নির্বাচন সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য না হলে ভিসা–নিষেধাজ্ঞার আগাম ঘোষণা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। যেসব বাংলাদেশি আগামী নির্বাচনকে বাধাগ্রস্ত করবে, তাঁদের ভিসা প্রত্যাখ্যান করবে যুক্তরাষ্ট্র। বাংলাদেশে অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত করার লক্ষ্যে নতুন ভিসা নীতি ঘোষণা করেছে যুক্তরাষ্ট্র।
গণতান্ত্রিক নির্বাচনপ্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করে, এমন কাজের সংজ্ঞার মধ্যে রয়েছে চারটি স্তর। এক. ভোটারদের ভয় দেখানো, দুই. ভোট কারচুপি, তিন. সহিংসতার মাধ্যমে জনগণকে সংগঠিত হওয়ার স্বাধীনতা, শান্তিপূর্ণ সমাবেশের অধিকার প্রয়োগ করতে বাধা দেওয়া এবং চার. বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে রাজনৈতিক দল, ভোটার, সুশীল সমাজ বা গণমাধ্যমকে তাদের মতামত প্রচার করা থেকে বিরত রাখা।
মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন বলেছেন, ‘অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের দায়িত্ব ভোটার, রাজনৈতিক দল, সরকার, নিরাপত্তা বাহিনী, সুশীল সমাজ, গণমাধ্যমসহ সবার। যারা বাংলাদেশে গণতন্ত্রকে এগিয়ে নিতে চায়, তাদের সবাইকে আমাদের সমর্থন দিতে আমি এই নীতি ঘোষণা করছি।’
ঘোষণার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লু চ্যানেল-আই তৃতীয় মাত্রায় বলেছেন, এটা সম্ভাব্য নিষেধাজ্ঞা নীতি, যা এখনো কারও ওপর প্রয়োগ হয়নি, যারা নির্বাচনকে বাধাগ্রস্ত করতে আদেশ প্রদান করবে এবং যারা আদেশ বাস্তবায়ন করবে, তাদের সবার ওপরই ভবিষ্যতে প্রয়োগ করা হবে। সরকার ও বিরোধী দল উভয়কেই এর আওতায় রাখা হয়েছে।
মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের বিবৃতিমতে, ৩ মে বাংলাদেশ সরকারকে সিদ্ধান্তটির কথা জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। এ সময় প্রধানমন্ত্রী যুক্তরাষ্ট্র সফরে ছিলেন এবং ওই বিশেষ দিনে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রসচিবের সঙ্গে রাজনীতিবিষয়ক মার্কিন আন্ডারসেক্রেটারি ভিক্টোরিয়া নুল্যান্ডের বৈঠক হয়। পরদিন ৪ মে যুক্তরাজ্য সফরে এসে বিবিসিকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে যুক্তরাষ্ট্রের কড়া সমালোচনা করেন প্রধানমন্ত্রী। ১৪ মে যুক্তরাষ্ট্রসহ ছয় দেশের রাষ্ট্রদূতের পুলিশ এসকর্ট–সুবিধা বাতিল করা হয়। ১৫ মে সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা দেন, ‘যারা আমাদের নিষেধাজ্ঞা দেয়, তাদের কাছ থেকে আমরা কিছু কিনব না।’
নিষেধাজ্ঞা কোনো দেশের বর্তমান ও ভবিষ্যতের জন্য সুখকর বিষয় নয়। মানবাধিকার, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও গণতন্ত্র সামনে রেখে দেওয়া যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞায় নিজের কৌশলগত ও ভূরাজনৈতিক লক্ষ্যভেদী স্বার্থ থাকে। ফলে নিষেধাজ্ঞা পাওয়া কোনো দেশের মানুষ ও তার অর্থনীতি সত্যিকার অর্থেই ভালো নেই। এ অবস্থায় সরকারের মধ্যে ব্যাপকতর শুভবোধ আশা করি।
মার্কিন ভিসা নিষেধাজ্ঞা নীতির তাৎপর্যকে একাধিক ধারায় ব্যাখ্যা করার সুযোগ রয়েছে:
