জাতিসংঘ মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনার মিশেল ব্যাশেলেত ১৭ আগস্ট বাংলাদেশে তাঁর চার দিনের আনুষ্ঠানিক সফর শেষে সাংবাদিকদের উদ্দেশে যে বিবৃতি দিয়েছেন, তার পুরো ভাষ্য প্রথম আলোর পাঠকদের জন্য ছাপানো হলো।
শুভসন্ধ্যা এবং সভায় আগমনের জন্য সবাইকে ধন্যবাদ।
প্রথমবারের মতো বাংলাদেশে মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনারকে আমন্ত্রণ জানানোর জন্য বাংলাদেশ সরকারকে আন্তরিক ধন্যবাদ জ্ঞাপনের মাধ্যমে আমি আমার বক্তব্য শুরু করছি। আমি আশা করি, আমার এই সাক্ষাতে জাতিসংঘ মানবাধিকারবিষয়ক বিভিন্ন প্রক্রিয়া ও পদ্ধতির ব্যাপারে সরকারের সম্পৃক্তি বৃদ্ধি পাবে এবং আমাদের মধ্যে সহযোগিতা নিবিড় হওয়ার পাশাপাশি বাংলাদেশে মানবাধিকার সমুন্নত রাখা ও সুরক্ষার বিষয়টি আরও নিশ্চিত হবে।
বাংলাদেশে আমার আগমন একটি গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় শোক দিবসের সঙ্গে মিলে গেছে, যে সময় দেশটি ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যার ঘটনা স্মরণ করছে। এটা ছিল এমন এক দিন, যা স্বাভাবিকভাবেই বাংলাদেশের ইতিহাসকে প্রতিফলিত করে—এর বেদনাদায়ক অতীত, স্বাধীনতা ও মানবাধিকারের জন্য একটি জাতির সংগ্রাম, যাদের অনেকেই ১৯৭১ সালে দেশত্যাগে বাধ্য হয়েছিল।
নাগরিক সমাজের সদস্যদের ও সরকারি কর্মকর্তাদের সঙ্গে আমার আলোচনায় বাংলাদেশের মানুষের প্রতিরোধ ও সহিষ্ণুতার বিষয়ে তাদের গর্ববোধ জোরালোভাবে উঠে এসেছে।
বাংলাদেশ উল্লেখযোগ্য অর্থনৈতিক ও সামাজিক অগ্রগতি অর্জন করেছে এবং আগামী কয়েক বছরের মধ্যে স্বল্পোন্নত দেশের অবস্থান থেকে উঠে আসার লক্ষ্য স্থির করেছে। সার্বিক প্রতিকূল অবস্থা থেকে যাত্রা করে বাংলাদেশ আর্থসামাজিক উন্নয়ন, দারিদ্র্য বিমোচন, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যক্ষেত্রে সক্ষমতা অর্জন, নারী ও শিশুদের মৃত্যুহার, খাদ্য, পানি ও পয়োনিষ্কাশনের ক্ষেত্রসমূহে সক্ষমতা অর্জনে অগ্রগতি লাভ করেছে।
অভিবাসন ও জলবায়ু পরিবর্তনের মতো মানবাধিকারসংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ সমস্যাগুলো নিয়ে কাজ করা আন্তর্জাতিক বিভিন্ন ফোরামের নেতৃত্ব দিয়ে আসছে এই দেশ। এ দেশ এক মিলিয়নের অধিক রোহিঙ্গা শরণার্থীকে আশ্রয় দেওয়ার ব্যবস্থা নিয়েছে। এই রোহিঙ্গারা তাদের বিরুদ্ধে চলমান অত্যাচার ও গুরুতর আন্তর্জাতিক অপরাধের কবল থেকে মিয়ানমার সীমান্ত পেরিয়ে পালিয়ে আসতে বাধ্য হয়েছে। মানবাধিকারের ক্ষেত্রেও বাংলাদেশ প্রতিনিয়ত চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করছে এবং আমি সরকার ও নাগরিক সমাজের সদস্যদের সঙ্গে এ–সংক্রান্ত অনেক বিষয়ে বিস্তৃত আলোচনা করতে পেরেছি।
ঢাকায় আমি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ওয়াজেদ এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, আইনমন্ত্রী, শিক্ষামন্ত্রীসহ রাষ্ট্রের অন্যান্য উচ্চপদস্থ নাগরিক সমাজের প্রতিনিধির পাশাপাশি কূটনৈতিক মহলের সদস্যদের ও শিক্ষাবিদদের সঙ্গে কথা বলেছি। আমি বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে পারস্পরিক মতবিনিময় করতে পেরেছি। ওই ইনস্টিটিউট জলবায়ু পরিবর্তন ও মানবাধিকার বিষয় নিয়ে কাজ করে থাকে। আমার কার্যালয়ের প্রতিনিধিদল ট্রেড ইউনিয়ন ও বিভিন্ন রাজনৈতিক দলসহ সংশ্লিষ্ট অন্য পক্ষসমূহের সঙ্গে আমার প্রতিনিধিত্ব করেছে।
যেহেতু বাংলাদেশ অর্থনৈতিকভাবে বিকাশমান রয়েছে, কাজেই উন্নয়নের পরবর্তী ধাপ অর্জনের জন্য টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যসমূহ (এসডিজি) ১৬–এর সঙ্গে সংগতি রেখে কার্যকর, জবাবদিহিমূলক ও অন্তর্ভুক্তিমূলক বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান গঠন করা আবশ্যক। এর অর্থ হলো অন্তর্ভুক্তি, অংশগ্রহণ ও জবাবদিহি নিশ্চিত করা। জাতীয় মানবাধিকার কমিশন, নির্বাচন কমিশন এবং বিচারব্যবস্থার পাশাপাশি স্বাধীন প্রতিষ্ঠানসমূহকে শক্তিশালীকরণ এ ক্ষেত্রে মুখ্য ভূমিকা পালন করবে। সব এসডিজি বাস্তবায়নের জন্য জাতিসংঘ কান্ট্রি টিম সহায়তাদানের জন্য সদা প্রস্তুত।
কোভিড-১৯ মহামারির প্রভাব ও রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্বব্যাপী অস্থিরতা থেকে সৃষ্ট ক্রমবর্ধিষ্ণু অর্থনৈতিক চাপের প্রেক্ষাপটে আমার সভাসমূহ আয়োজিত হলো। খাবার ও জ্বালানির বর্ধিষ্ণু মূল্যের অর্থ হলো জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং এ ধরনের পরিস্থিতিতে অবশ্যই সর্বাধিক প্রান্তিক ও নাজুক জনগোষ্ঠী সবচেয়ে বেশি প্রতিকূলতার শিকার হয়। জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবের চরম ঝুঁকিতে থাকা দেশটির জন্য এটি এক অব্যাহত চ্যালেঞ্জ। বাংলাদেশ একটি নির্বাচনী আবর্তে প্রবেশ করতে যাচ্ছে, যে পরিক্রমায় আগামী বছর সাধারণ নির্বাচন হওয়ার কথা এবং এই সময়ে ক্রমবর্ধিষ্ণু মেরুকরণ ও উদ্বেগময় পরিস্থিতি সৃষ্টির প্রবণতা দেখা দেয়।
এ ধরনের পরিস্থিতিতে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, সমাজের বিভিন্ন পর্যায়ে মানুষের মতামত গ্রহণ এবং যাতে তাঁরা বুঝতে পারেন যে তাঁদের মতামত আমলে নেওয়া হয়েছে। এ ক্ষেত্রে নাগরিক সমাজের সদস্যরা হতে পারেন গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ, যা সরকারের উচিত কাজে লাগানো। সমালোচনামূলক মন্তব্যগুলো সমস্যাসমূহ চিহ্নিত করা, তা অনুধাবন করা, সেগুলোর কারণ গভীরভাবে খতিয়ে দেখা এবং সমাধানের বিষয়ে আলোচনা করতে সাহায্য করে।
চ্যালেঞ্জসমূহ অনুধাবন করতে পারা সব সময় এদের মোকাবিলা করার প্রথম ধাপ।
নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের সঙ্গে আমার মতবিনিময় ছিল চমৎকার ও তাৎপর্যপূর্ণ। বাংলাদেশে বিভিন্ন পর্যায়ে যে ঐতিহাসিকভাবে একটি ঋদ্ধ নাগরিক সমাজ রয়েছে, তাতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। তবে ধারাবাহিকভাবে উপস্থাপিত বিভিন্ন মানবাধিকার প্রতিবেদনে নাগরিক সমাজের গুরুত্ব সীমিত করার, ক্রমবর্ধমান নজরদারি, ভয়ভীতি প্রদর্শন ও প্রতিশোধমূলকভাবে বাক্স্বাধীনতা হরণ করার বিষয়গুলো প্রতিফলিত হয়েছে। বিভিন্ন আইন ও নীতিমালার মাধ্যমে এনজিওসমূহের ওপর অতিরিক্ত নিয়ন্ত্রণমূলক ব্যবস্থা আরোপ এবং ব্যাপকভাবে বাক্স্বাধীনতা হরণের ফলে তাদের জন্য ফলপ্রসূভাবে কার্যক্রম পরিচালনা করা কঠিন এবং কখনো কখনো ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে দাঁড়ায়।
যেহেতু বাংলাদেশ উন্নয়নের পরবর্তী ধাপে অগ্রসর হওয়ার লক্ষ্য স্থির করেছে, সেহেতু গণতান্ত্রিক ও নাগরিক সমাজের ভূমিকা রাখার সুযোগ করে দেওয়ার পাশাপাশি কার্যকর নিয়ন্ত্রণ ও সমন্বয় এবং জবাবদিহি নিশ্চিত করা দরকার। এর ফলে দুর্নীতির ঝুঁকি হ্রাস পাওয়ার পাশাপাশি টেকসই অর্থনৈতিক উন্নতি ও সুষ্ঠু আর্থিক ব্যবস্থাপনার পথে প্রতিবন্ধকতাসমূহও হ্রাস পাবে।
বাক্স্বাধীনতা, রাজনৈতিক কর্মী, মানবাধিকারকর্মী, বিরোধী দল এবং সাংবাদিকদের সংগঠন ও শান্তিপূর্ণ সমাবেশের স্বাধীনতার পাশাপাশি নাগরিক ও রাজনৈতিক সমাজের ভূমিকা জোরদার করার লক্ষ্যে বাংলাদেশের জন্য নির্বাচনের সময়টি একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রেক্ষাপট। আইন প্রয়োগকারী বাহিনীর সদস্যরা অতিরিক্ত বল প্রয়োগ করা ছাড়াই যাতে প্রতিবাদ সমাবেশসমূহ নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন, সে জন্য তাঁদের প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ প্রদান করাও গুরুত্বপূর্ণ।
সামাজিক অস্থিরতা বিকশিত ও উসকে ওঠার ফলে সৃষ্ট ক্ষোভ দমন করার জন্য রাজনৈতিক দলসমূহ ও সক্রিয় নাগরিক সমাজের ব্যাপক পরিসরে আরও সংলাপ অব্যাহত রাখার ক্ষেত্র তৈরি করা আবশ্যক। নারী, ধর্মীয় সংখ্যালঘু গোষ্ঠী ও ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী এবং বিশেষ করে তরুণ জনগোষ্ঠীর মতামত অবগত হওয়া আবশ্যক।
আমি হিন্দু সম্প্রদায় ও ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মতো সংখ্যালঘু সম্প্রদায়সমূহকে সহিংসতা ও তাদের ভূমি বেদখল থেকে সুরক্ষা প্রদানের ওপর গুরুত্বারোপ করেছি। ২৫ বছর আগে সম্পাদিত পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি ছিল একটি গুরুত্বপূর্ণ অর্জন। কিন্তু ভূমিসংক্রান্ত বিরোধ ও সেনাবাহিনী প্রত্যাহার করার প্রয়োজনীয়তার সঙ্গে সম্পর্কিত মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিভিন্ন অব্যাহত অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে আমি পার্বত্য চুক্তির পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন ও স্বাধীন পক্ষসমূহের ওই এলাকা পরিদর্শন করার ক্ষেত্রে বাধাহীন অনুমতি প্রদানের আহ্বান জানাই।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে স্থানীয় পর্যায়ে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় নারীদের আনুষ্ঠানিক অংশগ্রহণ বৃদ্ধি পেয়েছে। আমি সব পর্যায়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রসমূহে নারীদের অংশগ্রহণ বৃদ্ধি করার জন্য সরকারকে সক্রিয় ভূমিকা রাখার আহ্বান জানাই। অনেক ক্ষেত্রে প্রভূত অগ্রগতি সাধিত হয়েছে, কোনো কোনো খাতে অধিকসংখ্যক নারী শ্রমশক্তিতে যোগদান করেছেন এবং দেশে নারীশিক্ষার ক্ষেত্রে অগ্রগতি অর্জিত হয়েছে। যার ফলে প্রাথমিক বিদ্যালয়সমূহে লিঙ্গসমতা অর্জিত হয়েছে।
কিন্তু বেশ কতগুলো গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় নীতিমালা গ্রহণ করা সত্ত্বেও িলঙ্গসমতা অর্জনের বিষয়টি একটি চ্যালেঞ্জ হিসেবে রয়ে গেছে। যৌন সহিংসতাসহ নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতা বরাবরের মতোই বেশি এবং ন্যায়বিচার লাভের সুযোগ পাওয়া ও ভুক্তভোগীদের প্রতি দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করা তেমনই দুরূহ রয়ে গেছে।
সরকার কর্তৃক হিজড়াদের আইনি স্বীকৃতি দেওয়ার পদক্ষেপকে আমি স্বাগত জানাই এবং আমি আশা করি এলজিবিটিআইকিউ+ ব্যক্তিদের মৌলিক মানবাধিকারের প্রতি সম্মান, তা সংরক্ষণ ও উন্নয়নের জন্যও সরকার আরও পদক্ষেপ গ্রহণ করবে।
আমি হিন্দু সম্প্রদায় ও ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মতো সংখ্যালঘু সম্প্রদায়সমূহকে সহিংসতা ও তাদের ভূমি বেদখল থেকে সুরক্ষা প্রদানের ওপর গুরুত্বারোপ করেছি। ২৫ বছর আগে সম্পাদিত পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি ছিল একটি গুরুত্বপূর্ণ অর্জন। কিন্তু ভূমিসংক্রান্ত বিরোধ ও সেনাবাহিনী প্রত্যাহার করার প্রয়োজনীয়তার সঙ্গে সম্পর্কিত মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিভিন্ন অব্যাহত অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে আমি পার্বত্য চুক্তির পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন ও স্বাধীন পক্ষসমূহের ওই এলাকা পরিদর্শন করার ক্ষেত্রে বাধাহীন অনুমতি প্রদানের আহ্বান জানাই।
মানবাধিকারবিষয়ক বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার ক্ষেত্রে সংবিধান, আইন ও আন্তর্জাতিক প্রতিশ্রুতির সমন্বয়ে বাংলাদেশে একটি সুদৃঢ় কাঠামো বিদ্যমান। গুরুত্বপূর্ণ জাতিসংঘ মানবাধিকার চুক্তিসমূহের এটি একটি শরিক দেশ। তবে এ ক্ষেত্রে সব ব্যক্তিকে বলপূর্বক অন্তর্ধান থেকে সুরক্ষাদানের আন্তর্জাতিক কনভেনশনে এই দেশ অংশগ্রহণ করেনি। আমি বাংলাদেশের সরকারকে