কয়েক মাস ধরে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাখোঁ ইউক্রেনে সেনা পাঠানোর জন্য হুমকি দিয়ে আসছিলেন।
কয়েক মাস ধরে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাখোঁ ইউক্রেনে সেনা পাঠানোর জন্য হুমকি দিয়ে আসছিলেন।

ইউক্রেনে ‘ফ্রান্সের সেনা’, রাশিয়ার সঙ্গে সরাসরি যুদ্ধ বাঁধবে কি?

সরকারিভাবে ফ্রান্স প্রথম ইউক্রেনে সেনা পাঠাল। ইউক্রেনের ৫৪তম ইনডিপেনডেন্ট ম্যাকানাইজড ব্রিগেডকে সহযোগিতা করার জন্য ফরাসি সেনা পাঠানো হয়েছে। এই সেনারা ফ্রান্সের তৃতীয় পদাতিক রেজিমেন্টের সদস্য। ফ্রান্সের ফরেন লিজিয়ন বা বিদেশিদের নিয়ে গঠিত সেনা ইউনিটের মূল অংশ তাঁরা।

২০২২ সালে ফ্রান্সের ফরেন লিজিয়নে বেশ কিছুসংখ্যক ইউক্রেনীয় ও রাশিয়ান ছিলেন। যুদ্ধ শুরুর পর তাঁদেরকে ইউনিটটি ছেড়ে যাওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়েছিল। ইউক্রেনীয়দের ক্ষেত্রে তাঁদেরকে নিজেদের বাহিনীতে যোগ দেওয়ার সুযোগ দেওয়া হয়েছিল। রাশিয়ানদের ক্ষেত্রে কী ঘটেছিল, সেটা অজানা রয়ে গেছে।

ফরেন লিজিয়নটি এখন ফ্রান্সের সেনা কর্মকর্তাদের দ্বারা পরিচালিত হলেও অধস্তন কর্মকর্তা ও সেনাদের বেশির ভাগই বিদেশি। বিদেশি এই সেনারা তিন বছর মেয়াদে চুক্তিবদ্ধ হয়ে থাকেন। তিন বছর পর তাঁরা ফ্রান্সের নাগরিকত্ব দাবি করতে পারেন। আর তাঁরা যদি যুদ্ধ করতে গিয়ে আহত হন, তাহলে ফ্রান্সের নাগরিকত্ব পেতে তাঁদের অপেক্ষা করতে হয় না। বিদেশি ইউনিটে কোনো নারী সেনা নেই।

ইউক্রেনে প্রথম ধাপে ফ্রান্সের ১০০ সেনা গেছেন। ধাপে ধাপে ১ হাজার ৫০০ জন সেনা সেখানে পাঠানোর পরিকল্পনা করেছে ফ্রান্স।

এই সেনাদের সরাসরি ইউক্রেনে একেবারে তুমুল যুদ্ধ চলছে, এমন যুদ্ধক্ষেত্রে পাঠানো হয়েছে। দনবাস অঞ্চলে রাশিয়ার সেনাদের অগ্রযাত্রা ঠেকাতে ইউক্রেনীয়দের প্রতিরোধ যুদ্ধকে সহায়তা দেবেন এই সেনারা। প্রথম ১০০ জনের মধ্যে গোলাবারুদ ও নজরদারি বিশেষজ্ঞ রয়েছেন।

কয়েক মাস ধরে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাখোঁ ইউক্রেনে সেনা পাঠানোর জন্য হুমকি দিয়ে আসছিলেন। পোল্যান্ড ও বাল্টিক অঞ্চলের দেশগুলোর বাইরে ন্যাটোতে তিনি তাঁর এই প্রস্তাবের পক্ষে খুব সামান্য সমর্থন পেয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্রও ন্যাটো সেনাদের ইউক্রেনে পাঠানোর বিরোধিতা করে আসছে।

এখন ফ্রান্স ইউক্রেনে সেনা পাঠানোয় দুটি প্রশ্ন সামনে চলে এসেছে। এক. ইউক্রেন যুদ্ধে ন্যাটোর সম্পৃক্ততা নিয়ে রাশিয়ার দিক থেকে যেটাকে সতর্করেখা বলা হচ্ছে, তা অতিক্রম করা হলো কি? দুই. রাশিয়া কি এটাকে ইউক্রেনের সীমান্তের বাইরে বৃহত্তর যুদ্ধ হিসেবে দেখবে কি না?

ইউক্রেনের যুদ্ধক্ষেত্রে অনেক সেনা পাঠানোর সক্ষমতা নেই ফ্রান্সের। ফ্রান্স সরকারের ইচ্ছা থাকলেও বাস্তবে বড় আকারের সেনা পাঠানোর ভিত্তিও নেই। খবরে প্রকাশ যে বিদেশি সেনাদের নিয়ে গঠিত পুরো ডিভিশনকে পাঠাতে চায় না ফ্রান্স। ২০২৭ সালের আগে তাদের সেই সামর্থ্যও তৈরি হবে না।

বিদেশিদের নিয়ে গঠিত সেনা ইউনিটকে পাঠানোর সিদ্ধান্তটাই ফ্রান্সের জন্য অদ্ভুত রকম আপস। ফ্রান্স তাদের নিজ দেশের সেনাদের ইউক্রেনে নিয়োগ করছে না। হাতে গোনা কয়েকজন কর্মকর্তা বাদে কেউই ফ্রান্সের নাগরিক নন।

এখানে মূল প্রশ্নটি হলো, ইউক্রেনে ফ্রান্সের সেনা মোতায়েনের এই সিদ্ধান্তকে কীভাবে দেখছে ন্যাটো। এখানে একটা ব্যাপার পরিষ্কার হওয়া দরকার যে ন্যাটোর পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়াই ফ্রান্স ইউক্রেনে সেনা পাঠালেও ন্যাটোর সেই বিখ্যাত আর্টিকেল-৫-কে উপেক্ষা করতে পারে না। আর্টিকেল-৫ অনুসারে, কোনো সদস্যরাষ্ট্র আক্রান্ত হলে সম্মিলিতভাবে অন্যরা প্রতিরোধ গড়ে তুলবে।

ফ্রান্সের এই সিদ্ধান্তের দুটি অর্থ আছে। প্রথমত, মাখোঁ তাঁর দেশের ভেতরে বড় ধরনের বিরোধিতার মুখোমুখি না হয়েই সেনা পাঠাতে পেরেছেন। এটা তাঁকে কঠোর একজন নেতার ভাবমূর্তি তৈরি করতে সাহায্য করছে। এর কারণ হলো, ফরাসি কোনো সেনাকে ইউক্রেনে পাঠানো হচ্ছে না। আর সেনা পাঠানোর জন্য বাধ্যতামূলক নিয়োগের মতো কোনো অজনপ্রিয় কার্যক্রমও নেওয়া হচ্ছে না। ফলে মাখোঁ তাঁর বিরোধীদের ক্ষোভের হাত থেকে বেঁচে গেছেন।

দ্বিতীয়ত, মাসের এখানে একটা ক্ষোভও কাজ করেছে। আফ্রিকার সাহেল অঞ্চল থেকে সম্প্রতি ফরাসি সেনাদের চলে আসতে হয়েছে। সেই শূন্যস্থান পূরণ করে নিয়েছেন রাশিয়ান সেনারা। আফ্রিকার ফরাসিভাষী দেশগুলোর ওপর ফ্রান্সের যে নিয়ন্ত্রণ ও সেখান থেকে আসা সম্পদের যে প্রবাহ, সেটা বিপ্লব ও বিদ্রোহের কারণে ভেঙে পড়েছে। সরাসরি হোক আর ভাড়াটে বাহিনী ভাগনার গ্রুপের মাধ্যমেই হোক, এ ক্ষেত্রে রাশিয়ারও একটা সিদ্ধান্তমূলক ভূমিকা আছে। আর এখন এটা প্রমাণিত যে এসব বিদ্রোহ ও বিপ্লবের পেছনে ভ্লাদিমির পুতিনের সরাসরি নিয়ন্ত্রণ রয়েছে।

এই অপমানের আঁচ এলিসি প্রাসাদে (ফ্রান্সের প্রেসিডেন্টের সরকারি বাসভবন) গিয়েও লেগেছে। বিরোধীরা বলছেন, এতে করে ফ্রান্সের প্রভাব খর্ব হয়েছে এবং বিদেশে খনিশিল্প ও অন্যান্য ব্যবসায় ফ্রান্সের স্বার্থ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

সবচেয়ে বড় আঘাতটি এসেছে নাইজার থেকে। সেখান থেকে ফ্রান্সে ইউরেনিয়ামের বড় চালান আসত। ফ্রান্স পারমাণবিক শক্তি থেকে ৭০ শতাংশ বিদ্যুৎ উৎপাদন করে। বৈশ্বিক ইউরেনিয়াম সরবরাহে সংকট দেখা দিচ্ছে, এর দাম চড়ছে। রাশিয়া, কাজাখস্তানের পর নাইজার ইউরেনিয়ামের সবচেয়ে বড় উৎস। এ পরিস্থিতিতে অর্থনৈতিকভাবে নিরাপত্তাহীনতায় পড়েছে ফ্রান্স।

সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্র রাশিয়া থেকে ইউরেনিয়াম আমদানির ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। এই সিদ্ধান্তের পাল্টা হিসেবে রাশিয়াও তাদের ইউরেনিয়াম রপ্তানির ওপর নিষেধাজ্ঞা দিতে পারে।

এটা এখন পর্যন্ত পরিষ্কার নয়, এই বিদেশি সেনারা কীভাবে ইউক্রেনীয়দের সহযোগিতা করতে পারবেন। ইউক্রেনীয়রা ভালো করেই জানেন কীভাবে অস্ত্র-গোলাবারুদ পরিচালনা করতে হয়। খুব অত্যাধুনিক গোয়েন্দা সমর্থনও তাদের আছে। যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটোর অন্য অনেক দেশ থেকে ইউক্রেন গোয়েন্দা ও নজরদারির যথেষ্ট সরঞ্জাম পেয়েছে।

যাহোক, কীভাবে অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদ ব্যবহার করতে হয়, সেটা ইউক্রেনীয়দের ক্ষেত্রে সমস্যা নয়। তারা অব্যাহতভাবে বলে আসছে, অস্ত্র ও গোলাবারুদের ব্যাপক ঘাটতিতে রয়েছে তারা।

রাশিয়ার দনবাসে ফরাসি সেনা পাঠানোর ঘটনাটি মারাত্মক ধরনের প্ররোচণামূলক পদক্ষেপ। এই অঞ্চলটি যুদ্ধের একেবারে সম্মুখভাগে অবস্থিত। ফলে ফ্রান্স এই সেনা মোতায়েনকে মামুলি ঘটনা হিসেবে দেখাতে চাইলেও বাস্তবে রাশিয়ার সঙ্গে তাদের বিদেশি সেনা ইউনিটের সদস্যদের সরাসরি লড়াই বেধে যেতে পারে।

এখানে মূল প্রশ্নটি হলো, ইউক্রেনে ফ্রান্সের সেনা মোতায়েনের এই সিদ্ধান্তকে কীভাবে দেখছে ন্যাটো। এখানে একটা ব্যাপার পরিষ্কার হওয়া দরকার যে ন্যাটোর পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়াই ফ্রান্স ইউক্রেনে সেনা পাঠালেও ন্যাটোর সেই বিখ্যাত আর্টিকেল-৫-কে উপেক্ষা করতে পারে না। আর্টিকেল-৫ অনুসারে, কোনো সদস্যরাষ্ট্র আক্রান্ত হলে সম্মিলিতভাবে অন্যরা প্রতিরোধ গড়ে তুলবে।

ফ্রান্স যেহেতু যুদ্ধক্ষেত্রে সেনা পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে, সে ক্ষেত্রে রাশিয়া কি ইউক্রেনের বাইরে অন্য কোনো দেশে সেই সেনাদের ওপর হামলা চালাবে? আবার তাতে কি ন্যাটোর সদস্যদেশগুলো জোটটির আর্টিকেল-৫ অনুযায়ী রাশিয়ার বিরুদ্ধে সম্মিলিত পদক্ষেপ নেবে? সেটা অবশ্য কঠিন কিন্তু অসম্ভব নয়।

বর্তমানে যে পরিস্থিতি, তাতে ঘটনা কোন দিকে মোড় নিতে পারে, তার কোনো ঠিকঠিকানা নেই। কিন্তু ইউক্রেনে ফ্রান্স সেনা পাঠাক, সেটা রাশিয়া খুব বেশি দিন সহ্য করবে না। আবার রাশিয়া পাল্টা কী ব্যবস্থা নেয় সেটাও কারও জানা নেই।

(বিশেষ দ্রষ্টব্য: স্টিফেন ব্রায়েনের এই লেখাটি প্রকাশিত হওয়ার পর ফ্রান্সের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বরাতে বার্তা সংস্থা এপি ইউক্রেনে সেনা পাঠানোর খবরের সত্যতা নাকচ করে দেয়। এটিকে তারা ‘অপতথ্য’ দাবি করে। তবে সেনা পাঠানোর খবরকে কেন্দ্র করে ইউক্রেন সংঘাতে উত্তেজনা নতুন মাত্রা পেয়েছে। ইউক্রেনের কাছে পারমাণবিক অস্ত্রের মহড়া চালাতে সামরিক বাহিনীকে নির্দেশ দিয়েছেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন।)

  • স্টিফেন ব্রায়েন, যুক্তরাষ্ট্রের সিনেটে পররাষ্ট্র সম্পর্ক কমিটির একজন পরিচালক হিসেবে কাজ করেছেন
    এশিয়া টাইমস থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষিপ্তাকারে অনূদিত