ভিসা নিষেধাজ্ঞার আগাম ঘোষণা দেশের সুশীল সমাজকে ভয়ের সংস্কৃতি এবং সেলফ সেন্সরশিপ থেকে সরে আসতে উদ্বুদ্ধ করবে। সুশীল সমাজের যে অংশ সরকারের প্রতি সহানুভূতিশীল থেকে রাজনৈতিক বয়ান তৈরি করত, অবধারিতভাবে তাদের রাজনৈতিক ব্যাখ্যার পরিবর্তন আসবে। এবং নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের জন্য প্রকাশ্য অবস্থান নিতে ব্যাপকভাবে উৎসাহ জোগাবে।
পাশাপাশি ভয়ের সংস্কৃতি এবং ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের বাড়াবাড়ির কালে ক্ষয়িষ্ণু সুশীল সমাজে নতুন করে প্রাণ সঞ্চার হবে। রাজনীতিতে ‘সফট পাওয়ার’ (আদর্শিক শক্তি) তৈরির কাজে সুশীল সমাজ আগের চেয়ে অধিকতর কার্যকর ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবে।
নতুন ভিসা নীতিতে বলা হয়েছে, ভিসা বিধিনিষেধ আরোপের শিকার হবেন বাংলাদেশের সাবেক ও বর্তমান কর্মকর্তা-কর্মচারী, সরকারপন্থী ও বিরোধী রাজনৈতিক দলের সদস্য এবং আইন প্রয়োগকারী, বিচার বিভাগ ও নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা।
এর মাধ্যমে সিকিউরিটি সার্ভিস বা নিরাপত্তা বাহিনীসহ দেশের রাজনৈতিক নেতৃত্ব, প্রশাসন ও নির্বাহী বিভাগ এবং বিচার বিভাগের সংশ্লিষ্ট সবাইকে সম্ভাব্য ভিসা নিষেধাজ্ঞার আওতাভুক্ত করে শক্ত বার্তা দেওয়া হয়েছে।
ফলে নতুন ভিসা নীতি জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী বাহিনীতে অংশগ্রহণকারী সামরিক বাহিনী, পুলিশ, আমলাতন্ত্র, বিচার বিভাগসহ সবাইকে শঙ্কিত রাখবে এবং বিরোধীদের প্রতি আক্রমণাত্মক হওয়ার ধারা থেকে সংযত করবে।
মার্কিন ভিসা নিষেধাজ্ঞা নীতির সুস্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, দায়ী ব্যক্তিদের পরিবারের সদস্যরাও (ইমিডিয়েট রিলেটিভ) ভিসা নিষেধজ্ঞায় অন্তর্ভুক্ত হবেন। সুস্পষ্টভাবে এখানে বাংলাদেশের রাজনৈতিক নেতা ও আমলাদের বেগমপাড়াকেন্দ্রিক ডলার পাচার, যুক্তরাষ্ট্রে বৈধ কিংবা অবৈধভাবে অর্থ প্রেরণ এবং তাঁদের পরিবারের সদস্যদের সুখের জীবনে ছেদ টেনে ভিসাসংক্রান্ত টানাপোড়েন সৃষ্টির বিষয়ে ইঙ্গিত আছে।
নতুন ভিসা নীতি বাংলাদেশের প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ অর্থাৎ এফডিআই প্রবাহে নেতিবাচক ধারা তৈরি করতে পারে। মার্কিন নিষেধাজ্ঞাকে সাধারণত পশ্চিমা দেশগুলো অনুসরণ করে। ফলে কানাডা, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ ব্রিটেন ও অস্ট্রেলিয়া থেকে বিনিয়োগপ্রবাহ কমে আসতে পারে।
বিগত বছরে সৌদি আরবকে হটিয়ে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের প্রধানতম রেমিট্যান্স উৎস হয়ে উঠেছে। সম্ভাব্য ভিসা নিষেধাজ্ঞায় যুক্তরাষ্ট্র থেকে বাংলাদেশে প্রবাসী আয় কমে আসতে পারে। অর্থাৎ স্বচ্ছ নির্বাচনে সরকারের অনীহা, কারচুপিরনির্ভর দলীয় নির্বাচনের যে একগুঁয়েমি, তাঁর ফলে দেশের সংকটময় অর্থনীতিতে আরও বেশি নেতিবাচক ধারা তৈরি হতে পারে।
নতুন ভিসা নীতি বাংলাদেশের ভূরাজনীতির মেরুকরণে পক্ষ নিতে বাধ্য করতে পারে।
আপাতদৃষ্টে মনে হচ্ছে, সরকারের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বোঝাপড়া ভেস্তে গেছে। তবে ভেতরে ভেতরে সরকারের ওপর কোয়াডে যুক্ত হওয়ার, মার্কিন ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজি সমঝোতা, জিসোমিয়া এবং আকসা চুক্তিগুলো স্বাক্ষরের তীব্র চাপ তৈরি হলো। যেহেতু বাংলাদেশে দলীয় সরকারের অধীনে স্বচ্ছ নির্বাচনের কোনো ইতিহাস নেই, তাই সরকার আগেই সতর্ক হয়ে শুভবোধ জাগ্রত করে নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের পথে হাঁটলে স্বাভাবিকভাবেই সম্ভাব্য মার্কিন চাপ কমে আসবে। কিন্তু একগুঁয়েমি করে বলপ্রয়োগে নিজেদের অধীনেই অস্বচ্ছ নির্বাচন করতে হলে, সরকারকে চীন রাশিয়ার বলয়ে ভেড়ার অনিশ্চয়তার পথে হাঁটতে হতে পারে। চীন ও ভারতকে পাশে পেতে দেশের দীর্ঘমেয়াদি কৌশলগত স্বার্থ পরিপন্থী চুক্তির ক্ষেত্রও দুঃখজনকভাবে প্রসারিত করতে পারে।
পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে, সরকার কেন্দ্র থেকে চাইলেও আঞ্চলিক প্রার্থীদের দুর্বৃত্তপনার কারণে সরকারের পক্ষে স্বচ্ছ নির্বাচন অসম্ভব। এতে দেশে চরম অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি হয়ে রাজনৈতিক সংকট যেমন ঘনীভূত হতে পারে, তেমন অর্থনৈতিক সংকটও সুতীব্র হবে, কেননা বাংলাদেশের রপ্তানি ওরেমিট্যান্স ডলারের প্রধানতম উৎস যুক্তরাষ্ট্র এবং এর মিত্রদেশগুলো। নতুন ভিসা নীতির পরোক্ষ বার্তা হচ্ছে, রপ্তানি বাজারের ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তাও।
ভিসা নীতির আরেকটি তাৎপর্য হচ্ছে, সরকার প্রশাসন এবং আমলাতন্ত্রের বিবদমান পক্ষগুলো প্রতিপক্ষের নির্বাচনী জালিয়াতির সংশ্লিষ্টতা ফাঁস করে একে অন্যের বিদেশ গমনে বাধা সৃষ্টি করতে পারে। পাশাপাশি নতুন ভিসা নীতি বাংলাদেশের গণমাধ্যম জগতেও একটি ইতিবাচক বার্তা দেবে। সরকারের পক্ষে সংবাদ ও ভাষ্য তৈরি, প্রোপাগান্ডা ছাড়ানো, সেলফ সেন্সরশিপ করে স্বচ্ছ নির্বাচনে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ বাধা দান কিংবা মিডিয়া ব্ল্যাকআউটের বিষয়গুলো কিছুটা হলেও কমে আসবে।
নিষেধাজ্ঞা কোনো দেশের বর্তমান ও ভবিষ্যতের জন্য সুখকর বিষয় নয়। মানবাধিকার, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও গণতন্ত্র সামনে রেখে দেওয়া যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞায় নিজের কৌশলগত ও ভূরাজনৈতিক লক্ষ্যভেদী স্বার্থ থাকে। ফলে নিষেধাজ্ঞা পাওয়া কোনো দেশের মানুষ ও তার অর্থনীতি সত্যিকার অর্থেই ভালো নেই। এ অবস্থায় সরকারের মধ্যে ব্যাপকতর শুভবোধ আশা করি।
পাশাপাশি এক ব্যক্তির হাতে কুক্ষিগত অন্যায় ক্ষমতাকাঠামোয় ভারসাম্য এনে এবং ক্ষমতা বিকেন্দ্রীকরণের উদ্যোগ নিয়ে স্থায়ী সমাধানের পথে হাঁটা, যাতে নিরঙ্কুশ রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক ক্ষমতা বাংলাদেশে নতুন করে সাংবিধানিক স্বৈরাচার সৃষ্টি না করে এবং বারবার ভোট জালিয়াতির অবৈধ সরকারের সংকট তৈরি না হয়।
প্রায় ১৮ কোটি মানুষের দারিদ্র্য ও জলবায়ু ঝুঁকিপ্রবণ দেশটি আর কোনো রাজনৈতিক অস্থিরতা প্রত্যাশা করে না, আমাদের সময় হয়েছে রাষ্ট্র ও রাজনীতি সংস্কারের এবং সক্ষম প্রতিষ্ঠান গড়ার। পাশাপাশি আমাদের দরকার একটি নতুন সামাজিক সনদ, যেখানে রাজনীতিবিদেরা সমাজ ও মানুষের সঙ্গে কীভাবে ন্যায়নিষ্ঠ ও সাম্যভিত্তিক মানবিক আচরণ করবে, প্রাতিষ্ঠানিক সুশাসন কায়েম করবে, তার বিশদ বোঝাপড়ার নতুন শপথ।
ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব টেকসই উন্নয়নবিষয়ক লেখক। গ্রন্থকার: চতুর্থ শিল্পবিপ্লব ও বাংলাদেশ; বাংলাদেশ: অর্থনীতির ৫০ বছর; অপ্রতিরোধ্য উন্নয়নের অভাবিত কথামালা; বাংলাদেশের পানি, পরিবেশ ও বর্জ্য। faiz.taiyeb@gmail.com