মতামত

সংবিধানের যে ভুল সংশোধন না করলে রাষ্ট্র সংস্কার অসম্ভব

বক্ষ্যমাণ কলামটি লিখছি সংবিধান সংস্কার কমিশনের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য। গোড়াতেই বলছি, আমি সংবিধান পুনর্লিখনের পক্ষে নই, সংস্কারের পক্ষে। 

অনেকের মনে ভুল ধারণা গেড়ে বসে রয়েছে যে বাংলাদেশের সংবিধান অত্যন্ত ভালো একটি সংবিধান। আমি ধারণাটির বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে বহু বছর আগে থেকেই দৃঢ়ভাবে বলে চলেছি, আমাদের সংবিধানে এমন কতগুলো মারাত্মক ত্রুটি রয়ে গেছে কিংবা নতুনভাবে যুক্ত হয়েছে, যেগুলো এ দেশের রাষ্ট্রচরিত্রকে স্বৈরাচারী ও গণবিরোধী একনায়কত্বে পরিণত করছে বারবার। বক্ষ্যমাণ কলামে আমি ত্রুটিগুলো সংক্ষেপে ব্যাখ্যা করছি।

১. সংবিধানের প্রধান ত্রুটি ৭০ ধারার বিধানটি। সরকারি দল হোক কিংবা বিরোধী দল, সব দলের নির্বাচিত সংসদ সদস্যদের ওপর দলীয় প্রধানের একচ্ছত্র ক্ষমতা প্রয়োগের ধারাটি সদস্যদের ভিন্নমত প্রকাশের স্বাধীনতাকে পুরোপুরি হরণ করে নিয়েছে। দলীয় প্রধানের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে কথা বললে কিংবা ভোট দিলে সংসদের সদস্যপদ বাতিল হওয়ার এই বিধান সংসদকে একেবারেই খয়ের–খাঁর ফোরাম করে ফেলেছে। অতএব ৭০ ধারার বিধানটি সংশোধন করে শুধু ‘নো-কনফিডেন্স মোশনের’ ক্ষেত্রে দলকে সমর্থন করার বাধ্যবাধকতা বহাল রেখে অন্য সব আইন প্রণয়ন ও মতপ্রকাশের ক্ষেত্রে বিধিনিষেধ তুলে দেওয়ার ব্যবস্থা করতেই হবে।

২. (ক) সংবিধানের আরেকটি মারাত্মক ত্রুটি হচ্ছে প্রধানমন্ত্রীকে ‘নির্বাচিত একনায়কের’ ক্ষমতা দিয়ে সর্বশক্তিমান করে ফেলার ব্যবস্থা করা। ১৯৭২ সালে যখন সংবিধানটি প্রণয়ন করা হয়, তখন প্রধানমন্ত্রীর আসনে অধিষ্ঠিত ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে সংবিধান প্রণয়ন কমিটি সংবিধানের খসড়া প্রণয়ন করে যখন সেটা বঙ্গবন্ধুর কাছে পেশ করেছিল, তখন যেখানে প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার বিষয়গুলো বর্ণিত হয়েছে, সেখানেই বঙ্গবন্ধু নিজের হাতে কেটেছেঁটে ওগুলোয় পরিবর্তন করে প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতাকে রাষ্ট্রপতির তুলনায় একচ্ছত্র (অ্যাবসলিউট অ্যান্ড আনচ্যালেঞ্জড) করার ব্যবস্থা করেছিলেন, যার ফলে রাষ্ট্রপতিকে ক্ষমতাহীন বানিয়ে ফেলা হয়েছিল।

ব্যাপারটি আমাকে বলেছিলেন ওই কমিটির সদস্য দৈনিক আজাদীর প্রয়াত সম্পাদক সর্বজনশ্রদ্ধেয় অধ্যাপক খালেদ। কমিটির কাছে কাটাকুটি করা খসড়াটি যখন ফেরত এসেছিল, কমিটির কারও সাহস হয়নি বঙ্গবন্ধুর নিজ হাতে করা পরিবর্তনের বিরুদ্ধে কিছু করার।

(খ) তারপর যখন ১৯৭৫ সালের জানুয়ারিতে সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে সংসদীয় গণতন্ত্রের পরিবর্তে রাষ্ট্রপতিশাসিত সরকারব্যবস্থা কায়েম হয়েছিল, তখন একদলীয় ‘বাকশাল’ পদ্ধতিকে শক্তিশালী করার প্রয়োজনের কথা বলে রাষ্ট্রপতিকে প্রধানমন্ত্রীর সব ক্ষমতা তো প্রদান করা হয়েছিলই, তার সঙ্গে আরও অনেক ক্ষমতা যোগ করা হয়েছিল, রাষ্ট্রপতি যাতে কথিত সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় কোনোভাবেই বাধাবিঘ্নের সম্মুখীন না হন। অতএব ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টে যখন সপরিবার বঙ্গবন্ধু নিহত হয়েছিলেন, তখন ওই অপরিসীম ক্ষমতাধর রাষ্ট্রপতির ক্ষমতাগুলো ভোগ করার সুযোগ পেয়ে গিয়েছিল ১৯৭৫-১৯৯০ সালে অবৈধভাবে রাষ্ট্রক্ষমতা জবরদখলকারী খন্দকার মোশতাক, জিয়াউর রহমান ও স্বৈরাচারী এরশাদ সরকার।

(গ) ১৯৯১ সালে নির্বাচনে জিতে প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার পর খালেদা জিয়ার প্রথম পছন্দ ছিল বিদ্যমান রাষ্ট্রপতিশাসিত সরকারব্যবস্থা বহাল রেখে দেওয়া, যার জন্য তিনি দীর্ঘ পাঁচ মাস তাঁর স্বাক্ষরিত ‘তিন জোটের রূপরেখা’ অনুসরণে সংসদীয় গণতন্ত্র পুনঃপ্রবর্তনের উদ্দেশ্যে সংবিধান সংশোধনের উদ্যোগ নেননি। কিন্তু যখন অন্তর্বর্তী সরকারের রাষ্ট্রপতি বিচারপতি সাহাবুদ্দীনের প্রবল চাপ ও বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ জনমতের কাছে নতিস্বীকার করে খালেদা জিয়া ১৯৯১ সালের আগস্টে আবার সংসদীয় গণতন্ত্র পুনঃপ্রবর্তনের সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়েছিলেন। 

তখন দ্বাদশ সংশোধনীর খসড়া প্রণয়নের ভার পড়ে ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, ব্যারিস্টার সালাম তালুকদার ও কর্নেল অলি আহমদের ওপর। এই তিনজন মিলে অত্যন্ত সুপরিকল্পিতভাবে রাষ্ট্রপতির সব ক্ষমতা সাংবিধানিকভাবে প্রধানমন্ত্রীকে দেওয়ার ব্যবস্থা সংবিধানের দ্বাদশ সংশোধনীতে অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন; বরং প্রধানমন্ত্রীর আরও অনেকগুলো অতিরিক্ত ‘প্রসিডিউরাল ক্ষমতা’ ওগুলোর সঙ্গে যুক্ত করেছিলেন এই তিনজন, যাতে প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া সেগুলো ভোগ করতে পারেন। অতএব প্রধানমন্ত্রীকে ‘সাংবিধানিক একনায়ক’ বানানোর কৃতিত্ব বিএনপির এই তিন নেতার ওপর সবচেয়ে বেশি বর্তায়। এই তিনজনের মধ্যে এখন বেঁচে আছেন শুধু অলি আহমদ। বছরখানেক আগে কর্নেল অলি এ ব্যাপারে তাঁদের ভুল স্বীকার করে পত্রিকায় বক্তব্য দিয়েছিলেন।

১৯৯৬-২০০১ মেয়াদে শেখ হাসিনা অনেকখানি গণতান্ত্রিক আচরণ মেনে চললেও ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসীন হওয়ার পর আজীবন ক্ষমতায় থাকার সর্বনাশা খায়েশ তাঁকে পেয়ে বসেছিল। বিশেষত, ২০১০ সালে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ বিচারপতিদের ৪–৩ সংখ্যাগরিষ্ঠতার রায়ের জোরে যখন তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা ‘অনির্বাচিত বিধায় অসাংবিধানিক’ বলে রায় দিলেন, তখন ওই রায়ের শেষে সংসদ চাইলে আরও দুটি নির্বাচন ওই ব্যবস্থার অধীনে করা যায় বলে আপিল বিভাগের পরামর্শকে পাশ কাটিয়ে হাসিনা সম্পূর্ণ নিজের সিদ্ধান্তে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার অধীন নির্বাচন–সংক্রান্ত সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনীটি ২০১১ সালে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে বাতিল করে দেন। 

তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার অধীন নির্বাচন অনুষ্ঠানের বাধ্যবাধকতা থেকে মুক্ত হওয়ার পর ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালে অনুষ্ঠিত তিনটি একতরফা নির্বাচনী প্রহসনের মাধ্যমে হাসিনা তাঁর আজীবন ক্ষমতায় থাকার খায়েশ পূরণের পথে এগিয়ে গিয়েছিলেন। সংবিধানের বর্তমান অবয়বে ‘সাংবিধানিকভাবে বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর প্রধানমন্ত্রী’র অফুরন্ত ক্ষমতাকে লাগাম পরানোর ব্যবস্থা না করলে রাষ্ট্র সংস্কার কি আদৌ সম্ভব হবে? বর্তমান ফরাসি সংবিধানে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার যে ভারসাম্য রয়েছে, তা এ ব্যাপারে আমাদের পথ দেখাতে পারে।

৩. আরেকটি সাংবিধানিক পরিবর্তন ‘ফরজ’ হয়ে পড়েছে; দুবারের বেশি কাউকে প্রধানমন্ত্রী হতে না দেওয়া। এর সঙ্গে আরেকটি বিষয় যোগ করা উচিত, পাঁচ বছর পরপর নির্বাচন দেওয়ার পরিবর্তে চার বছর পরপর সংসদীয় নির্বাচনের ব্যবস্থা করা।

৪. সংবিধানে নির্বাহী বিভাগের কাছে যেভাবে বিচার বিভাগকে নির্ভরশীল করে রাখা হয়েছে, তা-ও অবিলম্বে সংশোধন করতেই হবে। বিচারব্যবস্থার স্বাধীনতা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে সব স্তরের বিচারকদের নিয়োগ, বদলি, বেতন-ভাতাদি ও চাকরিচ্যুতি জুডিশিয়াল সার্ভিস কমিশনের মাধ্যমে করতে হবে, যে কমিশন গঠিত হবে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের সিদ্ধান্তে। হাইকোর্ট ও সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের বিচারপতিদের নিয়োগ প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার আওতায় রাখা যাবে না। সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের সুপারিশের ভিত্তিতে এসব নিয়োগ দেবেন রাষ্ট্রপতি, যে কাউন্সিল গঠিত হবে প্রধান বিচারপতি ও আপিল বিভাগের দুজন বরিষ্ঠ বিচারপতির সমন্বয়ে। প্রধান বিচারপতি নিয়োগ রাষ্ট্রপতির একক সিদ্ধান্তে হওয়া বাঞ্ছনীয়, তবে আপিল বিভাগের বিচারপতিদের চাকরির জ্যেষ্ঠতা লঙ্ঘন করতে না দেওয়াই কাম্য।

৫. জনগণের সরাসরি ভোটে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের ব্যবস্থা চালু করা প্রয়োজন।

৬. সংসদীয় নির্বাচনে সংখ্যানুপাতিক সদস্য নির্বাচনপদ্ধতি চালু করা যেতে পারে। প্রয়োজনে সংসদে দুটি কক্ষ রাখার ব্যবস্থা করা যেতে পারে, যেখানে সংখ্যানুপাতিক ভোটের ভিত্তিতে ১০০ সদস্যের উচ্চকক্ষের সদস্যসংখ্যা রাজনৈতিক দলগুলো পাওয়ার ব্যবস্থা রাখা যেতে পারে। রাজনৈতিক দলের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারকদের মনোনয়নে উচ্চকক্ষের সদস্যরা মনোনীত হবেন। ৩০০ সদস্যের নিম্নকক্ষে বর্তমান পদ্ধতিতে সংসদ সদস্য নির্বাচনের ব্যবস্থা অব্যাহত রাখা যেতে পারে। তবে এ ক্ষেত্রে উচ্চকক্ষ ও নিম্নকক্ষের আইন প্রণয়ন ক্ষমতার বণ্টনে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সংবিধান আমাদের পথ দেখাতে পারে।

৭. সংসদে ৫০ জন নারী সদস্যের সংরক্ষিত আসন রাখার বিধান বাদ দিয়ে এক-তৃতীয়াংশ সদস্য নারীদের জন্য সংরক্ষিত থাকতে হবে, যেখানে নারীরা সরাসরি জনগণের ভোটে নির্বাচিত হবেন। রোটেশন ভিত্তিতে প্রতিটি নির্বাচনে দেশের প্রতিটি জেলায় এক-তৃতীয়াংশ আসনে শুধু নারীদের নির্বাচন করার বিধান করতে হবে।

৮. অবিলম্বে আবার নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা ফিরিয়ে আনতে হবে। তবে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ও অন্যান্য উপদেষ্টা নিয়োগপ্রক্রিয়ার সঙ্গে বিচার বিভাগকে জড়ানো যাবে না।

৯. কমিশনের সুপারিশগুলোকে সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করার জন্য একটি গণভোট অনুষ্ঠানের প্রয়োজনও অনস্বীকার্য। পরবর্তী সময় নির্বাচিত সংসদে কমপক্ষে দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে এসব সংশোধনীকে অনুসমর্থনের (রেটিফিকেশন) মাধ্যমে আইনগত বৈধতা দিতে হবে। 

ড. মইনুল ইসলাম অর্থনীতিবিদ ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক