মতামত

কপ-২৭: অগ্রগতি ছিল কিন্তু যথেষ্ট নয়

বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের বড় আঘাতচিহ্ন হিসেবে দেখা যেতে পারে বাংলাদেশের খুলনার প্রত্যন্ত উপকূলীয় উপজেলা কয়রাকে।
ফাইল ছবি: প্রথম আলো

এক মাসের বেশি হতে চলেছে ২৭তম জলবায়ু সম্মেলন শেষ হওয়ার। আমাদের পৃথিবীর ভবিষ্যৎ কেমন হবে, তা নিশ্চিত করতে এই জলবায়ু সম্মেলন, যার আনুষ্ঠানিক নাম কনফারেন্স অব পার্টিজ-২৭ বা ‘কপ-২৭’, খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এই এক মাসের মধ্যে এ সম্মেলনের অর্জন ও ব্যর্থতা নিয়ে আমরা ব্যাপক আলোচনা ও বিতর্ক হতে দেখেছি। কিন্তু এই সবকিছুর ভিড়ে যেটা অনুপস্থিত ছিল সেটা হলো, তাদের মতামত যারা কিনা সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে রয়েছে। বিশ্বনেতারা যদি জলবায়ু সংকট মোকাবিলায় জরুরি পদক্ষেপ নিতে দেরি করতে থাকেন, তাহলে বসবাসের অযোগ্য একটি পৃথিবীতে একটি প্রজন্মের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে পড়বে।

জলবায়ু পরিবর্তন তরুণ জনগোষ্ঠীর ওপর অসামঞ্জস্যপূর্ণভাবে প্রভাব ফেলবে এবং ইতিমধ্যে ফেলছেও। এ পরিস্থিতিতে তাদের ভবিষ্যৎকে প্রভাবিত করে—এমন সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে তাদের মতামত নেওয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আর শিশু ও তরুণেরা যে পরিবর্তনের ‘এজেন্ট’ হতে পারে, সে বিষয়কে প্রথমবারের মতো আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি দিয়ে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করেছে ‘কপ-২৭’। ২০২২ সালে বিভিন্ন দেশের সরকারি প্রতিনিধিরা যখন জলবায়ু পরিবর্তন প্রশমন (মিটিগেশন), অভিযোজন (অ্যাডাপ্টেশন) ও অর্থায়ন (ফিন্যান্স) নিয়ে আলোচনা করছিলেন, তখন শিক্ষাবিদ ও জীবাশ্ম জ্বালানি লবিস্ট থেকে শুরু করে তরুণ জলবায়ুকর্মীদের মতো পর্যবেক্ষকেরা ভালোভাবে আলোচনাগুলো অনুসরণ করছিলেন এবং নিজেদের দাবিগুলোর পক্ষে কথা বলছিলেন।

আমি ইউনিসেফ প্রতিনিধিদলের অংশ হিসেবে ‘কপ-২৭’–এ অংশগ্রহণ করেছি এবং প্রথমবারের মতো আয়োজিত শিশু ও যুব প্যাভিলিয়ন আয়োজনে অংশ নিয়েছি। শিশু ও যুব প্যাভিলিয়ন আমাদের মতামত জোরালোভাবে উপস্থাপন, সারা বিশ্বের তরুণ জলবায়ুকর্মীদের মধ্যে নেটওয়ার্ক তৈরি এবং কর্ম পরিকল্পনা গ্রহণের জন্য তরুণদের নেতৃত্বাধীন একটি প্ল্যাটফর্ম।

তরুণ জলবায়ুকর্মীদের সঙ্গে আমি জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় উন্নয়নশীল দেশগুলোকে সাহায্য করতে ১০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার সংগ্রহের আহ্বান জানিয়ে ‘লস অ্যান্ড ড্যামেজ’ বিষয়টি আলোচ্যসূচিতে রাখার দাবিতে সমবেত হয়েছিলাম। আমরা জোর দিয়ে বলেছি যে, এই অর্থায়ন তাদের কাছ থেকে আসা উচিত নয়, যারা বৈষম্যের শিকার। বরং জীবাশ্ম জ্বালানিশিল্পের মুনাফার ওপর কর আরোপের মাধ্যমে অর্থায়নের ব্যবস্থা করা উচিত। আমরা জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার পর্যায়ক্রমে বন্ধ এবং জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহারের ব্যাপকতা ঠেকানোর চুক্তির দাবিতে ধর্মঘট করেছি। আমরা নিজেদের অভিজ্ঞতা নিয়ে কথা বলেছি এবং সচেতনতা বাড়াতে বিভিন্ন অধিবেশনে যোগ দিয়েছি।

