সম্প্রতি কার্নেগি এন্ডাউমেন্ট ফর ইন্টারন্যাশনাল পিসের জ্যেষ্ঠ ফেলো এবং ইউক্রেন যুদ্ধ সম্পর্কে অগ্রবর্তী বিশ্লেষক মাইকেল কফম্যান বলেছেন, পশ্চিমারা একটি ‘দীর্ঘ যুদ্ধের জন্য পরিকল্পনা করেছে’। তিনি মনে করেন, ইউক্রেন এখন সামরিক (গোলাবারুদ, আকাশ প্রতিরক্ষা, ইলেকট্রিক্যাল যুদ্ধসরঞ্জাম ও প্রশিক্ষণ) দিক থেকে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে।
মাইকেল কফম্যানের এই বিশ্লেষণ সঠিক। ব্যাপক মাত্রায় সামরিক অভিযানকে সামনে রেখে বিষয়টি খাটো করে দেখার সুযোগ নেই। সম্প্রতি আমি কিয়েভ সফর করেছি। আমি দেখেছি সাহসিকতা, সহনশীলতা ও অঙ্গীকার রক্ষার প্রতি ইউক্রেনের সাধারণ মানুষ কতটা অনন্য। কিন্তু এটাও সত্য যে দৃশ্যমান হোক অদৃশ্যমান হোক, সাধারণ মানুষকেই যুদ্ধের ক্ষতি বইতে হচ্ছে। যুদ্ধ যখন খুব দ্রুত শেষ হচ্ছে না, তখন শুধু সামরিক খাতে নয়, ইউক্রেনের নাগরিকদের জীবনযাপন ও মানবিক প্রয়োজনগুলো পূরণ কীভাবে করা যায়, সে পরিকল্পনা অবশ্যই করতে হবে।
কিন্তু লক্ষণ যা দেখা যাচ্ছে, সেটা মোটেই শুভকর নয়। ইউক্রেনীয়দের জন্য দেওয়া মানবিক সহায়তার প্রবাহ কমে গেছে। যুদ্ধ বন্ধ না হওয়ায় এবং জীবনযাত্রার ব্যয় অনেকটা বেড়ে যাওয়ায় বিভিন্ন দেশের সাধারণ মানুষের মধ্যেও ইউক্রেনের জন্য সহযোগিতা দেওয়ার স্পৃহা কমে গেছে। গত জুন মাসে লন্ডনে ইউক্রেন পুনর্গঠনে ৬০ বিলিয়ন বা ৬ হাজার কোটি টাকা সহায়তা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি এসেছে। অবকাঠামো পুনর্গঠনকেই সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। তাহলে মানবিক অবকাঠামো পুনর্গঠনের কী হবে?
বিপদের জায়গা হলো, অস্বাভাবিকতাকেই এখন স্বাভাবিকতা বলে ভাবা হচ্ছে। ইউক্রেনের সাধারণ মানুষ পর্বতপ্রমাণ চাপের মুখে রয়েছে। তারা তাদের প্রিয় মানুষগুলোকে হারিয়েছে অথবা হারানোর ভয়ে বিহ্বল। শিশুরা তাদের স্কুলে যেতে পারছে না। মধ্যরাতে বিমান হামলার সতর্কীকরণ বার্তায় ঘুম ভেঙে যাচ্ছে।
অভ্যন্তরীণভাবে বাস্তুচ্যুত মানুষের স্রোত বিপুল পরিমাণে বেড়েই চলেছে। কাখোভা বাঁধ ধ্বংসের কারণে বানের পানিতে ভেসে অবিস্ফোরিত স্থলমাইন লোকালয়ে চলে এসেছে। ১৯ মাসের যুদ্ধে সাধারণ মানুষের হতাহতের সংখ্যা বাড়তে বাড়তে এখন ২৭ হাজারে পৌঁছেছে।
২০২২ সালে ইউক্রেনে মানবিক সহায়তা দেওয়ার ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক মহল যে সাড়া দেয়, সেটা একটা ভালো দৃষ্টান্ত। জাতিসংঘ যে আবেদন জানিয়েছিল, তার ৮০ শতাংশের বেশি পাওয়া গিয়েছিল। ইয়েমেন ও সিরিয়ার মতো অন্যান্য সংঘাতকবলিত দেশ মাত্র এক–চতুর্থাংশ সহায়তা পেয়েছিল। কিন্তু এ বছর ইউক্রেন পেয়েছে মাত্র ৫০ শতাংশের কিছুটা বেশি সহায়তা।
শুধু সাহস আর সহনশীলতা দিয়ে এই শূন্যতা পূরণ করা সম্ভব নয়। এখন ইউক্রেনের ১ কোটি ৮০ লাখ মানুষের মানবিক সহায়তা প্রয়োজন; বিশেষ করে যেসব এলাকা যুদ্ধক্ষেত্রের কাছাকাছি অবস্থিত অথবা যেসব এলাকা অস্থায়ীভাবে রাশিয়ার সামরিক বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। প্রায় ৬০ লাখ মানুষ অভ্যন্তরীণভাবে বাস্তুচ্যুত হয়েছে। যুদ্ধ অব্যাহত রয়েছে।
