের ওপরেই বর্তানোর কথা। কিন্তু আমরা কারও মুখ থেকেই এ রকম গুরুতর ব্যর্থতার জন্য দুঃখ প্রকাশ করতেও শুনিনি, পদত্যাগ তো দূরের কথা।
এ ধরনের প্রতিটি দুর্ঘটনার পর নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে অনেকেই সোচ্চার হন, নানা রকম সুপারিশ ও দাবি জানানো হয়। এবারও তার ব্যতিক্রম ঘটছে না। কিন্তু এতে কর্তৃপক্ষের জবাবদিহি মিলছে না। গণতান্ত্রিক কাঠামোয় রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানে জবাবদিহির কার্যকর ব্যবস্থা ছাড়া তা মিলবেও না।
সংসদের বিরোধী দল যদি সরকারের অংশ হয়, কিংবা সরকারের কৃপার ওপর তাদের নির্বাচিত হওয়া না-হওয়া নির্ভর করে, তাহলে কারও কাছে জবাবদিহির প্রয়োজন ক্ষমতাসীনেরা কেন অনুভব করবে?
রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের দমন-পীড়নে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এবং আদালতের ওপর যে চাপ তৈরি করা হয়েছে, তাতে ভবন নির্মাণ আইন লঙ্ঘনের অপরাধীর বিচার তো অগ্রাধিকার পাওয়ার কথা নয়। রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের ধরপাকড়ের অভিযান আর বিচারের জন্য রাতের বেলায় আদালত বসানো যে সরকারের কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ, তার প্রমাণ তো ইতিমধ্যেই মিলেছে।
● কামাল আহমেদ সাংবাদিক