বেসরকারি কর্মজীবীদের জন্য এবার আইন প্রণয়ন হবে কি

নতুন বাংলাদেশ এবং নতুনভাবে মানুষের স্বপ্ন দেখা শুরু। কিন্তু বাংলাদেশের বেসরকারি খাতের মানুষেরা এখনো স্বপ্ন দেখার সাহস পাচ্ছেন না। পাবেনই বা কীভাবে? সবার জন্য আইন আছে। কিন্তু বেসরকারি কর্মজীবীদের জন্য আইন এখনো দূর অস্ত। যেখানে আইন নেই, সেখানে সংস্কার হবে কীভাবে?

আমাদের সবার ধারণা, এখানে আইন আছে। হ্যাঁ, আমাদের যাঁরা কর্মচারী তাঁদের জন্য শ্রম আইন এবং যাঁরা কর্মকর্তা তাঁদের জন্য আছে ১৮৭২ সালের চুক্তি আইন বা কন্ট্রাক্ট ল। তবে সেটা আসলে সব চুক্তির জন্যই প্রযোজ্য। বেসরকারি চাকরিজীবীদের জন্য নয়। ফলাফল, যেকোনো মামলাই ঝুলে থাকে বছরের পর বছর। নিজে দুটি বিদেশি কোম্পানির প্রধান নির্বাহী থাকা অবস্থায় যখন নিজের কোম্পানিতে সুযোগ দেওয়ার চেষ্টা করেছি, তখন বিদেশি মালিক ও মানবসম্পদ কর্মকর্তাদের থেকে শুনতে হয়েছে, ‘তোমাদের দেশের আইনে তো নেই। কেন দেব?’

এটা বাস্তবতা। এখনকার অর্থনৈতিক অবস্থায় বেশির ভাগ বেসরকারি খাতই সুযোগ-সুবিধা দিতে অপারগ। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, সুখী কর্মচারী কোম্পানিকে আরও সফল করতে পারে। হয়তো এই সুযোগ-সুবিধার ফলে কোম্পানির ৩ থেকে ৫ শতাংশ খরচ বাড়বে, কিন্তু কর্মদক্ষতা বাড়ার সুবিধা পাওয়া যাবে অনেক বেশি। যার সুফল শুধু কোম্পানি না, দেশও পাবে।

কিন্তু উঁচু পদের কিছু কর্মকর্তা আছেন, যাঁরা নিজেদের কর্মক্ষমতা দেখানোর জন্য এসব সুযোগ দিতে চান না। একবারও কি কেউ ভেবে দেখেন না, বিদেশি কোম্পানিগুলো এত সুযোগ দিয়ে কীভাবে তাদের ব্যবসায় সফলতা নিয়ে এসেছে? এই সুযোগ কিন্তু অনেক অনেক গবেষণার ফল। অন্য জায়গা থেকে কপি করে বসিয়ে দেওয়া নয়। যেহেতু বেশির ভাগ বেসরকারি অফিস এই সুযোগ দেবে না, তাই এখন সরকারের উচিত এগিয়ে এসে ৯৫ শতাংশ জনগোষ্ঠীর জন্য আইন প্রণয়ন করে তাদের ভালো থাকার ব্যবস্থা করা। চলুন আবারও দেখে নিই, কী কী থাকতে পারে আইনে?

দুই দিনের সাপ্তাহিক ছুটি : বিশ্বের বিভিন্ন গবেষণায় কমপক্ষে দুই দিনের সাপ্তাহিক ছুটিতে কীভাবে মানুষজনের কর্মদক্ষতা বাড়ে, তা দেখা গেছে। এ ছাড়া ছুটি থাকলে দেশের অর্থনৈতিক কাজও বৃদ্ধি পায়। মানুষের সুস্বাস্থ্যকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব পাওয়া উচিত, সব অবস্থায়। বাস্তবতা হচ্ছে, মানুষ কাজ করে তার পরিবারের জন্য। তাই পরিবারের সঙ্গে যদি ভালো সময় কাটাতে পারে, তার ফল তাদের কাজে আসবেই। আর দুই দিন ছুটি হলে মূল্যবান বিদ্যুৎ, পেট্রল বা ডিজেল কম খরচ হবে, যা দেশের জন্যই ভালো।

ঢাকা বিশ্বের সবচেয়ে বেশি মানসিক চাপের শহর। আবার ট্রাফিক জ্যামে আমাদের জীবনের বড় একটা অংশ ব্যয় হয়। বর্তমান বিশ্বে এখন অনেক দেশেই তিন দিনের ছুটির ধারণা চলে এসেছে, সেখানে বাংলাদেশে দুই দিন ছুটি চাওয়া কি খুব বেশি? সরকারি অফিসে দুই দিনের ছুটি। তাই বেসরকারিতে না থাকাটাও দ্বৈত নীতি। যা আসলে একটা বৈষম্যও।

আমাদের চাপ কমানো যায়, যদি শুক্রবারের পরিবর্তে রবিবার ছুটি করা হতো। অনেকে ধর্মের কথা বলবেন। কিন্তু বিশ্বের সবচেয়ে বড় মুসলিম দেশ ইন্দোনেশিয়া বা মধ্যপ্রাচ্যের দেশ আরব আমিরাত বা অনেকের স্বপ্নের দেশ তুরস্কে শনি-রবিবার ছুটি। জুমার সময়ে শুধু একটা বড় বিরতি থাকে। ওরা পারলে আমরা কেন পারব না? বিবদমান অবস্থায় বাংলাদেশ বহির্বিশ্বের সঙ্গে মাত্র চার কর্মদিবস পায়। তাই দেশের স্বার্থে এটা ঠিক করা জরুরি। আমি নিজে একটা ইউরোপিয়ান কোম্পানিতে ছিলাম, যেখানে দুই দিনের ছুটির সঙ্গে এক দিন ছিল হোম অফিস। ওদের ব্যবসা কিন্তু প্রতিবছরই বাড়ছে। আগে ৬৫টা দেশে ছিল, এখন ১১০টা দেশে। তবে উৎপাদনমুখী শিল্পে দুই দিন ছুটি এখনো সম্ভব নয়।

সর্বজনীন পেনশন–ব্যবস্থা : আওয়ামী লীগ সরকারের যে সর্বজনীন পেনশন–ব্যবস্থা, তা পুরোপুরি বাতিল করে নতুন করে সবার জন্য নিয়ে আসতে হবে। আমি আগেও এই পেনশন–ব্যবস্থার শুভংকরের ফাঁকি নিয়ে লিখেছি। এ ব্যবস্থা শুধু মানুষের পকেট কাটার জন্য এবং সরকারি ও বেসরকারি ক্ষেত্রের রয়েছে দ্বৈত নীতি। এ ব্যবস্থা বাতিল করে নতুন কিছু পদক্ষেপ নিতে হবে।

প্রভিডেন্ট ফান্ড ও গ্র্যাচুইটি : বেসরকারি খাতের জন্য প্রভিডেন্ট ফান্ড এবং গ্র্যাচুইটি ঐচ্ছিক না রেখে বাধ্যতামূলক করার আইন হোক। এ ব্যবস্থা সহজ করা এবং কোম্পানি রেজিস্ট্রেশনের অংশ হিসেবে চালু করা বাধ্যতামূলক করলে কোম্পানির জন্য কর্মচারীদের দায়বদ্ধতা বাড়ত। সহজে কেউ অন্য চাকরিতেও যেত না।

বিমা ও স্বাস্থ্যসেবা : সবার জন্য স্বাস্থ্যসেবা কোম্পানিগুলোকে নিশ্চিত করাতে পারলে, তা সরকারের জন্যই ভালো। আমাদের চিকিৎসা খরচ এখন অনেক বেড়ে গেছে। কোনো কোনো অসুখ একটা পরিবারকে শেষ করে দিতে পারে। এদিকে কোম্পানির জন্যও এই খরচ বহন করা কঠিন। কিন্তু তাদেরও তো দায়বদ্ধতা আছে। এ অবস্থা থেকে দুই পক্ষকে রক্ষা করতে পারে বিমা। স্বল্প খরচে কোম্পানি থেকে বিমা সুবিধা দিয়ে একটা পরিবারকে সাহায্য করা যায়, কিন্তু এর জন্য আইন প্রয়োজন। এ জন্য অবশ্য বিমা কোম্পানিরও নিজেদের উন্নয়ন করা লাগবে, যাতে মানুষ ভরসা করতে পারে তাদের।

সবেতন ছুটি: এটা এমন একটা বিষয়, কেউ দেয়, কেউ দেয় না। এটা সবার জন্য বাধ্যতামূলক করা উচিত। এটা প্রমাণিত যে প্ল্যান করা ছুটির পর সবাই আরও ভালোভাবে কাজে ফেরত আসতে পারে।