শেষ অবধি ‘কপ-২৭’ একটি তিক্তমধুর অবস্থায় শেষ হয়েছে। অগ্রগতি ছিল, তবে তা যথেষ্ট নয়। জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার পর্যায়ক্রমে বন্ধ করা এবং তাপমাত্রা বৃদ্ধি সীমাবদ্ধ রাখার জন্য আরও সুদৃঢ় পদক্ষেপ ব্যতীত শুধু ক্ষয়–ক্ষতির বিষয়ে সিদ্ধান্ত কোনো দেশের জন্য ঝুঁকির মাত্রা কমাতে পারবে না। একইভাবে, যদিও এ বছর বিশ্বজুড়ে আরও বেশিসংখ্যক তরুণ-তরুণী আলোচনায় যোগদানের সুযোগ পেয়েছেন, তবে অংশগ্রহণকে আরও অর্থবহ কর তুলতে আমাদের দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে হবে।

যদিও সব আলোচনা আমাদের জন্য উন্মুক্ত ছিল না, তবে ইউএন ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন অন ক্লাইমেট চেঞ্জের (ইউএনএফসিসিসি) শিশু ও যুব নির্বাচকমণ্ডলীর সদস্য হিসেবে আমি দ্বিপক্ষীয় বৈঠকগুলোয় যোগ দিয়েছি, যেখানে আমি তরুণদের অংশগ্রহণের প্রয়োজনীয়তা এবং গৃহীত সিদ্ধান্তগুলোয় তাদের সম্পৃক্ততার পক্ষে যুক্তি দিয়েছি।

সম্মেলনে শিশু ও তরুণদের যে ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করা হচ্ছিল, তা বাংলাদেশের একজন নাগরিক হিসেবে আমার কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কেননা, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবের কারণে যেসব দেশের শিশুরা সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে আছে, বাংলাদেশ ইতিমধ্যে সেসব দেশের তালিকায় প্রথম সারিতেই রয়েছে।

তাহলে, কপ-২৭–এ বিশ্বনেতারা কি সেই অগ্রগতি অর্জন করতে পেরেছিলেন, যা আমরা আশা করেছিলাম?

‘কপ-২৭’ থেকে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রাপ্তি হলো, ক্ষয়ক্ষতির জন্য অর্থায়নসংক্রান্ত (লস অ্যান্ড ড্যামেজ ফিন্যান্সিং) চুক্তি। এই ক্ষয়ক্ষতির জন্য অর্থায়ন একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত। বিশেষ করে ‘গ্লোবাল সাউথ’–ভুক্ত ওই সব ঝুঁকিপূর্ণ দেশের জন্য, যারা সরাসরি এই সংকটের জন্য দায়ী নয় এবং যাদের জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবগুলো মোকাবিলার জন্য যথেষ্ট অভিযোজনব্যবস্থা নেই। এই সিদ্ধান্ত হলো সুশীল সমাজ, যুব আন্দোলন ও জলবায়ু সংকটের প্রভাবে ঝুঁকিতে থাকা দেশগুলোর তিন দশকব্যাপী অ্যাডভোকেসির ফল এবং নিঃসন্দেহে একটি বড় সাফল্য। তবে কম আলোচিত হলেও, ‘অ্যাকশন ফর ক্লাইমেট এমপাওয়ারমেন্ট’ শীর্ষক কর্মপরিকল্পনা গ্রহণের বিষয়টিও গুরুত্বপূর্ণ ছিল, যা তথ্য প্রাপ্তির সুযোগ এবং জনসাধারণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার মাধ্যমে শিশু, তরুণসহ সমাজের সব সদস্যকে জলবায়ু কার্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত করার জন্য দেশগুলোর প্রতি আহ্বান জানায়।

কিন্তু আমরা যারা এত দিন ধরে জরুরি পদক্ষেপের আহ্বান জানিয়ে যাচ্ছি, তাদের জন্য জলবায়ু পরিবর্তন প্রশমনের ক্ষেত্রে ‘কপ-২৭’–এর অগ্রগতি হতাশাজনক। আমরা যখন বসবাসের অযোগ্য একটি পৃথিবীর একেবারে কাছাকাছি চলে এসেছি, তখন সম্মেলনে অংশগ্রহণকারী শত শত লবিস্ট জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার পর্যায়ক্রমে বন্ধের বিষয়ে অর্থবহ অগ্রগতিতে বাধা দিতে সফল হয়েছেন। একইভাবে বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসে সীমিত রাখার বিষয়ে চূড়ান্ত চুক্তিতে কোনো পরিবর্তন হয়নি। ‘অভিযোজন কার্যক্রম’ চালু হলেও, তাতে অর্থায়নের বিষয় সুনির্দিষ্ট নয়। ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোকে সাহায্য করার জন্য বীমা উদ্যোগ ‘গ্লোবাল শিল্ড’ চালু হলেও, তাতে ঐতিহাসিকভাবে নির্গমনের জন্য দায়ী ‘গ্লোবাল নর্থ’-ভুক্ত দেশগুলোর অর্থায়ন ও জবাবদিহির জন্য কোনো দায়বদ্ধতার উল্লেখ না থাকা আমাদের জন্য ছিল হতাশাজনক।

‘কপ-২৭’–এর অন্যতম প্রধান লক্ষ্য ছিল, দেশগুলোর জলবায়ু পদক্ষেপের জন্য প্রতিশ্রুতি, যা ‘জাতীয়ভাবে নির্ধারিত অবদান’ (ন্যাশনালি ডিটারমাইন্ড কন্ট্রিবিউশনস) হিসেবে পরিচিত, তা বৃদ্ধি করা। তবে বিশ্বের প্রধান নির্গমনকারী দেশগুলোসহ অনেক দেশ তাদের এই অবদান (ন্যাশনাল ডিটারমাইন্ড কন্ট্রিবিউশনস) আশানুরূপ হারে বৃদ্ধি করেনি।

এই সবকিছু আমাদের লক্ষ্য এবং কর্ম পরিকল্পনার ভেতর বিদ্যমান ঘাটতিগুলো তুলে ধরে; অভিযোজন প্রচেষ্টার জন্য বর্তমানে যে তহবিল রয়েছে, তার সঙ্গে প্রয়োজনীয় পরিমাণের ব্যবধান ব্যাপক। এমন একটি সময়ে যখন আরও বেশি পদক্ষেপের প্রয়োজন, তখন ‘কপ-২৬’–এ নেওয়া ২০২৫ সালের মধ্যে অভিযোজনে তহবিল বাড়ানোর প্রতিশ্রুতি এবার সরিয়ে নেওয়া হয়েছে।

শেষ অবধি ‘কপ-২৭’ একটি তিক্তমধুর অবস্থায় শেষ হয়েছে। অগ্রগতি ছিল, তবে তা যথেষ্ট নয়। জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার পর্যায়ক্রমে বন্ধ করা এবং তাপমাত্রা বৃদ্ধি সীমাবদ্ধ রাখার জন্য আরও সুদৃঢ় পদক্ষেপ ব্যতীত শুধু ক্ষয়–ক্ষতির বিষয়ে সিদ্ধান্ত কোনো দেশের জন্য ঝুঁকির মাত্রা কমাতে পারবে না। একইভাবে, যদিও এ বছর বিশ্বজুড়ে আরও বেশিসংখ্যক তরুণ-তরুণী আলোচনায় যোগদানের সুযোগ পেয়েছেন, তবে অংশগ্রহণকে আরও অর্থবহ কর তুলতে আমাদের দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে হবে।

তবে হতাশার পরিবর্তে, আমি প্রত্যাশা নিয়ে শেষ করছি—‘কপ-২৮’ আসবে জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে উত্তরণের লক্ষ্য নিয়ে, যেখানে ক্ষয়ক্ষতির জন্য অর্থায়নের বিষয়ে একটি সুস্পষ্ট ব্যবস্থা থাকবে এবং যেখানে বছরের পর বছর ধরে জরুরি পদক্ষেপের আহ্বানে নেতৃত্ব দেওয়া তরুণেরা সব পর্যায়ে অর্থপূর্ণভাবে অংশগ্রহণের সুযোগ পাবেন। আমাদের আলোচক হিসেবে গড়ে তুলতে হবে এবং কেবল একটি পৃথক প্যাভিলিয়নের অংশ হিসেবে নয়, সিদ্ধান্ত গ্রহণের মূল আলোচনায় অন্তর্ভুক্ত করতে হবে, যাতে আমরা আমাদের কমিউনিটি এবং আমাদের প্রজন্মের মতামত ও দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিনিধিত্ব করতে পারি। আমাদের ভবিষ্যৎ ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে এবং এ বিষয়ে সিদ্ধান্তগুলোর অংশ হওয়ার অধিকার আমাদের রয়েছে।

  • ফারজানা ফারুক জলবায়ুকর্মী। তিনি একজন ইউনিসেফ বাংলাদেশ ইয়ুথ অ্যাডভোকেট এবং ‘ফ্রাইডেস ফর ফিউচার’ ও থ্রিফিফটি ডট ওআরজির সঙ্গে কাজ করেন।