মতামত

নির্যাতনের ঘটনা কি ‘এক্সপাঞ্জ’ করার বিষয়ে পরিণত হলো

‘রাষ্ট্র পেল গুলির দাম, গুলিবিদ্ধ তরুণ পেল না কিছুই’, ‘ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের উপেক্ষা করছে ক্ষমতাসীন দল’, ‘সাংবাদিক রব্বানি হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় ১১ দূতাবাস-হাইকমিশনের উদ্বেগ’, ‘টঙ্গীর সাতাইশ বাগানবাড়িতে বকেয়া বেতনের দাবিতে আন্দোলনরত শ্রমিকদের ওপর সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ’, ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিল চান ভুক্তভোগীরা’, ‘চলন্ত বাসে ধর্ষণ ও নির্যাতন, পোশাককর্মীদের নিরাপত্তা দেবে কে?’ ‘গেস্টরুম নির্যাতনের কথা বলায় বক্তব্য এক্সপাঞ্জ’, ‘জাতীয় নির্বাচনে বিএনপির সম্ভাব্য প্রার্থীদের গোয়েন্দা বাহিনী তুলে নিচ্ছে, অভিযোগ ফখরুলের’।

চলতি মাসের ২১ থেকে ২৫ তারিখ পর্যন্ত সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত খবর ও সম্পাদকীয়র শিরোনামের একাংশ ছিল এমন। বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ, ধর্মীয় সংখ্যালঘু, সাংবাদিক, শ্রমিক, ছাত্র, নারী ও বিরোধী দলের প্রতিনিধিরা কিংবা তাঁদের সম্পর্কে ছাপা হয়েছে এই খবরগুলো। এর বাইরেও এই সময়ের আগে-পরে হেফাজতে মৃত্যু ও তা ধামাচাপা দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে। যাঁরা গুমের শিকার হয়েছেন, তাঁদের মা-স্ত্রী-বোন ও সন্তানেরা রাস্তায় দাঁড়িয়ে কেঁদেছেন। ঘটনাচক্রে আজ ২৬ জুন জাতিসংঘ ঘোষিত ‘ইন্টারন্যাশনাল ডে ইন সাপোর্ট অব ভিকটিমস অব টর্চার’ (নির্যাতনের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক দিবস)। দিবসটির লক্ষ্য নির্যাতন মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ—এ ধারণা প্রচার।

ভুক্তভোগী ছাড়াও বাংলাদেশের নির্যাতন-মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে সাম্প্রতিক সময়ে কথা বলেছেন ছয় মার্কিন কংগ্রেসম্যান, বিরোধী দল বিএনপি ও আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা-কর্মী ও আলোচকেরা। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের এই সময়ে যা বলেছেন, তা এমন—‘আমেরিকার ছয়জন কংগ্রেসম্যান চিঠি দিয়েছেন। এই চিঠিগুলোর মর্মকথা হচ্ছে, বাংলাদেশে মানবাধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে। বাংলাদেশে সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত করতে হবে। এটা তাদের মাথাব্যথা—আমাদের দেশ!’

তিনি ও তাঁর দল এসবের পেছনে গভীর ষড়যন্ত্রের আভাস দেখছেন। বিদেশিদের কাছে নালিশ দেওয়ার অভিযোগ করছেন। সবশেষ গতকাল ২৫ জুন পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম বলেন, তাদের (যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচ-এইচআরডব্লিউ) ওপর দায়িত্ব বিশ্বের মানবাধিকার নিয়ে কাজ করার। কিন্তু তারা কোনো এক অদ্ভুত কারণে যুদ্ধাপরাধের বিচারের সময় থেকে ধারাবাহিকভাবে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে।

আদতে সরকার নির্যাতন, মানবাধিকার লঙ্ঘন—এসব নিয়ে কথা বলতে পছন্দ করে না। নালিশ দেওয়া/বিচার চাওয়াও না। মন্ত্রীদের বাণী ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ক্ষমতাসীনদের পক্ষে কথা বলা বুদ্ধিজীবীদের ভাষ্য হলো, কিল খেয়ে কিল হজম করতে হবে। সুবিচার না পাওয়ার আশঙ্কা থেকে, অনেকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ইহকালের নির্যাতনের জন্য পরকালে বিচারের অপেক্ষায় থাকতে বলেন প্রায়ই। এর পেছনে কারণ আছে।

বাংলাদেশের সংবিধান বলছে, প্রজাতন্ত্র হইবে একটি গণতন্ত্র, ‘যেখানে মৌলিক মানবাধিকার ও স্বাধীনতার নিশ্চয়তা থাকিবে, মানবসত্তার মর্যাদা ও মূল্যের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ নিশ্চিত হইবে এবং প্রশাসনের সব পর্যায়ে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে জনগণের কার্যকর অংশগ্রহণ নিশ্চিত হইবে।’ সরকার সংবিধানকে থোড়াই কেয়ার করছে। তারা দেশের মানুষকেও চুপ করিয়ে দিতে চেয়েছে এবং আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোকেও এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছে ক্রমাগত।

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অপব্যবহার নিয়ে হাজারো সমালোচনার পরও রাষ্ট্রযন্ত্র থেমে নেই। লোকজনকে ধরছে, গারদে পুরছে এবং আদালত তাদের জামিন দিচ্ছেন না। এ ক্ষেত্রে আসামি নারী, পুরুষ, না শিশু, কোনো কিছুই আমলে নিচ্ছেন না তাঁরা।

যেমন সরকার জাতিসংঘের কমিটি অ্যাগেইনস্ট টর্চার (নির্যাতন বিরোধী কমিটি-ক্যাট) এর কাছে প্রতিবেদন জমা দেয়নি। নির্যাতন এবং অন্যান্য নিষ্ঠুর, অমানবিক অথবা মর্যাদাহানিকর আচরণ বা শাস্তির বিরুদ্ধে কনভেনশন ১৯৯৮ সালে বাংলাদেশ অনুমোদন দেয়। পরের বছর প্রতিবেদন জমা দেওয়ার কথা থাকলেও সেটি পেশ করে ২০১৮ সালে।

মূল্যায়নের পর জাতিসংঘের নির্যাতন বিরোধী কমিটি-ক্যাট সরকারকে দেশের কোথায় গুপ্ত কোনো কুঠি আছে কি না, তা খুঁজে দেখে সেগুলোর তথ্য প্রকাশ, গুমের ঘটনায় জড়িতদের বিরুদ্ধে শাস্তি নিশ্চিত করা, কমিটিকে যেসব বেসরকারি সংস্থাকে সব ধরনের হয়রানি থেকে মুক্ত রাখার উদ্যোগসহ আরও বেশ কিছু সুপারিশ করেছিল। এই সুপারিশগুলো বাস্তবায়নে অগ্রগতির কথা ২০২০ সালে ক্যাটকে জানানোর কথা ছিল সরকারের। জানায়নি।

জাতিসংঘের হিউম্যান রাইটস কাউন্সিলের তত্ত্বাবধানে ইউনিভার্সাল পিরিয়ডিক রিভিউর (ইউপিআর) মধ্যবর্তী প্রতিবেদনে বেসরকারি সংস্থাগুলো বলেছে, সরকারকে সদস্যরাষ্ট্রগুলো যে সুপারিশ করেছিল, তার অনেক কিছুই তারা মানেনি। যেমন ফ্রান্স ও সুইজারল্যান্ডের সুপারিশ ছিল বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, গুম ও নির্যাতন বন্ধে উদ্যোগ নেওয়া এবং দ্রুত ঘটনাগুলোর তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া। কানাডা শান্তিপূর্ণ সমাবেশের অধিকার নিশ্চিত করতে বলেছিল।

স্লোভাকিয়ার সুপারিশ ছিল বাংলাদেশের গণমাধ্যমকর্মীরা যেন সেন্সরশিপ, হুমকি, শারীরিক লাঞ্ছনা ও হত্যার শিকার না হন, তা নিশ্চিত করা। কোনোটাই করেনি তারা। সে কারণেই ক্যাটকে প্রতিবেদন জমা দেয়নি কি না কে জানে। অবশ্য ইউপিআর প্রক্রিয়ায় সরকার অংশ নেয়। চলতি বছরের আগস্টে সরকারের এই প্রতিবেদন পেশ করার কথা রয়েছে। সরকার মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে এখন কী বলে, সেটাই দেখার বিষয়।

মুশকিল হচ্ছে, যে যা-ই বলুক, সরকার মানবাধিকার লঙ্ঘনের কথা শুনতেই চায় না; ব্যবস্থা নেওয়া তো দূরে থাক। এ কথা সবাই জানে, র‍্যাবের মহাপরিচালকসহ সাতজনের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা জারির পরও টেকনাফের পৌর মেয়র একরামুল হককে কথিত ‘ক্রসফায়ারে’ হত্যার বিচার একচুলও এগোয়নি। বরং কাদের ‘প্ররোচনা’য় নিষেধাজ্ঞা, সেই খোঁজ শুরু হয়। গুমের শিকার পরিবারগুলো নতুন করে হয়রানির মুখে পড়ে। বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড নিয়ে সংবাদ প্রকাশের পর সাক্ষাৎকার দানকারী তরুণ নাফিজ মো. আলমকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে।

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অপব্যবহার নিয়ে হাজারো সমালোচনার পরও রাষ্ট্রযন্ত্র থেমে নেই। লোকজনকে ধরছে, গারদে পুরছে এবং আদালত তাদের জামিন দিচ্ছেন না। এ ক্ষেত্রে আসামি নারী, পুরুষ, না শিশু, কোনো কিছুই আমলে নিচ্ছেন না তাঁরা। প্রথম আলোর খবরে প্রকাশ, এই সময়ে ২২৯ জন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা হয়েছে।

সবশেষ গতকাল ২৫ জুন বেসরকারি আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর মোর্চা ওয়ার্ল্ড অর্গানাইজেশন অ্যাগেইনস্ট টর্চার (ওএমসিটি) বিবৃতি দিয়েছে। তারা বলেছে, চলতি বছরে দুই ব্যবসায়ী নির্যাতন ও চাঁদাবাজির শিকার হয়ে পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মামলা করেছেন, সাতক্ষীরার সাংবাদিক রঘুনাথ খাঁ অভিযোগ করেছেন গোয়েন্দা বিভাগ তাঁকে চোখ বেঁধে নির্যাতন করেছে, আবু হাসান রাজীব নামের ঢাকার এক আইনজীবী নিখোঁজ ছিলেন, গাজীপুরে সুতা ব্যবসায়ী রবিউল ইসলাম হেফাজতে মারা গেছেন।

এই মোর্চা অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে অভিযোগ খতিয়ে দেখে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি করেছে। তারা বলেছে, বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় বাহিনীগুলো একরকম দায়মুক্তি ভোগ করছে।
এই যে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ ধামাচাপা দেওয়া কিংবা দেখেও না দেখার ভান করা, তার সঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মো. আখতারুজ্জামানের আচরণের বেশ মিল পাওয়া যায়।

সংবাদমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, গত ২১ জুন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নীতিনির্ধারণী ফোরাম সিনেটের বার্ষিক অধিবেশনে বিএনপিপন্থী শিক্ষকদের সংগঠন সাদা দলের আহ্বায়ক মো. লুৎফর রহমান ও আরেক শিক্ষকনেতা অধ্যাপক এ বি এম ওবায়দুল ইসলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘গেস্টরুম নির্যাতন’ নিয়ে কথা বলেন। উপাচার্য লুৎফরের বক্তব্যকে ক্যাম্পাসের ‘নেতিবাচক চিত্রায়ণ’ বলে আখ্যা দিয়ে বলেন, ‘এটি খুবই অসত্য। এসবের সঙ্গে আমরা পরিচিত নই। গেস্টরুমে অতিথিরা আসেন, বসেন।’

তবে এ কথাও সত্য, মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা কেবল ২০০৮ থেকে ২০২৩ পর্যন্তই ঘটেনি; তার আগেও ঘটেছে। আশ্চর্য হতে হয় রাষ্ট্র মেরামতে বিএনপির ২৭ দফা দেখে। তারা কমিশন গঠনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। এই কমিশন শুধু এই সরকারের আমলের ঘটনাগুলো খতিয়ে দেখবে। তাহলে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে ‘ক্রসফায়ারে’ যাঁরা নিহত হলেন, তাঁদের পরিবার কোথায় যাবে? কিংবা ২০০১ সালের নির্বাচনের পর সংখ্যালঘুদের ওপর যে নির্যাতন, তার বিচার কে করবে? ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শামসুন্নাহার হলে মধ্যরাতে পুলিশ ঢুকিয়ে ছাত্রীদের ওপর নির্যাতনও তাদের আমলের ঘটনা।

প্রশ্ন হলো, মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনায় যদি ‘এক্সপাঞ্জ’ করার এই রীতি চলতেই থাকে, মানুষ তাহলে কার কাছে যাবে?

  • শেখ সাবিহা আলম প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক