মতামত

শাহিইইন…ভাইরাল দুনিয়া কেন ভরসা হয়ে ওঠে

চশমা-টুপি পরা লোকটির মুখে ‘নটীর পোলা’ শব্দযুগলই কেবল নয়, ডাকাত ধরার অভিনয় করতে গিয়ে তিনি যে শারীরিক অঙ্গভঙ্গি করেন, পাশে থাকা দুজন বয়স্ক লোককে চেপে ধরেন, তা অনেকের জন্য হাসির উদ্রেক করে।
কার্টুন: আরাফাত করিম


‘শাহিইইইইন…নটীর পোলাকে ধরে ফ্যাল!’ সিলেটের আঞ্চলিক টানে মধ্যবয়স্ক এক লোকের ২৭ সেকেন্ডের ভিডিও ফেসবুক দুনিয়ায় এখন ভাইরাল। একটু পুরোনো দিনের বাংলা সিনেমায় অভিজাত লোকদের ঘরোয়া পোশাকের মতো একটি পোশাক পরিধান করা এই ভদ্রলোক কী রকম অসীম সাহসে ডাকাত দলকে ধরে ফেলেছিলেন, সেই অভিনয়টা করে দেখান ক্যামেরার সামনে।

ঘটনাটি ঘটে বেশ কিছুদিন আগে। তখন অল্পকিছু লোক ভিডিওটা দেখেন। চশমা-টুপি পরা লোকটির মুখে ‘নটীর পোলা’ শব্দযুগলই কেবল নয়, ডাকাত ধরার অভিনয় করতে গিয়ে তিনি যে শারীরিক অঙ্গভঙ্গি করেন, পাশে থাকা দুজন বয়স্ক লোককে চেপে ধরেন, তা অনেকের জন্য হাসির উদ্রেক করে।

কিন্তু ব্যাপারটি ‘ভাইরাল’ হয় অতি সম্প্রতি। অনেকে ভিডিওটি শেয়ার দিতে থাকেন, সঙ্গে জুড়ে দেন মজার মজার মন্তব্য। আর ‘ভাইরালের’ সূত্র মেনে এ নিয়ে তৈরি হতে থাকে অগণিত কার্টুন, কবিতা; নানা জায়গায় জুড়ে দিয়ে উৎপাদিত হতে থাকে হাস্যরস।

অবধারিতভাবেই এ গণ-উত্তেজনা দুই দিনেই থিতিয়ে যাবে, কিছুদিন পর আবার কোনো ভাইরাল কনটেন্ট নিয়ে তৈরি হবে উত্তেজনা। নাজিম হিকমত ‘জেলখানার চিঠি’তে বলেছিলেন, ‘বিংশ শতাব্দীতে মানুষের শোকের আয়ু বড়জোর এক বছর।’ আর একবিংশ শতাব্দীতে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের জমানায় ভাইরালের আয়ু বড়জোর এক সপ্তাহ। এর আগে আমরা ‘মালটাকে গাড়িতে তোল’, ‘আসকে আমার মন ভালো নেই’, ‘দামে কম মানে ভালো’ ইত্যাদি নিয়ে এ ধরনের গণমাতামাতি দেখতে পাই। সেগুলো মিইয়ে গেছে। ‘শাহিন’ও যাবে। আবার জন্ম হবে নতুন ভাইরালের।
কেন ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোতে কনটেন্ট ভাইরাল হয়? এর পেছনের কারণগুলো কী?

সত্যি বলতে, কারণগুলো আগেভাগে নির্ণয় করা বেশ কঠিন। কোন কনটেন্ট ভাইরাল হবে, আর কোনটা হবে না—এমন পূর্বাভাস দেওয়া প্রায় অসম্ভব। তবে নির্দিষ্ট কনটেন্টটি কেন ভাইরাল হলো, তার কিছু ব্যাখা দেওয়া যায়, আর সামাজিক, ঐতিহাসিক, মনোবৈজ্ঞানিক তত্ত্বের মাধ্যমে বলা যায়, একেকটি কনটেন্ট ভাইরাল হওয়ার কারণ কী কী হতে পারে।

তবে, সেসবে যাওয়ার আগে ‘নটীর পোলা’ শব্দযুগল ব্যবহার করার কৈফিয়ত দিয়ে নিই। বর্তমান প্রেক্ষাপটে শব্দযুগল ছাপার অযোগ্য গালিতে পরিণত হলেও শাব্দিকভাবে এর অর্থ নর্তকীর সন্তান। অর্থের এই পরিবর্তন কোনো কনটেন্টকে ভাইরাল হওয়ার ব্যাপারে মুখ্য ভূমিকা পালন করে। শুধু তা-ই না, কোনো কনটেন্ট ভাইরাল হলেও প্রচলিত অর্থ পরিবর্তন হয়ে যায়।

এই কনটেন্ট ছাপিয়ে হরেদরে ভাইরালের ব্যাপার কীভাবে ব্যাখ্যা করা যায়? ইশপের গল্প আমরা সবাই জানি। প্রাচীন গ্রিসে সংগৃহীত এসব গল্প সম্ভবত টিকে থাকা সবচেয়ে পুরোনো ভাইরাল কনটেন্ট। বিশেষজ্ঞরা বলেন, এসব গল্পের ভিত্তি আসলে প্রাচীন সুমেরীয় সভ্যতায়।

কনটেন্ট আর ভাইরালের ব্যাপারটা আধুনিক, সেটা চিন্তা না করে ইন্টারনেট–পূর্ব যুগের অবস্থায় চিন্তা করা যাক। নর্তকী কিংবা নটীরা সাধারণত উপমহাদেশের সমাজে খুব একটা সম্মানের সঙ্গে সমাদৃত হতেন না। তাঁদের চরিত্র নিয়ে সমাজে গুজব ছড়াত। এ কারণে দেখা যায়, একসময় নটী শব্দটা গালিতে পরিণত হয়। আর ‘পোলা’ যোগ করে গালি দেওয়া এ অঞ্চলের মানুষের অভ্যাস। মানুষের মুখে মুখে ছড়িয়ে শব্দগুলো ছাপার অযোগ্য গালি হয়ে যায়। নটীর পোলা শব্দযুগলের গালিতে পরিণত হওয়া  ইন্টারনেট আসার বহু আগে ভাইরাল কনটেন্ট ও এর প্রভাবের একটা উদাহরণ।

এ শব্দযুগল আরেকটা জিনিস দেখায়—শব্দচয়ন ও উপস্থাপন। সিলেটি ভদ্রলোক যদি বলতেন, ‘নর্তকীর পুত্রকে ধরে ফ্যাল’, তবে এ রকম ব্যঞ্জনা তৈরি হতো না। আর তাঁর এবং পাশের দুজনের শারীরিক উপস্থাপনাও আকর্ষণীয়। কেউ কেউ হয়তো বলবেন, ছাপার অযোগ্য শব্দ অবলীলায় বলে ফেলতে পারা এবং ওইভাবে শরীরের মুভমেন্ট একটা অনাকাঙ্ক্ষিত পরিবেশ তৈরি করাটাই এই কনটেন্টের ভাইরাল হওয়ার রহস্য।

তাত্ত্বিকেরা এ অবস্থাকে বলেন ইনকনগ্রিউটি। তামাশার ব্যাখ্যায় যত তত্ত্ব আছে, তাতে সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য হচ্ছে ইনকনগ্রিউটি থিওরি। তবে তত্ত্বটা বেশ খানিকটা জটিল ও বিস্তৃত। সহজ ভাষায় বললে, ইনকনগ্রিউটি মানে হচ্ছে, ‘স্বাভাবিক অবস্থা থেকে বিচ্যুতি’। যিনি তামাশা বা জোকসটা শুনছেন, তিনি একেবারেই আশা করছেন না বা খুবই হতভম্ব হচ্ছেন—এমন একটা অবস্থা তৈরি করতে পারলেই, সেটা ভালো জোকস হয়। শোপেনহাওয়ার ব্যাপারটাকে বলেন, ‘ক্রিয়েটিং কন্ট্রাডিকশন’।

আলাপ হচ্ছে এই কন্ট্রাডিকশন তৈরি করা। এর জন্য রসিকতায় নানা কৌশল কাজে লাগানো হয়, এর সবচেয়ে শক্তিশালীটা হচ্ছে জবরদস্ত পাঞ্চলাইন। শ্রোতাকে বেভুল বানিয়ে, সম্মোহন করে, শেষমেশ একটা এয়সা ধাক্কা!

আপনাদের জানা যত জোকস বা চুটকি আছে, সেগুলো পরীক্ষা করে দেখুন, সেসবের বেশির ভাগের বেলাতেই দেখবেন এই তত্ত্ব খাটে!

আমাদের আলোচ্য কনটেন্টের ইনকনগ্রিউটি হচ্ছে ভদ্রলোকের বয়স, পোশাকের সঙ্গে ভাষা ও অ্যাকশনের অসামঞ্জস্য।

কিন্তু এই কনটেন্ট ছাপিয়ে হরেদরে ভাইরালের ব্যাপার কীভাবে ব্যাখ্যা করা যায়? ইশপের গল্প আমরা সবাই জানি। প্রাচীন গ্রিসে সংগৃহীত এসব গল্প সম্ভবত টিকে থাকা সবচেয়ে পুরোনো ভাইরাল কনটেন্ট। বিশেষজ্ঞরা বলেন, এসব গল্পের ভিত্তি আসলে প্রাচীন সুমেরীয় সভ্যতায়। অর্থাৎ, মানুষ যখন প্রথম লিখতে শেখে, নগর বানাতে শেখে, তখন থেকেই সে তাঁর গল্পে ইনকনগ্রিউটি আনতে চায়। পশুদের, পাখিদের মাধ্যমে জরুরি বার্তা দিতে চায়। লক্ষণীয়, পশুপাখিদের দিয়ে কথা বলিয়ে নেওয়াটা কিন্তু ইনকনগ্রিউটির বড় উদাহরণ। এ পরিস্থিতি গল্পের বুননকে শক্ত করে, আকর্ষণীয় করে।

আধুনিক যুগেও এই ধারা বিদ্যমান। তবে এখনকার পরিস্থিতিতে এ অবস্থার কাঠামো কিছুটা পাল্টেছে। এখনকার দিনে মানুষ বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মতো হয়ে যাচ্ছে। নিওলিবারেল জমানায়, সামাজিক আড্ডা আর মেলামেশা ধসে যাচ্ছে, এমনকি সিনেমা হল বা পার্কে যাওয়ারও সুযোগ কমে গেছে। কিন্তু জীবন-জীবিকা হয়ে পড়ছে আরও কঠিন। ঢাকার রাস্তায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা বাসে ঝুলে অফিস করা কিংবা পোশাক কারখানায় দিনভর উদয়াস্ত পরিশ্রম করেও নিত্যপণ্যের বাজারে হিসাব মেলাতে না–পারা শ্রমিকের স্ট্রেস রিলিফ বা স্বস্তি দরকার।

এর উপায় হচ্ছে, কোনোভাবে নিজেকে তামাশার কাছে সঁপে দেওয়া। কার্ল মার্ক্স যে অ্যালিয়েনেশনের কথা বলতেন, সেই আশঙ্কা পুরোপুরি সত্য হয়েছে। কিন্তু মানুষ তো দিন শেষে সামষ্টিকভাবে বাঁচতে চায়, সেটাই তাঁর লাখো বছরের টিকে থাকার কৌশল। তাই সে শুধু তামাশার কাছে সঁপে দেয় নয়, সে চায় এই তামাশাকে সামষ্টিকভাবে উপভোগ করতে। অন্যভাবে বললে সে এই তামাশার মেলা থেকে নিজেকে বঞ্চিত করতে চায় না। তাত্ত্বিক ভাষায়, ফিয়ার অব মিসিং আউট।

এ কারণে যখন সে দেখে কোনো কনটেন্ট অন্যদের কাছে বিনোদনের উপায় হিসেবে হাজির, সে সেই আনন্দে গা ভাসাতে চায়, প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ উপস্থিতিতে। শুধু ফেসবুকের ভাইরাল কনটেন্ট নয়, ওয়েব সিরিজ, সিনেমা, বই, গান—এসব ব্যাপারেও একই আলাপ খাটে। বলা ভালো, বরাবরই খাটত।

এ কারণে অবধারিতভাবেই ভাইরাল কনটেন্টকে হতে হবে একই সঙ্গে সহজবোধ্য, আবার যথেষ্ট পরিমাণে হাস্য উদ্রেককারী। সহজবোধ্য না হলে তা গণমানুষের কাছে আদৃত হবে না। বারবার হাসির কথা বলা হচ্ছে, তবে কি বিষাদের গল্প ভাইরাল হয় না? অতি অবশ্যই হয়। তবে হাস্যরসের বেলায় শর্তগুলো পূরণ করা সোজা।

আর যাঁরা অনেক বেশি চাপে থাকেন, তাঁদের জন্য তামাশাই সেরা স্ট্রেস রিলিজ। যে কারণে দেখা যায়, হিটলারের জার্মানিতে জনপ্রিয় হয় হুইসপারিং জোকস, স্টালিনের সোভিয়েত ইউনিয়নে রাজনৈতিক কৌতুক। নিষিদ্ধ জিনিসের প্রতি আকর্ষণও বড় ব্যাপার। আমাদের নাগরিক জীবনে যেখানে প্রায় কোনো ধরনেরই অধিকার নেই, সেই দুঃসহ সময়ে কৌতুকই ভরসা।

ব্যাপারটা ওপর থেকে দেখলে হয়তো একটা ডার্ক কমেডি। নিওলিবারেল দুনিয়ার, তৃতীয় বিশ্বের এক অসহনীয় দেশে যে কোনোভাবে তামাশা করে টিকে থাকার এই প্রচেষ্টা হয়তো আদতে চেখভের গল্পের হাসির আড়ালে গভীর এক দুঃখের উপাখ্যান। আমাদের একাকিত্ব, অসহায়ত্ব, অক্ষমতাগুলোই হয়তো ভাইরাল হওয়ার গল্প। এই ভয়াল কষ্টগুলোকে শাহিন হয়তো কোনো দিনই ধরে ফেলতে পারবেন না।

  • সৈয়দ ফায়েজ আহমেদ প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ সহসম্পাদক