মার্কিন ও চীনা অস্ত্রের চাপে চ্যাপটা হচ্ছে পাকিস্তান

চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে প্রতিরক্ষা সম্পর্কের ভারসাম্য বজায় রাখতে গিয়ে পাকিস্তান পাটা-পুতার মাঝখানে পড়ে গেছে। করাচিতে একাদশ আন্তর্জাতিক প্রতিরক্ষা প্রদর্শনী ও সেমিনারে (ইন্টারন্যাশনাল ডিফেন্স এক্সিবিশন্স অ্যান্ড সেমিনার, সংক্ষেপে আইডিইএএস) পাকিস্তানের এ দশা একেবারে খুল্লামখুল্লা হয়ে গেছে। ওই প্রদর্শনীতে চীনের সাতটি প্রতিরক্ষা কোম্পানি ৫০টির বেশি দেশ ও অঞ্চলের প্রতিনিধিদের সামনে তাদের উন্নত অস্ত্র প্রদর্শন করেছে।

প্রদর্শনীতে যেসব চীনা অস্ত্র ছিল, তার মধ্যে অন্যতম হলো উইং লুং ড্রোন, সিএইচ-সিরিজ ড্রোন, একটি মাল্টিরোল ড্রোন জাহাজ, ওয়াই-৯ ই পরিবহন বিমান, এল ওয়াই-৭০ এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম, ভিটি-৪ মেইন ব্যাটেল ট্যাংক (এমবিটি), এসআরএস মাল্টিপল লঞ্চ রকেট সিস্টেম (এমএলআরএস), ওয়াইএলসি-২ই মাল্টিরোল রাডার, একটি কমান্ড ইনফরমেশন সিস্টেম, একটি ইলেকট্রনিক ওয়ারফেয়ার ডিফেন্স সিস্টেম ইত্যাদি। চীনের কমিউনিস্ট পার্টি পরিচালিত গ্লোবাল টাইমস এ খবর জানিয়েছে।

গ্লোবাল টাইমস তাদের প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে, পাকিস্তান ইতিমধ্যে যথেষ্ট পরিমাণ চীনা সামরিক সরঞ্জাম ব্যবহার করছে। তার মধ্যে আছে ভিটি-৪ এমবিটি, এসএইচ-১৫, স্বচালিত হাউইটজার, টাইপ ০৫৪ এ/পি ফ্রিগেট, জেএফ-১৭ এবং জে-১০ সি যুদ্ধবিমান, জেডিকে-০৩ পূর্বসতর্কতা দেওয়া বিমান ইত্যাদি। এ অস্ত্র কেনার বিষয়টির কূটনৈতিক প্রভাবকে অধিকতর পেঁচালো করে গ্লোবাল টাইমস–এর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নাম প্রকাশ না করার শর্তে অনিচ্ছুক এক পাকিস্তানি প্রতিরক্ষা কর্মকর্তা বলেছেন, চীনের এসব সামরিক সরঞ্জাম ‘আন্তর্জাতিকভাবে বিখ্যাত’ এবং পাকিস্তান ও চীনের মধ্যকার প্রতিরক্ষা সহযোগিতায় অনুকরণীয় ভূমিকা রাখছে।

নাম প্রকাশ না করা এক চীনা সামরিক বিশেষজ্ঞের বরাত দিয়ে রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত গ্লোবাল টাইমস বলেছে, চীন ও পাকিস্তান তাদের প্রতিরক্ষা সম্পর্ককে আরও গভীর করবে বলে আশা করা হচ্ছে। কারণ, চীনা অস্ত্র পাকিস্তানের জাতীয় প্রতিরক্ষাকে একটি ‘সিস্টেম’ বা ‘ব্যবস্থা’ হিসেবে দাঁড় করিয়েছে। নিঃসন্দেহে পাকিস্তানে চীনের অস্ত্র রপ্তানির লক্ষ্য হলো হিমালয়ে তাদের ক্রমবর্ধমান সীমান্ত বিরোধ (যা সাম্প্রতিক বছরগুলোয় প্রাণঘাতী সহিংসতায় রূপ নিয়েছে) থেকে ভারতের কৌশলগত মনোযোগ সরানো।

গত সেপ্টেম্বরে যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানের এফ-১৬ বিমানবহরের আধুনিকায়নে ৪৫ কোটি ডলারের আপগ্রেড প্যাকেজ অনুমোদন করেছে, যা পাকিস্তানের কাছে অস্ত্র বিক্রির ওপর যুক্তরাষ্ট্রের দীর্ঘস্থায়ী নিষেধাজ্ঞার একটি দৃশ্যমান বিপরীত অবস্থা। পাকিস্তানের এফ-১৬ নবায়নের এই মার্কিন পদক্ষেপের বিষয়ে ভারত কঠোর প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছে। যুক্তরাষ্ট্র নিষেধ করার পরও ভারত রাশিয়ার কাছ থেকে তেল কেনা অব্যাহত রাখায় দিল্লির প্রতি অসন্তোষের ইঙ্গিত হিসেবেও পাকিস্তানের এফ-১৬ নবায়ন করা হতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে।

এ ছাড়া চীন তার বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের (বিআরআই) বিরুদ্ধে থাকা সন্ত্রাসী হুমকি মোকাবিলা করার জন্য পাকিস্তানকে অস্ত্র দেওয়ার চেষ্টা করে থাকতে পারে। কারণ, এই বিআরআই প্রকল্পের মধ্যে বেইজিং-ইসলামাবাদের যৌথ অর্থায়নে ছয় হাজার কোটি ডলারে নির্মিত চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডরে সন্ত্রাসী হামলা এবং পারস্য উপসাগর ও হর্ন অব আফ্রিকা থেকে জলদস্যুতার হুমকি রয়েছে।

পাকিস্তানে চীনের রপ্তানি করা সামরিক সরঞ্জাম সন্দেহজনক মানের হতে পারে। সে কারণে পাকিস্তানের হাতে থাকা ১৯৮০-এর দশক থেকে যুক্তরাষ্ট্রে তৈরি এফ-১৬ জঙ্গি বিমানসহ পাশ্চাত্যের পুরোনো অস্ত্রগুলোকে এখনো তার দীর্ঘদিনের প্রতিদ্বন্দ্বী ভারতের বিরুদ্ধে সক্রিয় সবচেয়ে শক্তিশালী সম্পদ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। জিওপলিটিকা ম্যাগাজিনের চলতি বছরের জুন সংখ্যায় ছাপা হওয়া একটি নিবন্ধে, প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞ ফ্যাবব্রি ডি ভ্যালেরিও উল্লেখ করেছেন, চীনের কাছ থেকে এর আগে কেনা চারটি জুলফিকার ফ্রিগেটের ত্রুটিপূর্ণ ইলেকট্রনিকস, গুরুতর ইঞ্জিন ত্রুটি এবং অকার্যকর অস্ত্র পাকিস্তানি নৌবাহিনীর ক্ষমতাকে অবনমিত করেছে।

এ ছাড়া গত এপ্রিলে দ্য প্রিন্ট এক প্রতিবেদনে বলেছে, পাকিস্তান তার চীনের তৈরি ট্যাংক, রাডার এবং বিমান প্রতিরক্ষাব্যবস্থার কারিগরি ত্রুটিজনিত সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে; ট্যাংকগুলো সরবরাহ-পরবর্তী পরীক্ষায় ব্যর্থ হয়েছে এবং কামানের গোলাগুলোও কাজ করছে না।

নিচু মানের এ আস্থাযোগ্যতাহীন চীনা অস্ত্র পাকিস্তানকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তার দীর্ঘস্থায়ী প্রতিরক্ষা সম্পর্ক বজায় রাখতে বাধ্য করছে। স্নায়ুযুদ্ধের সময় ভারতকে মোকাবিলা করার প্রয়োজনীয়তা এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে ভারতের যূথবদ্ধতাই ছিল মার্কিন-পাকিস্তান প্রতিরক্ষা সম্পর্কের প্রধান অনুঘটক। এরপর পারমাণবিক অস্ত্র বিস্তারের উদ্বেগের কারণে ১৯৯০-এর দশকে যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানের কাছে অস্ত্র বিক্রি স্থগিত করে এবং নাইন–ইলেভেন সন্ত্রাসী হামলার পর সন্ত্রাসবাদ প্রতিরোধে সহযোগিতার কারণে যুক্তরাষ্ট্র তার পাকিস্তানে অস্ত্র সরবরাহের নীতিতে সামান্য পরিবর্তন করে।

এখন যুক্তরাষ্ট্র দক্ষিণ এশিয়ায় চীনের ক্রমবর্ধমান প্রভাব মোকাবিলা করতে পাকিস্তানের সঙ্গে তার সুপ্ত প্রতিরক্ষা সম্পর্ককে পুনরুজ্জীবিত করার চেষ্টা করতে পারে এবং ভারতকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পাকিস্তানকে একটি দর-কষাকষির ঘুঁটি হিসেবে ব্যবহার করতে পারে।

গত সেপ্টেম্বরে যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানের এফ-১৬ বিমানবহরের আধুনিকায়নে ৪৫ কোটি ডলারের আপগ্রেড প্যাকেজ অনুমোদন করেছে, যা পাকিস্তানের কাছে অস্ত্র বিক্রির ওপর যুক্তরাষ্ট্রের দীর্ঘস্থায়ী নিষেধাজ্ঞার একটি দৃশ্যমান বিপরীত অবস্থা। পাকিস্তানের এফ-১৬ নবায়নের এই মার্কিন পদক্ষেপের বিষয়ে ভারত কঠোর প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছে। যুক্তরাষ্ট্র নিষেধ করার পরও ভারত রাশিয়ার কাছ থেকে তেল কেনা অব্যাহত রাখায় দিল্লির প্রতি অসন্তোষের ইঙ্গিত হিসেবেও পাকিস্তানের এফ-১৬ নবায়ন করা হতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে।

এশিয়া টাইমস থেকে নেওয়া, অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ

জোয়েল হনরাদা এশিয়া টাইমস–এর সিনিয়র সিকিউরিটি করেসপনডেন্ট এবং রাশিয়ার পিপলস ফ্রেন্ডশিপ ইউনিভার্সিটির সহকারী প্রভাষক