শাহদীন মালিকের কলাম

দেশে সততা, জবাবদিহি, দক্ষতা সবই প্রায় বিলুপ্ত

বিলুপ্ত বা প্রায় বিলুপ্তির তালিকায় আরও অনেক কিছু যোগ করা যায়। তালিকা দীর্ঘায়িত করতে সহজে যোগ করা যায় বাক্‌স্বাধীনতা, সুষ্ঠু নির্বাচন, মেধা, নৈতিকতাসহ আরও অনেক কিছু। আর যেসব ফুলেফেঁপে প্রতিনিয়ত তরতাজা হয়, এমন দৃষ্টান্তের মধ্যে এ মুহূর্তে সর্বাগ্রে আছেন সেনাবাহিনী ও পুলিশ বাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত দুই প্রধান।

এত দিন সিন্ডিকেট সিন্ডিকেট করে আমরা সবাই চিৎকার করছিলাম। ব্যতিব্যস্ত ছিলাম আলু, পেঁয়াজ আর ডিমের সিন্ডিকেট নিয়ে। মাঝেমধ্যে কখনো ঊর্ধ্বশ্বাসে, কখনোবা রয়েসয়ে সিন্ডিকেটের ভাব ধরে কখনো চাল, কখনো কাঁচা মরিচ আর তার সঙ্গে সয়াবিন তেল, চিনি ও মুরগিও আছে। খাসি আর গরুর মাংস দুষ্প্রাপ্যতার জন্য তালিকা থেকে বাদ।

যতই শোরগোল হোক না কেন, এত দিন সিন্ডিকেটওয়ালাদের খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। তারা নাকি ধরাছোঁয়ার বাইরে। সিন্ডিকেটের খাঁটি দুধে দুই ফোঁটা চনা দিয়েছে ৩০ মের প্রথম আলো। শিরোনাম ছিল—‘চক্রে’ ঢুকে চার সংসদ সদস্যের ব্যবসা রমরমা।

পত্রিকাটির খবর অনুযায়ী এই চার সংসদ সদস্যের রিক্রুটিং এজেন্সিগুলো সাত থেকে আট হাজার অভিবাসী পাঠিয়েছে মালয়েশিয়ায়। নিয়ম অনুযায়ী জনপ্রতি অভিবাসন খরচ ৮০ হাজার টাকার নিচে। সুখবর হলো, এই রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোর সিন্ডিকেটের ঠেলায় প্রত্যেক মালয়েশিয়াগামী অভিবাসীর খরচ হয়েছে পাঁচ লাখ টাকার বেশি!

সিন্ডিকেটের কারণে ডিমের দাম যখন ১৩০ টাকা ডজন থেকে ১৫০ টাকায় গিয়ে ঠেকে, তখন আমরা সবাই রিপোর্ট আর কলাম লিখে, টেলিভিশনে টকাটকিতে ধুন্ধুমার লাগিয়ে দিই।

অভিবাসী প্রেরণে নির্ধারিত দামের চেয়ে ৭-৮ গুণ খরচ বাড়ানোর মতো ডিম বিক্রেতা যদি ১২০ টাকা ডজনের ডিম ৮৫০ থেকে ৯০০ টাকায় বিক্রি করতে চান, তখন হয়তো এক-দুটি ডিম কিনে সযত্নে খাবার টেবিলে সাজিয়ে রেখে নাশতার সময় ডিমটি চেয়ে চেয়ে দেখব আর শুকনা রুটি খাব।

মালয়েশিয়া অভিবাসী সিন্ডিকেটের খোঁজ তো পাওয়া গেল। বেনজীর আহমেদের ঢেল-অঢেল সম্পত্তির খোঁজ প্রথমে দিয়েছিল অন্য একটি পত্রিকা, তোলপাড় শুরু হয়ে গেছে এবং আশা করছি, এই শোরগোল শাস্তি পর্যন্ত গড়াবে। অভিবাসী সিন্ডিকেটের হর্তাকর্তারা অবসরে যাননি। তাঁরা সগর্বে আমাদের মহান সংসদে তাঁদের নিজ নিজ আসনে বসবেন এই সপ্তাহের শেষে শুরু হতে যাওয়া বাজেট অধিবেশনে। তাঁদের আশু অবসরে যাওয়ার সম্ভাবনা অতি অল্প।

আগামী নির্বাচনে আনোয়ারুল আজীমের মতো ব্যাপক জনপ্রিয়তার কারণে এই সিন্ডিকেটের সংসদ সদস্যরা নির্বাচনে আবারও দলীয় মনোনয়ন পেতেই পারেন। তাঁদের উত্তরোত্তর সমৃদ্ধি হোক, সেই শুভকামনা রইল। আর আমরা সবাই বসে বসে আমাদের নিজ নিজ বুড়ো আঙুল ‘চুষতে’ থাকব।

আমাদের প্রথমে গেছে গণতন্ত্র আর গণতন্ত্র চলে গেলে, অর্থাৎ গণতন্ত্র ভূত হয়ে গেলে তার পিছু পিছু হাটে জবাবদিহি, দুর্নীতি, অত্যন্ত সীমিত বাক্‌স্বাধীনতা ও প্রতিষ্ঠানগুলো দুর্বল হয়ে যাওয়া। সমাজ ও রাষ্ট্রের টুঁটি চেপে ধরে যতই ‘জিরো টলারেন্স’ বলে তারস্বরে বক্তৃতা-বিবৃতি দেন না কেন, লুটেরা তাতে কর্ণপাত করবে না।

২.

বিলুপ্তপ্রায় বিষয়াদি নিয়ে অল্প কিছু কথা। আমার এক পরিচিত তরুণ বিশ্ববিদ্যালয় পাস করে এদিক-সেদিক কিছুদিন ঘোরাঘুরি করে অবশেষে দেশে প্রত্যাবর্তন, অর্থাৎ পৈতৃক গ্রামে বসবাস শুরু করল।

ঢাকার পাশের একটা গ্রামের বাজারে তাদের একটা দোতলা মার্কেট ছিল। যত দূর বুঝেছি, দোতলার দোকানগুলো অল্পই ভাড়া হতো। তরুণটি নিজ উৎসাহে সেই দোতলায় একটি কিন্ডারগার্টেন স্কুল চালু করে। বছরের গোড়ার দিকে টেলিফোনে যা বলেছিল, তার সারমর্ম হলো এই যে ২০-২৫টি কিন্ডারগার্টেন নিয়ে তাদের যে অ্যাসোসিয়েশন, তার মিটিংয়ে প্রতি কিন্ডারগার্টেনকে অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতির কাছে এক হাজার টাকা দিতে হবে এবং এই টাকা স্থানীয় শিক্ষা দপ্তরে পৌঁছে দিতে হবে, যাতে কিন্ডারগার্টেনের ছেলেমেয়েরা বিনা পয়সায় সরকারি বই পায়।

তরুণটির সঙ্গে আবার ইদানীং কথা হচ্ছিল, আমাকে জানাল, অর্ধবার্ষিক পরীক্ষার প্রশ্ন তৈরি করছে। বোকার মতো তীক্ষ্ণ প্রশ্নবাণ ছুড়ে মারলাম—প্রশ্নপত্র তৈরি করবে সংশ্লিষ্ট শিক্ষক-শিক্ষিকারা, আপনি কেন? এর উত্তরে বলল, স্যার শিক্ষক-শিক্ষিকাদের প্রশ্ন করতে দিলে তারা প্রশ্নপত্র ফাঁস করে দেয়। জানতে চাইলাম, ক্লাস টু-থ্রির শিশুদের কাছে? নির্লিপ্ত উত্তর, জি স্যার।

আরেকটি কেচ্ছা—আমার ছোটবেলার বন্ধু বড় ডাক্তার হয়েছিল। প্রথমে সরকারি হাসপাতালে, পরে সরকারি চাকরি থেকে অবসর নিয়ে বেসরকারি হাসপাতালে বড় ডাক্তার। কিছুদিন আগে সব ডাক্তারি থেকে অবসর নিয়েছে। যে বেসরকারি হাসপাতালে চাকরি করত, সেই হাসপাতালে গিয়েছিল ছোট একটা কাজে। হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে ফুটপাতে হোঁচট খেয়ে ধড়াম করে পড়ে গেল। পা কেটে গিয়েছিল, রক্ত ঝরছিল। তার বেশ লম্বা সাদা দাড়ি। আমি খবর পাইনি।

মাস দুয়েক পরে দেখা হলে ঘটনাটার বিবরণ দিতে গিয়ে বলে, ‘শাহদীন, একটা লোকও এগিয়ে আসল না। ভাগ্যিস নিজের হাসপাতালের সামনে পড়ে গিয়েছিলাম। তাই হাসপাতালের গার্ড ধরাধরি করে হাসপাতালের ভেতরে নিয়ে গিয়ে চিকিৎসার ব্যবস্থা করে।’

২৯ মে ২০২৪ প্রথম আলোর একটা খবরের শিরোনাম ছিল আগামী অর্থবছরে ‘ঋণের সুদই দিতে হবে সোয়া লাখ কোটি টাকা’। গুণ ও ভাগ করে যা পেলাম, তাতে বুঝলাম, দেশি ও বিদেশি ঋণের সুদ বাবদ আমাদের পরিশোধ করতে হবে প্রতিদিন কমবেশি সাড়ে তিন শ কোটি টাকা। জনপ্রতি প্রতিদিন কমবেশি ২০ টাকা। যে শিশু আজকে জন্মেছে বা যার বয়স এক মাস বা দুই অথবা পাঁচ বছর, তাকেও এই সুদের ঘানি টানতে হবে প্রতিদিন। আমাদের প্রতিটি শিশুই ঋণগ্রস্ত হয়ে জন্মগ্রহণ করছে।

৩.

অনেকে প্রায়ই বলেন, আমাদের নীতিনৈতিকতা চলে গেছে, গায়েব হয়ে গেছে। এই চলে যাওয়া বা গায়েব হওয়া কী করে হলো? যাঁরা দেশের এত উন্নতি করছেন, তাঁদের এই প্রশ্নের জবাব পছন্দ হবে না। জবাব স্পষ্ট এবং একান্তই সর্বাগ্রে গায়েব হয়েছে গণতন্ত্র। যা আছে তা হলো গণতন্ত্রের ভূত। ভূতকে আমরা খারাপ কাজ বা বিভিন্ন ধরনের অপকর্ম বা দোষের তকমা পরাই।

আমাদের প্রথমে গেছে গণতন্ত্র আর গণতন্ত্র চলে গেলে, অর্থাৎ গণতন্ত্র ভূত হয়ে গেলে তার পিছু পিছু হাটে জবাবদিহি, দুর্নীতি, অত্যন্ত সীমিত বাক্‌স্বাধীনতা ও প্রতিষ্ঠানগুলো দুর্বল হয়ে যাওয়া। সমাজ ও রাষ্ট্রের টুঁটি চেপে ধরে যতই ‘জিরো টলারেন্স’ বলে তারস্বরে বক্তৃতা-বিবৃতি দেন না কেন, লুটেরা তাতে কর্ণপাত করবে না।

গণতন্ত্র শিগগিরই ফিরে আসার সম্ভাবনা ক্ষীণ। বিদ্যমান ব্যবস্থায় ক্রমান্বয়ে সমাজে অপরাধীদের দাপট বাড়বে। ২৯ মে দক্ষিণ আফ্রিকায় সংসদ নির্বাচন হয়ে গেল। নেলসন ম্যান্ডেলার আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেস দল ১৯৯৪ থেকে আজতক, অর্থাৎ টানা ৩০ বছর বারবার নির্বাচনে জিতে ক্ষমতায় বহাল আছে। দক্ষিণ আফ্রিকার বর্তমান জনসংখ্যা কমবেশি ৬ কোটি। মোটাদাগে আমাদের ৩ ভাগের ১ ভাগ। গত বছর দেশটিতে মার্ডার হয়েছিল প্রায় ২৫ হাজার লোক। তরুণ-তরুণীদের মধ্যে বেকারত্বের হার ৪০ শতাংশ। অবশ্য তাদের নেতাদের দুর্নীতির কাছে আমরা চুনোপুঁটি।

তবে গত কয়েক দিনের খবরাখবর থেকে ক্রমেই স্পষ্ট হয়ে উঠছে যে অনেক সরকারি কর্মচারী, অনেক রাজনৈতিক নেতা, অনেক ব্যবসায়ী এতটাই ফুলেফেঁপে উঠেছেন যে তাঁদের দাপট থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য মানুষ এখন ইরান-তুরান-লিবিয়া-ভূমধ্যসাগর হয়ে ১৮-২০ লাখ টাকা খরচ করে হলেও এই দেশ থেকে পালাতে চায়। লোক পালানোর হার বাড়বে এবং অপরাধ আরও ভয়াবহ হবে তত দিন, যত দিন সত্যিকার গণতন্ত্র ভূতের মতো ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকবে।

● ড. শাহদীন মালিক সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী এবং ইউনিভার্সিটি অব এশিয়া প্যাসিফিকের আইনের শিক্ষক