মিয়ানমারে সাম্প্রতিক অভ্যুত্থানের পর অন্তত আট লাখ মানুষ অভ্যন্তরীণভাবে বাস্তুচ্যুত হয়ে পড়েছে
মিয়ানমারে সাম্প্রতিক অভ্যুত্থানের পর অন্তত আট লাখ মানুষ অভ্যন্তরীণভাবে বাস্তুচ্যুত হয়ে পড়েছে

মিয়ানমারে জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠা কি একেবারেই অসম্ভব

প্রতিটি দেশের সেনাবাহিনীই বহিঃশত্রুর আক্রমণ থেকে দেশকে রক্ষার পাশাপাশি এর নাগরিকদের সুরক্ষা দেয়, সর্বতোভাবে হেফাজত করে। এ ক্ষেত্রে বিরল ব্যতিক্রম আমাদের প্রতিবেশী দেশ মিয়ানমারের সেনাবাহিনী। তারা নিজ দেশের নাগরিকদের ওপর অস্ত্র তাক করে, ঘরবাড়ি থেকে নারী-শিশুদের টেনেহিঁচড়ে উৎখাত করে, এমনকি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানও জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে দেয়।

২০২১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে অং সান সু চির নির্বাচিত সরকারকে হটিয়ে ক্ষমতা করায়ত্ত করার পর সিনিয়র জেনারেল মিন অং হ্লাইংয়ের জান্তার সরকারের অত্যাচার, নিপীড়ন বহুগুণে বেড়ে গেছে। রাষ্ট্রের মধ্যে আরেকটি রাষ্ট্র সৃষ্টি করতে রক্তের হোলি খেলায় যেন মেতেছে সামরিক জান্তা।

সামরিক অভ্যুত্থানের পর এ পর্যন্ত হত্যা করা হয়েছে ২ হাজার ২৪৯ জনকে, ফাঁসি দেওয়া হয়েছে গণতন্ত্রপন্থী জ্যেষ্ঠ নেতাদের। গ্রেপ্তার করা হয়েছে প্রায় ১৫ হাজার মানুষকে। পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে অন্তত ২৮ হাজার বাড়িঘর। শিক্ষকদের মধ্যে যাঁরা ‘সিভিল ডিজঅবিডিয়েন্স মুভমেন্টে’ (অহিংস শান্তিপূর্ণ আন্দোলন) অংশ নিয়েছেন, তাঁরা আটক হয়েছেন নতুবা নিহত হয়েছেন। অভ্যুত্থানের পর অন্তত আট লাখ মানুষ অভ্যন্তরীণভাবে বাস্তুচ্যুত হয়ে পড়েছে।

তারা আবার কবে স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারবে, তা অনিশ্চিত। প্রতিরোধযোদ্ধা ও সাধারণ নাগরিকদের মধ্যে যাতে কোনো ধরনের সংযোগ গড়ে উঠতে না পারে, এ জন্য বিভিন্ন সাহায্য সংস্থার কর্মীদের হত্যা করা হচ্ছে। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনের কোনো ধরনের তোয়াক্কা করছে না সামরিক জান্তা।

বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর সম্মিলিত দেশ মিয়ানমার। বেশির ভাগ মানুষ ধর্মে বৌদ্ধ। তবে সংস্কৃতিগতভাবে বামার, কাচিন, কারেন, শান, আরাকানি ও চিনদের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। মূলত এ জন্য এবং অন্য নানা কারণে তারা বিচ্ছিন্নতার আন্দোলনের পথ বেছে নিয়েছে।

অর্থাৎ তারা পৃথক দেশ সৃষ্টি করতে চায় অথবা তারা স্বায়ত্তশাসন চায়। এই গোষ্ঠীগুলো মিয়ানমারে হঠাৎ গজিয়ে ওঠেনি। তাদের অনেকগুলোই গত শতকের পঞ্চাশ ও ষাটের দশক থেকে আন্দোলনে রয়েছে। বিপরীতে জান্তা সরকার তাদের সঙ্গে কোনো ধরনের আলোচনার পথে না গিয়ে পোড়ামাটি নীতি গ্রহণ করেছে। পুরো দেশের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে গৃহযুদ্ধ বাধিয়ে দিয়েছে। বৃক্ষশোভিত সবুজ দেশটিতে আজ কেবলই সহিংসতার রক্তরং।

বিগত সময়ে গণতান্ত্রিক আন্দোলনে অংশ নেওয়ার কারণে যাঁরা স্বজন হারিয়েছেন, যাঁদের স্বজনেরা এখনো বন্দীশালায় আছেন, সেই বেদনা ভুলে না গিয়ে, শোককে শক্তিতে পরিণত করে দেশের স্বার্থে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। মিয়ানমারের সংগ্রামী মানুষের পক্ষে এটা কি একেবারেই অসম্ভব?

২.

সে দেশের বিভিন্ন ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মানুষ নিজভূমে পরবাসীর মতো জীবন যাপন করছে। আবার অনেকে নিজভূমিতেও থাকতে পারছে না। জান্তার নির্যাতনের শিকার হয়ে অনেকেই দেশ ছেড়ে প্রতিবেশী দেশে ছোট্ট একটু ঘরে কোনোমতে দিনাতিপাত করছে।

রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর কথাই শুরুতে বলা যাক। ২০১৭ সালে পশ্চিম মিয়ানমারের রাখাইনে সামরিক জান্তা ‘এথনিক ক্লিনজিং’ বা জাতিগত নির্মূল অভিযান শুরু করলে প্রায় ৭ লাখ ৬০ হাজার রোহিঙ্গা পালিয়ে বাংলাদেশের কক্সবাজারে চলে আসতে বাধ্য হয়। মানবতার কী বিপর্যয় সে সময় দেখেছে বিশ্ব! কিন্তু দেখেও নীরব অনেকেই। বড় প্রতিবেশী, যাদের সরব হওয়ার কথা ছিল, তারা আশ্চর্যজনকভাবে মৌন অবলম্বন করেছে এবং এখন অবধি করে যাচ্ছে।

বর্তমানে বিশ্বের অন্যতম ঘনবসতিপূর্ণ দেশ বাংলাদেশে প্রায় সাড়ে ১১ লাখ রোহিঙ্গার বাস। প্রতিবছর গড়ে ৩০ হাজার শিশু এখানকার শিবিরে জন্ম নিচ্ছে। সামনে কী পরিস্থিতি হবে, ভাবলেই গা শিউরে ওঠে। অথচ তাদের ফিরিয়ে নেওয়ার কোনো আয়োজন নেই।

সু চির আমলে তা–ও আলোচনা একটা পর্যায়ে পর্যন্ত এগিয়েছিল। জান্তা আসার পর সব যেন থেমে গেছে। রোহিঙ্গাদের আবার সে দেশে ফিরিয়ে নেওয়া হবে, এ বিশ্বাসই এখন উঠে গেছে। আবার বাংলাদেশের আশ্রয়শিবিরেও তারা ভালো নেই। কারণ, দুনিয়ার কোনো আশ্রয়শিবিরেই মানুষ স্বাধীনভাবে, আত্মমর্যাদার সঙ্গে থাকতে পারে না। হতাশার চোরা স্রোতে একটু একটু করে ডুবতে থাকে সব আশা-ভরসা।

সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত ১৬ আগস্ট কক্সবাজারে জাতিসংঘ মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনার মিশেল ব্যাশেলেতকে কাছে পেয়ে এক রোহিঙ্গা তরুণী বলছিলেন, রাখাইনে লেখাপড়ায় কতটা ভালো ছিলেন তিনি। চেয়েছিলেন একজন চিকিৎসক হতে। কিন্তু গত পাঁচ বছরের শরণার্থী জীবনে তাঁর স্বপ্ন ভেঙে গেছে। অথচ মিয়ানমারে তাঁর বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী বন্ধুরা অনেকেই এরই মধ্যে চিকিৎসক হয়ে গেছেন। রোহিঙ্গা হয়ে জন্ম নেওয়াই যেন তাঁর অপরাধ। ব্যাশেলেত ওই রোহিঙ্গা তরুণীকে কীভাবে সান্ত্বনা দিয়েছেন জানা যায়নি। হয়তো তাঁর চোখ দুটিও ভিজে উঠেছে, কিছু করতে না পারার আক্ষেপে।

কেবল রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী নয়, মিয়ানমারের চিন স্টেটের ৩১ হাজার চিন শরণার্থী ঠাঁই নিয়েছে প্রতিবেশী ভারতের মিজোরামে। মিজোদের সঙ্গে চিনদের সংস্কৃতিগত নৈকট্য রয়েছে। মিজোরামের আশ্রয়শিবিরে পালিয়ে আসা চিন তরুণ-যুবাদের ভবিষ্যৎও দিন দিন ফিকে হয়ে আসছে।

খবরে প্রকাশ, প্রতিদিনই মিয়ানমার থেকে লোকজন ভারতে ঢুকছে। চিকিৎসক দেখাতে আসছে, কাজ করতে আসছে। কারণ, জান্তার দেশে নাগরিক সেবা খুবই অপ্রতুল। জনগণের করের টাকার বড় অংশটি ব্যয় করা হচ্ছে অস্ত্র কিনতে আর রাজরাজড়াদের শানশওকত বৃদ্ধিতে।

সেনাবাহিনীর নির্যাতনের শিকার হচ্ছে মিয়ানমারের সবচেয়ে বড় জাতিগোষ্ঠী বামাররাও। বামারদের মূল কেন্দ্র সাগাইং ও মাগবি এলাকায় তীব্র সেনা অভিযান চলছে। নিপীড়ন চলছে চিন ও কায়াহ স্টেটে। সেখানে মানবাধিকার পরিস্থিতি খুবই শোচনীয়।

বেসামরিক মানুষের ওপর বিমান হামলা ও কামানের গোলা বর্ষণ করা হচ্ছে। সর্বশেষ সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়েছে উত্তর রাখাইন স্টেটে, সাম্প্রতিক সময়ে যে অঞ্চলটি কিছুটা শান্তিপূর্ণ ছিল। সেখানে সেনাবাহিনীর সঙ্গে আরাকান আর্মির লড়াইয়ের মধ্যে পড়ছে সাধারণ রোহিঙ্গারা।

৩.

খনিজ সম্পদে সমৃদ্ধ একটি সবুজ দেশ মিয়ানমার। বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর মানুষেরা মিলেমিশেই দেশটিতে বসবাস করছে। কিন্তু দীর্ঘ বছর ধরে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন চলমান থাকায় দেশটিকে শাসনের নামে শোষণ করতে সেনাবাহিনী একধরনের সুবিধা পেয়েছে। বিচ্ছিন্নতা দমনের নামে তা টিকিয়ে রেখে নিজেদের শক্তির জানান দেওয়া এবং জনগণের কাছে ‘অখণ্ডতা’র বার্তা পৌঁছানো—এই হলো তাদের কৌশল। কিন্তু এই কৌশল কত দিন টিকবে, সেটাই প্রশ্ন।

আন্তর্জাতিক রাজনীতির পর্যবেক্ষকেরা মনে করছেন, মিয়ানমারের সমস্যা সমাধানের একমাত্র পথ হলো রাষ্ট্রীয় সব প্রতিষ্ঠান থেকে সব ধরনের অমানবিকতাকে ঝেঁটিয়ে বিদায় করা।

একটি একক মিয়ানমারই পারবে এর সব প্রতিষ্ঠান থেকে দুষ্টচক্রের ব্যূহকে ভেদ করতে। বামার, কাচিন, কারেন, শান, কারেন্নি, আরাকানি, রোহিঙ্গাসহ সব ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী মিলে যদি একসঙ্গে ঐক্যের গানে সুর বাঁধতে পারে, সামরিক জান্তাকে হঠানো সম্ভব।

বিগত সময়ে গণতান্ত্রিক আন্দোলনে অংশ নেওয়ার কারণে যাঁরা স্বজন হারিয়েছেন, যাঁদের স্বজনেরা এখনো বন্দীশালায় আছেন, সেই বেদনা ভুলে না গিয়ে, শোককে শক্তিতে পরিণত করে দেশের স্বার্থে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। মিয়ানমারের সংগ্রামী মানুষের পক্ষে এটা কি একেবারেই অসম্ভব? সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে থাকা যোদ্ধাদের জন্য এ দেশের গীতিকবি মোহিনী চৌধুরীর চারটি লাইন নিবেদন করতে চাই—‘যারা স্বর্গগত তারা এখনো জানে/স্বর্গের চেয়ে প্রিয় জন্মভূমি/এসো স্বদেশ ব্রতের সহদীক্ষালোভী/সেই মৃত্যুঞ্জয়ীদের চরণচুমি’।

 প্রতিবেশী মিয়ানমারে জয় হোক সংগ্রামী মানুষের।

 কাজী আলিম-উজ-জামান প্রথম আলোর উপবার্তা সম্পাদক

alim.zaman@prothomalo.com