এই কনভেনশনে শরিক হওয়ার আহ্বান জানাই। এই চুক্তিসমূহ পরিপালনকারী বিভিন্ন দেশের বিষয়ে পর্যালোচনাকারী কমিটিসমূহ গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশ পেশ করেছে। এর পাশাপাশি জাতিসংঘ মানবাধিকার কাউন্সিলের সর্বজনীন পর্যায়ক্রমিক পর্যালোচনা এবং জাতিসংঘ মানবাধিকারবিষয়ক বিভিন্ন স্বাধীন বিশেষজ্ঞও এ–সংক্রান্ত বিবিধ সুপারিশ উপস্থাপন করেছে। এই সুপারিশসমূহ বাস্তবায়ন করার পাশাপাশি এর ফলোআপ নিশ্চিত করার জন্য একটি প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা চালু করা আবশ্যক। এই সুপারিশসমূহ গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক এবং মানবাধিকার ও টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যসমূহের মধ্যে সেতুবন্ধ দৃঢ় করায় এগুলো ভূমিকা রাখে।
জাতিসংঘ নির্যাতনবিরোধী কমিটিসহ বিভিন্ন জাতিসংঘ মানবাধিকার সংস্থা বেশ কয়েক বছর ধরে বলপূর্বক অন্তর্ধান, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, নির্যাতনের বিরুদ্ধে উদ্বেগ প্রকাশ করে আসছে, যার অনেকগুলোতেই র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নকে দায়বদ্ধ করা হয়েছে। এর পাশাপাশি এ ধরনের আইন লঙ্ঘনের ক্ষেত্রে জবাবদিহির অভাবের বিষয়টিও উল্লেখিত হয়েছে।
আমি সরকারের মন্ত্রীদের কাছে এসব গুরুতর অভিযোগের ব্যাপারে গভীর উদ্বেগ ব্যক্ত করেছি এবং নিরাপত্তা খাতের সংস্কারের পাশাপাশি এসব অভিযোগের ব্যাপারে একটি নিরপেক্ষ, স্বাধীন ও স্বচ্ছ তদন্তের প্রয়োজনীয়তার ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছি।
স্বল্পমেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি বলপূর্বক অন্তর্ধানের অভিযোগের পাশাপাশি এসব বিষয়ে যথাযথ প্রক্রিয়া ও বিচারিক সুরক্ষার ব্যাপারে আশঙ্কাজনক অভিযোগ ও উদ্বেগ অব্যাহত রয়েছে, বিশেষ করে এসব ক্ষেত্রে তদন্তের অগ্রগতির অভাব ও ন্যায়বিচার প্রাপ্তির ক্ষেত্রে অন্যান্য প্রতিবন্ধকতা থেকে সৃষ্ট দীর্ঘ লালিত হতাশার পরিপ্রেক্ষিতে আমি এ সরকারকে একটি স্বাধীন ও বিশেষায়িত ব্যবস্থা প্রণয়নের আহ্বান জানাই, যা বলপূর্বক অন্তর্ধানের ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের অভিযোগসমূহ তদন্ত করার লক্ষ্যে ভুক্তভোগী, এদের পরিবারসমূহ ও সুশীল সমাজের সঙ্গে নিবিড়ভাবে কাজ করবে। কীভাবে আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের সঙ্গে সংগতি রেখে এ ধরনের একটি সংস্থা গঠন করা যায়, সে ব্যাপারে পরামর্শদানের জন্য আমার কার্যালয় প্রস্তুত রয়েছে।
বলপূর্বক অন্তর্ধানের বিষয়ে জাতিসংঘ ওয়ার্কিং গ্রুপকে আমন্ত্রণ জানানোর মাধ্যমে এই সমস্যা নিশ্চিতভাবে মোকাবিলা করার প্রতিশ্রুতি ফুটে উঠেছে। জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনসমূহে সর্বাধিক সংখ্যক সেনা, নৌ, বিমান ও পুলিশ সদস্য প্রেরণকারী দেশ হিসেবে বাংলাদেশকে নিশ্চিত করতে হবে যে এ দেশের নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত ব্যক্তিদের মানবাধিকার রক্ষার যোগ্যতাবিষয়ক একটি সুষ্ঠু যাচাইকরণ প্রক্রিয়া বিদ্যমান।
আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনসমূহের আলোকে দেশের অভ্যন্তরীণ আইনসমূহ সংগতিপূর্ণ করার লক্ষ্যে আমি আইনি সংস্কারের বিষয়ে আলোচনা করেছি।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের পর্যালোচনা নিয়ে আমার কার্যালয় এবং সরকার সংলাপে বসেছি। আমি অনলাইন স্পেসের ওপর নিয়ন্ত্রণের, অনলাইনে ঘৃণা উদ্রেককারী বক্তব্য প্রচারের সুযোগ না রাখার, মিথ্যা তথ্য প্রদান ও সাইবার ক্রাইম মোকাবিলা করার প্রয়োজনীয়তা স্বীকার করি। এই সমস্যাগুলো মোকাবিলা করা সহজ নয়, কারণ নিয়ন্ত্রণমূলক বিভিন্ন পদক্ষেপ সব সময় বাক্স্বাধীনতা সুরক্ষার ক্ষেত্রে ঝুঁকি সৃষ্টি করে। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন ও মানদণ্ডের সঙ্গে সাযুজ্য রাখার এবং ইচ্ছেমতো আইনের প্রয়োগ অথবা অপব্যবহার রোধ করার লক্ষ্যে এই আইনের কতক বিধি রদ করা ও পুনর্বিবেচনা করাসংক্রান্ত বিভিন্ন সুপারিশ আমরা উপস্থাপন করেছি। আমরা এ ক্ষেত্রে সরকারের পক্ষ থেকে প্রয়োজনীয় সাড়া এবং আইনটি পুনর্বিবেচনা করার প্রক্রিয়া গতিশীল করার লক্ষ্যে সময়সীমা নির্ধারণের প্রত্যাশা করি। নতুন খসড়া ডেটা সুরক্ষা আইন এবং ওটিটি (ওভার দ্য টপ প্ল্যাটফর্মস) সংক্রান্ত বিধিবিধান যাতে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার মানদণ্ডের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ হয়, তা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে সুশীল সমাজ ও জাতিসংঘের সঙ্গে নিবিড়ভাবে কাজ করার প্রয়োজনীয়তার ওপর আলোকপাত করেছি।
জাতিসংঘ যেকোনো এবং সব ধরনের পরিস্থিতিতে মৃত্যুদণ্ড আরোপ করার বিরুদ্ধে দৃঢ় অবস্থান গ্রহণ করে এবং আমি মৃত্যুদণ্ডের পরিধি কমিয়ে আনার পাশাপাশি তা রহিত করার ব্যাপারে পদক্ষেপ গ্রহণের আহ্বান জানাই।
বাংলাদেশে আমার অবস্থানকালে আমি কক্সবাজারও পরিদর্শন করেছি, যেখানে বাংলাদেশের সরকার, জাতিসংঘ ও অন্য অংশীদারদের সমন্বয়ে রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরসমূহে উল্লেখযোগ্য কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়েছে। বাংলাদেশের মানবকল্যাণমূলক অবদানের জন্য গুরুত্ব এবং এর ঐতিহাসিক গুরুত্বের প্রভাব বিষয়ে অধিক কিছু বলার নেই। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় অবশ্যই বাংলাদেশের প্রতি তাদের সহযোগিতা অব্যাহত রাখবে এবং শরণার্থীদের প্রত্যাবর্তনের শর্তসমূহ তৈরি, মূল কারণসমূহ দূরীভূত করা এবং এ ক্ষেত্রে জবাবদিহি মেনে চলার ক্ষেত্রে মিয়ানমারের ওপর চাপ প্রয়োগ করবে।
এই মানুষগুলো চরম সহিংসতা ও পদ্ধতিগত বৈষম্যের শিকার হয়ে পাঁচ বছর আগে পালিয়ে এসেছে, যা কিনা সাম্প্রতিক ইতিহাসে মানব সম্প্রদায়ের সবচেয়ে বড় স্থানান্তর শিবিরগুলোতে নারী, তরুণ-তরুণী, ধর্মীয় নেতাদের এবং অন্যান্য রোহিঙ্গা শরণার্থীর সঙ্গে আলাপ-আলোচনার সময় আমি যেটুকু শুনেছি, তাতে তাদের মনের যে আশা প্রতিভাত হয়েছে, তা হলো তারা মিয়ানমারে তাদের গ্রামে ও বাড়িতে ফিরে যেতে পারবে। তবে পরিস্থিতি অনুকূল হলেই তা সম্ভব হবে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে সীমান্তের বিদ্যমান অবস্থা প্রত্যাবর্তনের জন্য অনুকূল নয়। প্রত্যাবাসন সর্বদাই স্বেচ্ছামূলক ও মর্যাদাপূর্ণভাবে সম্পাদিত হতে হবে এবং মিয়ানমারে নিরাপদ ও স্থিতিশীল পরিস্থিতি বিদ্যমান থাকলেই কেবল তা সম্ভব।
শিবিরগুলোর শিখনকেন্দ্রসমূহে কমিউনিটি সদস্যসমূহ কর্তৃক পরিচালিত গণিত এবং বার্মিজ শ্রেণি পাঠ অল্পবয়সী বালিকা ও বালকেরা প্রফুল্ল চিত্তে গ্রহণ করছে দেখে আমি উৎফুল্ল। ছোট বালক-বালিকারা ছিল উদ্দীপনায় ভরপুর এবং তারা তাদের ভবিষ্যৎ আশা-আকাঙ্ক্ষা নিয়ে কথা বলল। অবশ্য অপেক্ষাকৃত বড় শিশুদের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে কিছুটা সময় পর তাদের মাঝে আরও বেশি হতাশার ছাপ দেখা গেছে। একটি ছেলে তার জীবনে হারিয়ে যাওয়া বছরগুলোর ব্যাপারে কথা বলেছে; সে আর কখনো ফিরে যাবে না। সে তার সম্প্রদায়ের কল্যাণে এবং চূড়ান্ত পর্যায়ে তার দেশ মিয়ানমারের জন্য কাজ করার জোরালো ইচ্ছা ব্যক্ত করল। সামাজিক সমস্যা ও অপরাধপ্রবণতা রোধ করার পাশাপাশি মিয়ানমার সমাজে এই শরণার্থীদের টেকসই পুনর্বাসনের জন্য প্রস্তুত করার লক্ষ্যে সর্বোত্তম পন্থা হলো এই বালক–বালিকাদের জন্য শিক্ষা ও জীবিকার সুযোগ সম্প্রসারণ করা।
কক্সবাজারে আমি যেসব শরণার্থী এবং যথার্থই পৃথিবীর বিভিন্ন অংশে আমি যেসব শরণার্থী ও অভ্যন্তরীণ বাস্তুচ্যুত জনগোষ্ঠীর সঙ্গে কথা বলেছি, তাতে যে বিষয়টি গুরুত্ব পেয়েছে তা হলো, তারা সহায়তার ওপর নির্ভরশীল থাকতে চায় না। তারা উৎপাদনশীল জীবন যাপন করতে চায়। জীবিকা অর্জন করতে চায় এবং সমাজে অনুকূল ভূমিকা রাখার পাশাপাশি তাদের জীবনের অবস্থার উন্নতি ঘটাতে চায়।
আমি ভাসানচর ও কক্সবাজারে অবস্থিত বিভিন্ন শরণার্থী ক্যাম্পে কমিউনিটি পরিচালিত উদ্যোগগুলোকে উৎসাহিত করার জন্য সরকারকে আহ্বান জানাই, যাতে এ ধরনের উচ্চাকাঙ্ক্ষা লালনকারী ব্যক্তিরা তাদের মতো অন্য শরণার্থীদের প্রয়োজন মেটানোর লক্ষ্যে সহায়তা ও অনুকূল অবদান রাখতে পারে। আমি যাদের সঙ্গে কথা বলেছি, তাদের অনেকেই একদিকে সশস্ত্র বিভিন্ন দল ও অপরাধী চক্র এবং অন্যদিকে নারী ও মেয়েদের ঝুঁকিগ্রস্ত অবস্থা—এই দুই প্রেক্ষাপটে নিরাপত্তা পরিস্থিতি নিয়ে ভীত। রোহিঙ্গা সামাজিক সংগঠন ও মানবাধিকারকর্মীদের নিরাপত্তা ও বাক্স্বাধীনতার সুরক্ষাও আবশ্যক।
বাংলাদেশের ক্রমবর্ধমান রোহিঙ্গাবিরোধী প্রচার এবং এদের অপরাধের উৎস বলে গৎবাঁধাভাবে প্রচার করা ও রোহিঙ্গাদের দোষী হিসেবে চিহ্নিত করার বিষয়ে আমি উদ্বিগ্ন। আমি একটি বিষয়ে বিশেষভাবে উদ্বিগ্ন যে অর্থনৈতিক প্রতিকূলতা ও অনিশ্চয়তার মধ্যে নির্বাচনপূর্ব পরিস্থিতি এই ঝুঁকিগ্রস্ত সম্প্রদায়সমূহের বিরুদ্ধে আরও বিদ্বেষপূর্ণ বক্তব্য উসকে দেবে।
আমি সরকার ও সব বাংলাদেশিকে এ ধরনের ক্ষতিকর কথাবার্তার বিরুদ্ধে সতর্ক থাকা, ভুল তথ্যের বিপরীতে সঠিক তথ্য তুলে ধরা এবং আশ্রয়দাতা জনগোষ্ঠীর সঙ্গে সমঝোতা সৃষ্টি করার আহ্বান জানাই।
যেহেতু বাংলাদেশ অর্থনৈতিকভাবে বিকাশমান রয়েছে, কাজেই উন্নয়নের পরবর্তী ধাপ অর্জনের জন্য টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যসমূহ (এসডিজি) ১৬–এর সঙ্গে সংগতি রেখে কার্যকর, জবাবদিহিমূলক ও অন্তর্ভুক্তিমূলক বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান গঠন করা আবশ্যক। এর অর্থ হলো অন্তর্ভুক্তি, অংশগ্রহণ ও জবাবদিহি নিশ্চিত করা। জাতীয় মানবাধিকার কমিশন, নির্বাচন কমিশন এবং বিচারব্যবস্থার পাশাপাশি স্বাধীন প্রতিষ্ঠানসমূহকে শক্তিশালীকরণ এ ক্ষেত্রে মুখ্য ভূমিকা পালন করবে। সব এসডিজি বাস্তবায়নের জন্য জাতিসংঘ কান্ট্রি টিম সহায়তাদানের জন্য সদা প্রস্তুত।
আমি আশা করি, আমার এই পরিদর্শন জাতিসংঘ মানবাধিকার কার্যালয় ও ব্যবস্থাসমূহের সঙ্গে সরকারি ও বেসরকারি সব পর্যায়ে বাংলাদেশের সম্পৃক্তি বৃদ্ধি করবে। বাংলাদেশ আগামী বছর মানবাধিকার কাউন্সিলের চতুর্থ সর্বজনীন পর্যায়ক্রমিক পর্যালোচনায় অংশগ্রহণ করবে, যা হবে দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতির অগ্রগতির জন্য এক গুরুত্বপূর্ণ সময়।
এটি উৎসাহব্যঞ্জক যে জলবায়ু ও মানবাধিকারবিষয়ক নতুন বিশেষ র্যাপোর্টিয়ার শিগগির এই দেশ পরিদর্শনে আসবেন। বাংলাদেশসহ অন্যান্য ঝুঁকিগ্রস্ত রাষ্ট্রকে জলবায়ুসংক্রান্ত কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের অনুকূলে তাদের যে চাহিদা, সে ব্যাপারে আমি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে প্রয়োজনীয় সহায়তাদানের আহ্বান জানাই।
অর্থনৈতিক, জলবায়ু–সম্পর্কিত, রাজনৈতিক, সামাজিক ও মানবিক—সব গুরুত্বপূর্ণ মানবাধিকার চ্যালেঞ্জের ক্ষেত্রে আমি একটি বিষয়ে বিশ্বাস রাখি যে সমগ্র সমাজের অন্তর্নিহিত শক্তিশালী সম্পদসমূহ যদি কাজে লাগানো যায় এবং নানা বৈচিত্র্যপূর্ণ জনগোষ্ঠীর অংশগ্রহণে যদি নীতিমালাসমূহ ও গৃহীতব্য ব্যবস্থাসমূহ পরিকল্পিত করা যায়, তবে বাংলাদেশ তার উন্নয়নের উল্লেখযোগ্য যাত্রায় উজ্জ্বলতর হয়ে হাজির হবে।
● মিশেল ব্যাশেলেত জাতিসংঘ মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনার