গুমের শিকার বালুচ পরিবারগুলোর লংমার্চে লাঠিপেটা করে ছত্রভঙ্গ করা হয়
গুমের শিকার বালুচ পরিবারগুলোর লংমার্চে লাঠিপেটা করে ছত্রভঙ্গ করা হয়

বেলুচিস্তানে শান্তির সুযোগ হাতছাড়া করছে পাকিস্তান

পাকিস্তানের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার-উল-হক ১ জানুয়ারি ইসলামাবাদে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়েছিলেন। বেলুচিস্তানের জনগণ বিচারবহির্ভূত হত্যা ও গুমের প্রতিবাদে ইসলামাবাদে বিক্ষোভ করার সময় পুলিশের সহিংস প্রতিক্রিয়া নিয়ে তাঁকে প্রশ্ন করতেই তিনি মেজাজ হারালেন।

প্রধানমন্ত্রী রাগত স্বরে বললেন, যাঁরা ইসলামাবাদে বিক্ষোভ করেছেন, তাঁরা ‘রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নামা লোকজনের আত্মীয়স্বজন।’ বেলুচিস্তান থেকে আসা বিক্ষোভকারীদের প্রতিবাদকে অন্যায্য এবং পুলিশের লাঠিপেটা ও জলকামান ব্যবহারকে ঠিক কাজ বলে তিনি দাবি করেন। তিনি বলেন, যাঁরা তাঁদের সমর্থন করছেন, তাঁরা ‘বেলুচিস্তানের সন্ত্রাসীদের দোসর’।

বেলুচিস্তানের বংশোদ্ভূত পশতুন আনোয়ার-উল-হকের বেলুচিস্তান ইস্যুতে যেভাবে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন, তা বালুচ জনগণের বিষয়ে পাকিস্তান সরকারের অনুসৃত নীতিকে প্রতিফলিত করে। কয়েক দশক ধরে পাকিস্তানের সামরিক ও বেসামরিক সরকারগুলো বেলুচিস্তানের মানুষের দুর্দশা ও দাবির দিকে নজর দেওয়ার বদলে বালুচ ইস্যুকে শুধু একটি নিরাপত্তা ইস্যু বানিয়ে রেখেছে।

সরকারের এই মনোভঙ্গি বালুচ জনগণের মানবিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্যকে পরিকল্পিতভাবে জিইয়ে রেখেছে। এটি প্রদেশটিতে দীর্ঘমেয়াদি সংঘাতকে উসকে দিয়েছে। এ অবস্থায় যতক্ষণ না পাকিস্তান সরকার তার মনোভাব পরিবর্তন করবে, ততক্ষণ বেলুচিস্তান সংকটের অবসান ঘটবে না।

পাকিস্তানের সবচেয়ে বড় প্রদেশ হলো বেলুচিস্তান। দেশটির মোট আয়তনের ৪৩ দশমিক ৬ শতাংশ এলাকাই এই প্রদেশের দখলে। সোনা, তামা, তেলসহ সবচেয়ে বেশি খনিজ সম্পদ এখানে। এই প্রদেশেই ৭৭০ কিলোমিটার দীর্ঘ উপকূল। এখানেই চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডরের কৌশলগত গুরুত্বপূর্ণ স্থল গাদর বন্দর অবস্থিত।

প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ থাকার পরও বেলুচিস্তান পাকিস্তানের সবচেয়ে দরিদ্র প্রদেশ। বালুচ উপজাতির লোকের সংখ্যা পাকিস্তানের মোট জনগণের এক-তৃতীয়াংশ। অথচ পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার দশকের পর দশক ধরে তাদের বিষয়ে বৈষম্যমূলক নীতি অনুসরণ করে যাচ্ছে। এই বৈষম্য সশস্ত্র প্রতিরোধ আন্দোলনের জন্ম দিয়েছে।

বেলুচিস্তানের সম্পদের সমান হিস্যা দাবি করে আসছেন বালুচ সংগ্রামীরা। এর ধারাবাহিকতায় সেখানে স্বাধীনতার দাবি পর্যন্ত উঠেছে। তবে বালুচদের সবাই যে সশস্ত্র আন্দোলনকে সমর্থন করছেন, তা নয়। সেখানকার অনেকেই বিশ্বাস করেন, সরকার যদি বালুচ জনগণের দুঃখ–বঞ্চনার কথা বিবেচনায় নিয়ে আলোচনায় বসে, তাহলে এই দীর্ঘমেয়াদি সংকটের সমাধান সম্ভব।

কিন্তু সরকার বরাবরই এসব সমস্যা সমাধানে আলোচনার পথে না গিয়ে বলপ্রয়োগের দিকে ঝুঁকেছে। সরকার শুধু সশস্ত্র গ্রুপগুলোকেই দমন করছে না; বরং গোটা বালুচ সম্প্রদায়কে তারা সন্ত্রাসী হিসেবে দাগিয়ে দিচ্ছে। এমনকি যে আন্দোলনকর্মী ও রাজনীতিকেরা অস্ত্র তুলে না নিয়ে রাজনীতি ও আইনি পথে আন্দোলন করে আসছেন, তাঁদেরও ‘সন্ত্রাসী’ আখ্যা দেওয়া হচ্ছে। ফলে বালুচ সমাজে শান্তি ও স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনার সব সুযোগ সরকারের হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে।

তবে বেলুচিস্তান ইস্যুকে পাকিস্তান সরকার শুধু নিরাপত্তাজনিত দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে দেখার কারণে সেখানে মানবাধিকার লঙ্ঘনজনিত সংকট বেড়ে গেছে। জোর করে তুলে নিয়ে যাওয়া, গুম হওয়া, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বেড়ে যাওয়ার ঘটনা বাড়তে থাকায় সেখানে সাধারণ বালুচ জনগণের মধ্যে উত্তেজনা তৈরি হচ্ছে। সরকারবিরোধী আন্দোলন বাড়ছে। সেই সঙ্গে নিরাপত্তা বাহিনীর দমন–পীড়ন বেড়ে গেছে।

ভয়েস ফর বালুচ মিসিং পারসনস নামের একটি সংগঠনের হিসাব অনুযায়ী, সেখানে জোর করে তুলে নিয়ে যাওয়া লোকের সংখ্যা পাঁচ হাজার ছাড়িয়ে গেছে। সেখানে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনায় দেশি–বিদেশি অনেক মানবাধিকার সংস্থা উদ্বেগ প্রকাশ করেছে।

প্রদেশটিতে বিচারবহির্ভূত হত্যার ঘটনা যেন রুটিন পর্যায়ে চলে গেছে। এ অবস্থার অবসানে সম্প্রতি খুন হওয়া ব্যক্তিদের পরিবারের সদস্যরা বিক্ষোভের আয়োজন করেন এবং স্থানীয় লোকজন তাতে যোগ দেন। তাঁরা তুরবত থেকে ইসলামাবাদ পর্যন্ত লংমার্চ শুরু করেন।

কিন্তু সরকার তাঁদের দাবির দিকে কর্ণপাত করেনি। তার বদলে তাঁদের ছত্রভঙ্গ করতে পুলিশ লাঠিপেটা করে এবং জলকামান ব্যবহার করে। সরকারের এই কৌশল ভুল। এটি বালুচ সম্প্রদায়ের মধ্যে অনাস্থা বাড়াবে। কিন্তু পাকিস্তানের জাতীয় স্বার্থে বেলুচিস্তানে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠা করা দরকার। এর জন্য সরকারকে মারমুখী মনোভাব থেকে সরে এসে সংলাপের মনোভাবে আসতে হবে।

নাজির আহমেদ মির নয়াদিল্লিভিত্তিক গবেষক 

মুনীব ইউসুফ ভারতের জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়া ইউনিভার্সিটির ডক্টরাল ক্যান্ডিডেট

আল–জাজিরা থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষিপ্ত আকারে অনূদিত