ইন্টারন্যাশনাল রেসকিউ কমিটির ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলের (পুরো দেশের জন্যই সত্যি) অভিজ্ঞতা বলছে, ভুক্তভোগীরা তীব্র মানসিক ট্রমার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। এ ছাড়া বয়স্ক ও শারীরিক প্রতিবন্ধীদের যারা পালিয়ে যেতে পারেননি, তাঁদের জন্য জরুরি ভিত্তিতে বড় ধরনের সহায়তা প্রয়োজন।
এরই মধ্যে শীত মৌসুমে করণীয় কী, সেটা নতুন অগ্রাধিকার হয়ে দাঁড়িয়েছে। গত বছর ইউক্রেনীয়দের হিমশীতল তাপমাত্রার মুখোমুখি হতে হয়েছিল। এর মধ্যেই রাশিয়ান বাহিনী ইউক্রেনের পানি এবং গ্যাস-বিদ্যুৎ-জ্বালানি অবকাঠামো লক্ষ্য করে হামলা চালিয়েছিল। তাদের উদ্দেশ্য ছিল ইউক্রেনীয়দের অত্যাবশ্যকীয় সেবা থেকে বঞ্চিত করে তাদের অস্তিত্বকে বিপন্ন করে দেওয়া। এই সামরিক কৌশল যুদ্ধ আইনের পুরোপুরি পরিপন্থী।
সাধারণ মানুষ বাস করে—এ রকম একটি যুদ্ধক্ষেত্রে দীর্ঘ যুদ্ধের পরিকল্পনা করলে সেখানকার মানুষের শারীরিক স্বাস্থ্যের পাশাপাশি মানসিক স্বাস্থ্যের ওপরও সমান গুরুত্ব দিতে হবে। বিশেষ করে সবচেয়ে নাজুক জনগোষ্ঠী শিশু ও বয়স্কদের ক্ষেত্রে সেটা সবচেয়ে জরুরি।
এর মানে হলো, একটি কার্যকর মানবিক কার্যক্রম প্রয়োজন। বাজার অর্থনীতিকে টিকিয়ে রাখতে গেলে আক্রান্ত জনগোষ্ঠীর জন্য নগদ সহায়তা প্রয়োজন। এর সঙ্গে স্বাস্থ্য ও শিক্ষাসেবা সহজলভ্য করতে হবে। ইউক্রেনের এই সংকটকালে এ ধরনের উল্লেখযোগ্য কিছু কাজও হচ্ছে। ইউক্রেনের শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পাশাপাশি এনজিওগুলোও অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করছে। ইউক্রেনের সিভিল সোসাইটি সংগঠনগুলোকেও জরুরি ভিত্তিতে সহযোগিতা করা প্রয়োজন। যেকোনো দুর্যোগে তারাই সবার আগে আক্রান্ত মানুষের পাশে দাঁড়াচ্ছে।
২০২২ সালে ইউক্রেনে মানবিক সহায়তা দেওয়ার ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক মহল যে সাড়া দেয়, সেটা একটা ভালো দৃষ্টান্ত। জাতিসংঘ যে আবেদন জানিয়েছিল, তার ৮০ শতাংশের বেশি পাওয়া গিয়েছিল। ইয়েমেন ও সিরিয়ার মতো অন্যান্য সংঘাতকবলিত দেশ মাত্র এক–চতুর্থাংশ সহায়তা পেয়েছিল। কিন্তু এ বছর ইউক্রেন পেয়েছে মাত্র ৫০ শতাংশের কিছুটা বেশি সহায়তা।
ইউক্রেন থেকে খাদ্যশস্য রপ্তানির ওপর রাশিয়া অবরোধ সৃষ্টি করায় পরিস্থিতি আরও শোচনীয় হয়েছে। এ ঘটনা বৈশ্বিক খাদ্যবাজারেও বিপর্যয় ডেকে আনছে। জাতিসংঘের দুর্ভিক্ষ নজরদারি তালিকায় নয়টি দেশ রয়েছে। পূর্ব আফ্রিকার ৫ কোটি মানুষ প্রতিদিন ক্ষুধা নিয়ে ঘুমাতে যাচ্ছে। তাদেরও সহযোগিতা প্রয়োজন।
এই সমস্যাগুলোর ওপর যদি নজর না দেওয়া হয়, তাহলে পরিস্থিতি আরও শোচনীয় হবে। আমাদের নেতাদের এ ব্যাপারে এখনই নজর দিতে হবে।
ডেভিড মিলিব্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল রেসকিউ কমিটির সিইও এবং যুক্তরাজ্যের লেবার পার্টির সাবেক এমপি
গার্ডিয়ান থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত