মতামত

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন: একটি ভীত তরুণ প্রজন্ম গড়ে উঠছে কি

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলায় প্রায় নয় মাস ধরে কারাগারে আছেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী খাদিজাতুল কুবরা। প্রায় একই সময়ে গত বছরের সেপ্টেম্বরে ধর্ম অবমাননার অভিযোগে রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের (বেরোবি) সুজন চন্দ্র পাল নামের আরেক শিক্ষার্থীকে আটক করা হয়েছিল।

একই আইনে ওই মাসেই খুলনা প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (কুয়েট) প্রশাসনের করা মামলায় সিএসই বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী জাহিদুর রহমানকে গ্রেপ্তার করা হয়।

গত বছর প্রথম আলোয় ‘শিশু-কিশোরেরাও মামলা থেকে রেহাই পাচ্ছে না’ শিরোনামে প্রকাশিত প্রতিবেদনটির দিকে যদি নজর দিই, তাহলে দেখা যায়, ১২টি জেলায় ১৩ থেকে ১৭ বছরের প্রায় ২০ জন শিশু-কিশোরের বিরুদ্ধে ১৮টি মামলা করা হয়েছে।

প্রায় একই ধরনের কথা বলছে সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স স্টাডিজের (সিজিএস) গবেষণা প্রতিবেদন। গত ১২ এপ্রিল বিবিসি বাংলার এক প্রতিবেদনে সিজিএসকে উদ্ধৃত করে বলা হয়েছে, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে ২১ শিশু আটক এবং ২৬ শিশু অভিযুক্ত হয়েছে।

তবে এসব মামলায় অভিযোগ তোলা হয়েছে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত, রাজনৈতিক মতাদর্শবিরোধী কথাবার্তা কিংবা অনলাইন জুয়ায় জড়িয়ে পড়ার বিষয়ে।

সমাজের কিছু কিছু স্তরে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন যে থাবা ফেলেছে, তারই অংশ হিসেবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বড় ধরনের ক্ষতির মুখে পড়তে যাচ্ছে। বিশেষ করে আগামী প্রজন্ম যে বাংলাদেশকে পাবে, কিংবা ভয় বা মতামত প্রকাশের স্বাধীনতা থেকে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী গড়বে, এটি বিশ্বায়নের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ হবে কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে।

এখন প্রশ্ন হলো, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনটি আমাদের শিক্ষার্থীদের মনে কী ধরনের প্রভাব ফেলছে? স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের মানসিক বিকাশে এ আইন সত্যি কি বাধা হিসেবে দাঁড়িয়েছে? যদি শিক্ষার্থীদের ওপর প্রভাব ফেলেই, ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য ‘বাংলাদেশ’ কেমন হবে?

২০১৮ সালের ৮ অক্টোবর যাত্রা শুরু করা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনটি কার্যকর হওয়ার পর থেকে নানা সময় ‘অসার’ কাজে প্রয়োগ করা হয়েছে। নানা পেশার মানুষের পাশাপাশি এই আইনের দ্বারা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে আমাদের সংবাদমাধ্যম। বিশেষ করে সাংবাদিকদের পেশাদারির জায়গাটি সংকুচিত হয়েছে।

তবে সাম্প্রতিক সময়ে এ আইন প্রয়োগের মধ্য দিয়ে আমাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ধীরে ধীরে একধরনের ভীতিকর পরিবেশ তৈরি হচ্ছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

ভয়ের সংস্কৃতি কাঁধে নিয়ে বড় হওয়া প্রজন্ম কখনো বিশ্ব মানবাধিকার সংগঠনগুলোর নেতৃত্ব দিতে পারবে না। মুখ বুজে থাকা শিক্ষার্থীরা নিশ্চয় জাতিসংঘে গিয়ে নিজেদের অধিকার আদায় করার সাহসটুকু পাবে না। বেঁধে দেওয়া শব্দ ও বাক্যে মস্তিষ্কের বিকাশ কখনো হওয়া সম্ভব নয়। যেটি হবে, তা হলো পক্ষাঘাতগ্রস্ত প্রজন্ম, যারা না পারবে বলতে, না পারবে লিখতে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা আগে ক্লাসে পড়াশোনার পাশাপাশি দিকনির্দেশনামূলক বক্তব্য দিতেন, বিভিন্ন উপমা দিয়ে শিক্ষার্থীদের যুক্তি খণ্ডন করতেন। আপনি যদি সেই শিক্ষকদের সঙ্গে কথা বলেন, তাহলে দেখবেন, অনেকেই বলবেন যে তাঁরা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন প্রণয়নের পর থেকে শিক্ষার্থীদের জন্য ক্লাসে লেকচারে সতর্কতা অবলম্বন করছেন। এখন ক্লাসে গেলে তাঁকে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের বলয় স্মরণ রেখে শিক্ষার্থীদের পড়াতে হচ্ছে। ক্লাসে গেলেই তাঁকে হিসাব কষতে হচ্ছে, তাঁর ক্লাসের বক্তব্য কেউ না কেউ মুঠোফোনে রেকর্ড করছে, আর তা বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে।

এই যে বছরখানেক আগের একটি ঘটনার কথাই ধরুন না। মুন্সিগঞ্জের পঞ্চসার ইউনিয়নের বিনোদপুর রাম কুমার উচ্চবিদ্যালয়ে শিক্ষক হৃদয় কৃষ্ণ মণ্ডলকে স্কুলে বিজ্ঞান পড়ানোর সময় শিক্ষার্থীদের ধর্ম ও বিজ্ঞানের মধ্যে সম্পর্ক বোঝাতে গিয়ে যে রোষানলে পড়তে হয়েছিল, তা কি আমরা ভুলে যেতে পারি?

ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেওয়ার অভিযোগে হৃদয় কৃষ্ণ মণ্ডলকে মামলায় পড়তে হয়েছে, পারিবারিক ও সামাজিকভাবে তাঁকে কতই-না নাস্তানাবুদ হতে হয়েছিল।

কোভিডকালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক কাজী জাহিদুর রহমানকে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অব্যবস্থাপনা নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যৌক্তিক সমালোচনার জের ধরে জেলে যেতে হয়েছিল। মামলামোকদ্দমার পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন তাঁকে সাময়িক বহিষ্কার পর্যন্ত করেছিল। প্রায় একই সময়ে রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের (বেরোবি) বাংলা বিভাগের প্রভাষক সিরাজাম মুনিরাকে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলায় গ্রেপ্তারের মতো ঘটনা ঘটেছিল।

শুধু এই শিক্ষকই নন, সারা দেশে শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি বিভিন্ন সময়ে অনেক শিক্ষকই ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মারপ্যাঁচে পড়েছেন বলে বিভিন্ন সময় পত্রপত্রিকায় খবর বের হয়েছে। আপনি যদি গভীরভাবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অধিকার-সংগ্রাম আদায়ের কার্যক্রমগুলো লক্ষ করেন, তাহলে দেখবেন, ২০১৮ সালের পর থেকে একধরনের গুমোট পরিবেশ তৈরি হয়েছে। প্রতিবাদের কণ্ঠস্বর ক্রমান্বয়ে কৃশকায় হয়ে উঠছে।

শ্রেণিকক্ষের বাইরে সমাজ ও রাষ্ট্রের নানা অসংগতি নিয়ে যেসব শিক্ষক কথা বলতেন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সরব থাকতেন, তাঁদের সেই মুক্তবুদ্ধিচর্চা অনেকটাই সংকুচিত করছে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন। ভয়ের সংস্কৃতিতে পাঠদান আর জীবনবোধের আস্বাদ নিয়ে আলোচনায় লাগাম পড়ায় বিশ্ববিদ্যালয়গুলো মৌলিক লক্ষ্য থেকে কিছুটা হলেও সরে যাবে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

অথচ এক দশক আগেও বিশ্ববিদ্যালয়শিক্ষকদের জাতির বিবেকের সঙ্গে তুলনা করা হতো। দেশের ভালো-মন্দ বিষয় নিয়ে প্রকাশ্য কথা বলার শক্তি ও সাহসটুকু ছিল। সমাজ, রাজনীতি নিয়ে মাথা ঘামানো মানুষগুলো ঝিমিয়ে পড়ছে। এই আইনে তাঁদের স্বাধীনচেতা মানসিকতা ধীরে ধীরে খর্বকায় হয়ে উঠছে। বিবেক কোণঠাসা হয়ে পড়ায় ভবিষ্যতে আমরা ঠিক কোন বিশ্ববিদ্যালয় পাব, তা অনুমেয়।

অন্যদিকে, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন শিক্ষার্থীদের মানসিক বিকাশে ঠিক কতটা প্রভাব ফেলছে, তা গবেষণা না করে বলা কঠিন। শ্রেণিকক্ষের বাইরে বিশ্ববিদ্যালয় যে একজন শিক্ষার্থীর মানসিক বিকাশে অন্যতম নিয়ামক, সে ধারণায় বড় ধরনের টান পড়েছে। আপাতদৃষ্টে মনে হচ্ছে, এই আইন কার্যকরের মধ্য দিয়ে শিক্ষার্থীরা আগে যেভাবে নিজেদের অধিকার, সরকার কিংবা প্রশাসনের অন্যায়ের বিরুদ্ধে নিজেরা সোচ্চার থাকত, সেই জায়গা থেকে তারা সরে গিয়েছে। তাদের মনের ভেতর একধরনের ভয়ভীতির সঞ্চার হয়েছে।

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন শিক্ষার্থীদের কাছে একধরনের ‘সেলফ সেন্সরশিপ’ তৈরি করে দিচ্ছে। ফলে তারা মুক্তভাবে তাদের চিন্তার প্রতিফলন ঘটাতে ব্যর্থ হচ্ছে, এমনকি ভিন্নমত নিয়ে কথা বলার সাহসটুকু হারিয়ে যাচ্ছে। বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে বিতর্কের মধ্যে তৈরি হওয়া নিজেদের সৃজনশীলতার গুণটি সুপ্ত হয়ে যাবে। এই সেন্সরশিপের কারণে শিক্ষার্থীদের নেতৃত্ব দেওয়ার গুণ থেকে শুরু করে যেকোনো অন্যায়ের প্রতিবাদ করার সাহসটুকু উধাও হয়ে যাচ্ছে।

মতামত প্রকাশের জন্য জেলহাজতের যাওয়ার খবর পত্রপত্রিকায় দেখার পর অনেক শিক্ষার্থীর ‘একাডেমিক ফ্রিডম’ কমতে শুরু করছে বলে বিশ্বাস করি। শিক্ষার্থীদের মানসিক বিকাশের অনুষঙ্গগুলো নিয়ে আলোচনা করার ক্ষমতা কমতে থাকায় তারা ধীরে ধীরে ‘বোবা প্রজন্ম’ হয়ে যাবে। দেখা যাবে, নিজের ঘাড়ে পাখি মলমূত্র ত্যাগ করলেও সেই পাখিকে সরিয়ে দেওয়ার সাহসটুকু সঞ্চার হবে না।

অথচ বিশ্বায়নের সঙ্গে তাল মিলিয়ে নিজেদের সূক্ষ্ম চিন্তাধারার মানুষ হওয়ার মন্ত্র আসতে হয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। শ্রেণিকক্ষের বাইরে নিজেদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যগুলোর যেমন বিকাশ ঘটতে হয়, তেমনি সমাজ, দেশ কিংবা বিশ্বনেতৃত্বের সূক্ষ্ম গুণাবলি এই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তৈরি হয়। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অজুহাতে আজ আমাদের ছেলেমেয়েরা যে বিষয়ে কথা বলতে ভয় পাচ্ছে, সেই বিষয়গুলো প্রতিবেশী দেশগুলোর বিশ্ববিদ্যালয়ে ঘটা করে চর্চা হয়। তারা জানে, সনদ দেওয়ার পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের বিশ্ব নাগরিকদের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করার যোগ্যতা থাকা চাই।

ভয়ের সংস্কৃতি কাঁধে নিয়ে বড় হওয়া প্রজন্ম কখনো বিশ্ব মানবাধিকার সংগঠনগুলোর নেতৃত্ব দিতে পারবে না। মুখ বুজে থাকা শিক্ষার্থীরা নিশ্চয় জাতিসংঘে গিয়ে নিজেদের অধিকার আদায় করার সাহসটুকু পাবে না। বেঁধে দেওয়া শব্দ ও বাক্যে মস্তিষ্কের বিকাশ কখনো হওয়া সম্ভব নয়। যেটি হবে, তা হলো পক্ষাঘাতগ্রস্ত প্রজন্ম, যারা না পারবে বলতে, না পারবে লিখতে।

এমনিতে প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থা আমাদের মানসিক বিকাশের সহায়ক নয়; সেই জায়গায় যদি এভাবে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন শিক্ষার্থীদের মস্তিষ্কের স্বাভাবিক চিন্তা-চেতনায় বাধা দেয়, বাক্‌-স্বাধীনতার জন্য আমাদের বাচ্চাদের মাসের পর মাস জামিন-অযোগ্য মামলায় জেলহাজতে থাকতে হয়, তাহলে এই জাতির প্রগতি একসময় থমকে যাবে। যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন করার অধিকার হারিয়ে ফেলবে। নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য যে মানসিক বিকাশের প্রয়োজন, তা ম্লান হয়ে পড়বে।

যে দেশের শিক্ষার্থীরা মায়ের ভাষার জন্য রক্ত দিয়েছে, দেশের স্বাধীনতার জন্য প্রাণ দিয়েছে, সে দেশের শিক্ষার্থীদের মন-মগজে পেরেক মেরে দিয়ে আমরা কোনো দেশ বিনির্মাণ করব? বাক্‌-স্বাধীনতার চর্চা যেখান থেকে শুরু হয়, সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মুক্তবুদ্ধিচর্চায় ‘অনুভূতি’র আঘাত বস্তুত আমাদের ভবিষ্যতের জন্য সর্বনাশ ডেকে আনা ছাড়া কিছু নয়।

মনে রাখতে হবে, শিক্ষার্থীদের মস্তিষ্কের সুস্থ বিকাশ মানে হলো একটি দেশের বিকাশ। শিক্ষকদের উন্মুক্ত জ্ঞানচর্চার পরিবেশ তৈরি করে দেওয়া মানে একটি সুস্থ সভ্যতার সোপান তৈরি করা। ভয় দেখিয়ে, ভিন্নমত দমনের রাজনীতিক কৌশল শিক্ষায় যেন না পড়ে, সেদিকে সাবধান থাকা জরুরি। স্বাভাবিক চিন্তাভাবনা কিংবা যৌক্তিক খণ্ডনের স্বাধীনতা যে আইন খর্ব করে—এমন আইন আদৌও আমাদের প্রয়োজন নেই। শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মানসিক পীড়নের সহায়ক—এমন আইন অন্তত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রয়োগ করা হোক, তা কোনো বিবেকবান মানুষ চাইবে না। আশা করি, সরকার এসব বিতর্কিত আইনের ধারা সংশোধন কিংবা বাতিল করে আমাদের শিক্ষার্থীদের মানসিক উন্মেষে সহায়তা করবে। অন্ধকার কেটে আলোকচ্ছটা চারদিকে ছড়িয়ে পড়ুক—এ প্রত্যাশা করি।

  • ড. নাদিম মাহমুদ গবেষক, ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়। ই–মেইল: nadim.ru@gmail.com