মুনাফার ভাগ দেওয়া: আইনে পরিষ্কারভাবে পেইড আপ ক্যাপিটাল এক কোটির বেশি হলে নিট মুনাফার ৫ শতাংশ দেওয়া বাধ্যতামূলক (ওয়ার্কার্স প্রফিট পার্টিসেপেটরি ফান্ড)। এটা দিলে ট্যাক্সে সুবিধাও হয়। কিন্তু বেশির ভাগ কোম্পানি তা কর্মচারীদের দেয় না। এই মুনাফার ২০ শতাংশ যেহেতু সরকারি ফান্ডে জমা থাকে, তাই এ ব্যাপারে সরকারের শক্ত মনিটর করা উচিত। আর এটা মনিটর করা কঠিন কিছু নয়। কারণ, ট্যাক্স জমা দিতে গেলে বা অডিটেই সব প্রকাশ হয়ে যায়।

মাতৃত্বকালীন ছুটি এবং ডে–কেয়ার: সরকারি অফিসে মাতৃত্বকালীন ছুটি ছয় মাস থাকলেও বেসরকারিতে এই ছুটি ঠিকমতো, অনেকে একেবারেই দিতে চায় না। নারী উন্নয়নে এটা একটা বড় বাধা। এদিকে ভালো ডে–কেয়ার না থাকায় অনেক মা ইচ্ছা থাকলেও চাকরি চালিয়ে নিতে পারেন না। সরকারের এ ব্যাপারে আইন প্রয়োগের মাধ্যমে নারীর ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করা জরুরি।

বার্ষিক বেতন বৃদ্ধি (ইনক্রিমেন্ট): সরকারি খাতে বেতন বৃদ্ধির কোনো ধারাবাহিকতা নেই। দিন দিন মূল্যস্ফীতির ফলে তিন–চার বছর পর দেখা যায়, বেতন আসলে কমে গেছে। তাই আইন করা উচিত, সেই সব কোম্পানি, যারা মুনাফাতে থাকবে তারা যেন প্রতিবছর তাদের কর্মকর্তা–কর্মচারীদের জন্য ন্যূনতম মূল্যস্ফীতি পরিমাণ বেতন বৃদ্ধি করে।

নিজ নিজ প্রাপ্যতা নিশ্চিত করা: অনেক কোম্পানি চাকরি ছাড়ার পর ন্যায্য প্রাপ্য দিতে চায় না। অনেকের দুই–তিন মাসের বেতন, প্রভিডেন্ট ফান্ড বা গ্র্যাচুইটি আটকা থাকে। এ জন্য একটা ওয়ান স্টপ সমাধান কেন্দ্র খুব জরুরি। এ ঘটনা এখন অনেক প্রকট। শুধু দেশি কোম্পানি নয়, ভারতীয় কোম্পানিগুলোও এই দোষে দুষ্ট।

দ্বৈত আইন বাতিল: দেশে সুযোগ-সুবিধায় সরকারি–বেসরকারি চাকরিতে অনেক বৈষম্য আছে। যেমন বৈশাখী বোনাস বা সরকারিতে বেতন–ভাতা সিটিসি কনসেপ্টে হিসাব হয় না, ট্যাক্স সুবিধা, এ রকম অনেক কিছু। এ বৈষম্য দূর করতে হবে।

আমাদের পুরো ব্যবস্থাই আসলে চাকরিজীবীদের চাকর শ্রেণিভুক্ত করে ফেলেছে। নতুন সামাজিক ব্যবস্থায় নতুন আইন প্রণয়ন ও প্রয়োগের মাধ্যমেই এ অবস্থার উন্নয়ন সম্ভব। আগে আইন প্রণয়ন ব্যবসায়ীদের হাতে ছিল। কিন্তু এখন তো সব উচ্চশিক্ষিত মানুষের হাতে। তাঁরা কি এই ৯৫ শতাংশ মানুষের দিকটা দেখবেন না? এই অবস্থা থেকে যদি উত্তরণ সম্ভব হয়, দেশের তরুণেরাও কিন্তু বিসিএসের পেছনে না ছুটে বেসরকারি খাতে কাজ করতে আগ্রহী হবেন।

  • সুবাইল বিন আলম টেকসই উন্নয়নবিষয়ক কলামিস্ট।

contact@subail. com