নির্বাচন, জাতিসংঘ ও বিদেশি হস্তক্ষেপ–বিতর্ক

বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে একটি চিঠি লিখেছেন যুক্তরাষ্ট্রের ১৪ জন কংগ্রেস সদস্য। তাঁরা এটি লিখেছেন জাতিসংঘের নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূতকে। এতে তাঁরা বাংলাদেশের আগামী নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠুভাবে অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে জাতিসংঘ নিজে যাতে এটি ‘তত্ত্বাবধান ও পরিচালনা’ করে, সে জন্য রাষ্ট্রদূতকে ব্যবস্থা নিতে বলেছেন।

এ চিঠিকে গুরুত্বহীন ভাবার কোনো কারণ নেই। জাতিসংঘের সবচেয়ে বড় অর্থ সংস্থানকারী হিসেবে এর ওপর যুক্তরাষ্ট্রের বিশেষ প্রভাব রয়েছে, পরাশক্তি হিসেবে নিয়ন্ত্রণ রয়েছে বা সমঝোতা আছে পৃথিবীর সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশের সঙ্গে। যুক্তরাষ্ট্র তাই চাইলে বাংলাদেশের নির্বাচনে জাতিসংঘকে জড়িত করার উদ্যোগ নিতে পারে। রাশিয়া বা চীনের ভেটো ক্ষমতার কারণে এমন উদ্যোগ জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের মাধ্যমে নেওয়ার সম্ভাবনা কম। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র বা অন্য কোনো দেশের উদ্যোগ অনুযায়ী এ ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণের সিদ্ধান্ত জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদও গ্রহণ করতে পারে। নিরাপত্তা পরিষদ বা সাধারণ পরিষদে প্রদত্ত ম্যান্ডেট বলে জাতিসংঘ কোনো দেশের নির্বাচন তদারকি করেছে, এমন ঘটনা সাম্প্রতিককালে ঘটেছে আফ্রিকার কয়েকটি দেশে (যেমন মালি, সুদান, সেন্ট্রাল আফ্রিকান রিপাবলিক, কঙ্গো)।

তবে এ ধরনের ঘটনার নজির এখনো কম। সিংহভাগ ক্ষেত্রে জাতিসংঘ কোনো দেশের নির্বাচনী কাজে সংযুক্ত হয়েছে বরং সেই দেশেরই অনুরোধক্রমে এবং সেই সংযুক্তি ছিল প্রধানত কারিগরি সহায়তামূলক। এসব সহায়তার মধ্যে ছিল নির্বাচন কমিশন, নির্বাচনী আদালত বা নির্বাচনী প্রশাসনের সক্ষমতা তৈরি, নির্বাচনী আইন সংস্কার, ভোটার এডুকেশন ইত্যাদি কার্যক্রম। সাধারণত সদস্যরাষ্ট্রের অনুরোধক্রমে এটি হয় বলে এতে অসম্মানজনক কিছু থাকে না। নেপালে ২০০৮ সাল থেকে জাতিসংঘ ব্যাপকভাবে এ ধরনের নির্বাচনী সহযোগিতা প্রদান করছে। 

জাতিসংঘের ভূমিকা কোনো দেশের জন্য বিব্রতকর হয়ে উঠতে পারে, যদি নির্বাচন সুষ্ঠু হলো কি না, এর সার্টিফিকেশনে বা নির্বাচনকাজ তত্ত্বাবধানে জাতিসংঘ সংযুক্ত হয়ে পড়ে। এসব দায়িত্ব পালনের অংশ হিসেবে নির্বাচনের অনুকূল পরিস্থিতি সৃষ্টিতে জাতিসংঘ তার শান্তিরক্ষা মিশনসহ অন্যান্য অফিসকেও নিয়োজিত করতে পারে। আফ্রিকার গৃহযুদ্ধজর্জর কিছু দেশে জাতিসংঘ নির্বাচন তত্ত্বাবধান ও পরিচালনার কাজে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত হয়েছে গত দুই দশকে। এমন কোনো কোনো দেশে শান্তিরক্ষা মিশনে বাংলাদেশের বাহিনীগুলোকেও অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল।

আফ্রিকার এসব দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের নিরাপত্তা পরিস্থিতি তুলনীয় নয়। তবে এ দেশে নির্বাচনব্যবস্থা এখন যেভাবে ভেঙে পড়েছে, তা কোনোভাবে উপেক্ষণীয়ও নয়। তা ছাড়া গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ও ভিন্নমত দমনের কারণেও গত কয়েক বছর বাংলাদেশে আন্তর্জাতিকভাবে বহুবার নিন্দিত হয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের আগামী নির্বাচন তদারকি প্রক্রিয়ায় জাতিসংঘ সীমিত মাত্রায় হলেও জড়িত হতে পারে, এমন সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না।

এ দেশে বিরোধী দলগুলোসহ বিপুলসংখ্যক ভোটাধিকারপ্রত্যাশী মানুষ একে স্বাগত জানাতে পারেন। তবে এটি সরকারের জন্য স্বস্তিকর হবে না।

২. 

সর্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণাসহ জাতিসংঘের যেকোনো প্রাসঙ্গিক দলিলে নির্বাচন বলতে নিয়মিত ও সাচ্চা (পিরিয়ডিক অ্যান্ড জেনুইন) নির্বাচনকে বোঝায়। এই নীতিমালার ওপর ভিত্তি করে প্রায় জন্মলগ্ন থেকে জাতিসংঘ সাবেক কলোনিগুলো এবং এর অছি পরিষদ অধিভুক্ত এলাকায় নির্বাচন পরিচালনায় যুক্ত থেকেছে। 

১৯৮০–এর দশক থেকে আফ্রিকা, এশিয়া ও দক্ষিণ আমেরিকার বিভিন্ন দেশে ভুয়া নির্বাচনের বহু ঘটনার পর জাতিসংঘ স্বাধীন রাষ্ট্রের নির্বাচন প্রক্রিয়ায়ও অংশগ্রহণ করতে থাকে। এটিকে সুসমন্বিত করার লক্ষ্যে ১৯৯১ সালে সাধারণ পরিষদ জাতিসংঘের নির্বাচনী সহযোগিতার কাঠামো বা ফ্রেমওয়ার্ক প্রতিষ্ঠা করে। সাধারণ পরিষদের সংশ্লিষ্ট বিভাগের (ডিপার্টমেন্ট অব পলিটিক্যাল অ্যান্ড পিস বিল্ডিং অ্যাফেয়ার্স) দায়িত্বপ্রাপ্ত আন্ডার সেক্রেটারি জেনারেল এই সহযোগিতা কার্যক্রমের ফোকাল পয়েন্ট হিসেবে কাজ করছেন এবং তাঁকে সার্বিক সহযোগিতা করছে ডিপার্টমেন্টটির ইলেকশন অ্যাসিস্ট্যান্ট ডিভিশন। 

যেসব দেশে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশন রয়েছে, সেখানে এই ডিভিশন মিশনের সঙ্গে নির্বাচনী সমস্যাগুলো মোচনে সমন্বিতভাবে কাজ করে। যেখানে এমন মিশন নেই, সেখানে মূলত ইউএনডিপির মাধ্যমে ডিভিশনটি কাজ করে থাকে।

এই প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো কোনো দেশের নির্বাচনপ্রক্রিয়ায় জাতিসংঘের অংশগ্রহণকে সহজতর করেছে। এমন অংশগ্রহণের বাড়তি নৈতিক প্রণোদনা সৃষ্টি হয়েছে জাতিসংঘের সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট গোলস (এসডিজি) থেকে। সুষ্ঠু নির্বাচন জাতিসংঘের বিভিন্ন এসডিজির সঙ্গে সম্পর্কিত। এর মধ্যে রয়েছে শান্তি, ন্যায়বিচার ও শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান (গোল ১৬) এবং বৈষম্য হ্রাসকরণ (গোল ১০)। নির্বাচন সম্পূর্ণভাবে একটি দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয় বলে এটি বলার সুযোগ তাই কমে আসছে। 

৩. 

সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানে জাতিসংঘ বা বিদেশি কোনো রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপকে ভালো চোখে দেখছে না সরকার, দেখার কথাও না। তবে এ বিষয়ে আওয়ামী লীগ সরকারের আপত্তির নৈতিক গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তোলার অবকাশ রয়েছে। অতীতে, বিশেষ করে ১৯৯৬ সাল ও ২০০৭-০৮ সালে এ ধরনের নজরদারির জন্য বিদেশি দূতাবাসগুলোর সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ করেছে আওয়ামী লীগসহ সে সময়ের কিছু বিরোধী দল। সর্বশেষ বিএনপি সরকারের মেয়াদ অবসানকালে নতুন নির্বাচনে কারচুপির আশঙ্কার মধ্যে বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ভারতের রাষ্ট্রদূত এবং জাতিসংঘের আবাসিক প্রতিনিধি বিভিন্ন তৎপরতার কারণে আলোচিত ছিলেন।

বিদেশি হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ সরকারের নৈতিক অবস্থান আরও দুর্বল হয়ে যায় ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচনে ভারতের ‘ভূমিকার’ সুফল গ্রহণের ঘটনাগুলো স্মরণ করলে। এসবের পাশাপাশি ২০১৮ সালে নির্বাচনে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক বারবার দৃঢ় প্রতিশ্রুতি দেওয়ার পরও যেভাবে নির্বাচন হয়েছে, তাতে আগামী নির্বাচন নিয়ে দেশের পাশাপাশি বিদেশি মহলগুলোর উৎকণ্ঠা প্রকাশ অযৌক্তিক মনে হবে না অনেকের কাছে। 

৪. 

আমাদের সবারই মনে রাখতে হবে, জাতিসংঘের সদস্যরাষ্ট্র হিসেবে আমরা একটি বৈশ্বিক আইনকাঠামোর অনুসারী। আবার আন্তর্জাতিক বাণিজ্য, বিনিয়োগ ও শান্তিরক্ষী বাহিনীর মতো বহুজাতিক ব্যবস্থার অংশীদার হিসেবে অন্য রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে বিভিন্ন আইনগত বন্ধনে সম্পর্কিত। এ অবস্থায় সার্বভৌমত্বের দোহাই দিয়ে দেশে একপক্ষীয় নির্বাচন ও গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের যৌক্তিকতা খোঁজা দুরূহ বিষয়। এটি করতে গিয়ে মিয়ানমার বা উত্তর কোরিয়ার মতো পরিস্থিতি তৈরি করা হলে তাতে কোনো ব্যক্তি, পরিবার বা গোষ্ঠী লাভবান হতে পারে, কিন্তু এতে দেশের ক্ষতি হয় অপূরণীয়। 

নির্বাচনে বিদেশি হস্তক্ষেপ এড়ানোর কার্যকর উপায় হচ্ছে নির্বাচনব্যবস্থায় দেশের সব মহলের আস্থা ও মতৈক্য গড়ে তোলা। সরকার সে বিষয়ে মনোযোগী না হয়ে গায়েবি মামলা, বিরোধী দলের ওপর হামলার দিকে আগ্রহী হলে পরোক্ষ বিদেশি হস্তক্ষেপ এড়ানো সহজ হবে না। অন্য যেকোনো রাষ্ট্রের তুলনায় জাতিসংঘের মতো সর্বজনীন বৈশ্বিক ব্যবস্থার গ্রহণযোগ্যতা বহু গুণে বেশি। 

এমন সম্ভাবনা রোধ করতে চাইলে সরকারকে নির্বাচনকালীন সরকার, নির্বাচন কমিশন ও নির্বাচনব্যবস্থা সম্পর্কে বিরোধী দলের সঙ্গে সমঝোতায় আসতে হবে। সুষ্ঠু নির্বাচনে ক্ষমতা হারানো, নাকি বাংলাদেশকে আন্তর্জাতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করা—কোন ঝুঁকিটি বেশি বর্জনীয়, সরকারকে এ সিদ্ধান্ত নিতে হবে। 

আসিফ নজরুল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক