সরকারের ভুল পরিকল্পনা এবং সদিচ্ছার অভাবে খোলা আছে দেশ থেকে ডলার পাচার বা চলে যাওয়ার নতুন ও পুরোনো প্রক্রিয়া। উন্নয়ন প্রকল্প যথাসময়ে বাস্তবায়নে বিশেষ উদ্যোগ নেই বলে ডলার ক্ষয় হচ্ছে। একনেকে নিয়মিত বিরতিতে প্রকল্পের মেয়াদ এবং ব্যয় বাড়ানোটা রেওয়াজে পরিণত হয়েছে, প্রতি বছরে ১০-১৫ শতাংশ ব্যয় বাড়ানো যেন রীতি হয়ে গেছে।
গুরুত্বপূর্ণ কোনো উদ্যোগ নেই বড় বড় খাতে ডলার সাশ্রয়ের, যেমন রিফাইনারি তৈরি, সার উৎপাদন ক্ষমতা বৃদ্ধির, সার ও অ্যামোনিয়া উৎপাদনে পর্যাপ্ত গ্যাস সরবরাহের কিংবা বেসিক কেমিক্যাল স্থানীয়ভাবে উৎপাদনের। সব নজর কিছু দৃশ্যমান প্রকল্পে।
সরকার ১০ ডলারের গ্যাস বাঁচাতে গিয়ে ২০ ডলার গচ্চা দেয় সার আমদানিতে। এ রকম অসাড় ও জড় উন্নয়ন চিন্তা দিয়ে চলছে আমাদের উন্নয়ন কারিগরেরা, অবশ্য এতে আমদানি বাণিজ্য ও কমিশন ব্যবসা বেশ রমরমা ভাবেই চলে।
সার আমদানিতে পাচার অভিযোগও উঠছে, আন্তর্জাতিক বাজারে ২০২১-২২ অর্থবছরে সারের দাম বেড়েছে ১ দশমিক ৮৫ থেকে সর্বোচ্চ ২ গুণ। কিন্তু তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যাচ্ছে, এ সময়ে সার আমদানিতে সরকারের খরচ বেড়েছে প্রায় ৫ থেকে কোনো কোনো মাসে ৬ গুণের কাছাকাছি।
চট্টগ্রাম বন্দর সূত্র বলছে আমদানির পরিমাণ বাড়েনি, অর্থাৎ এখানে ডলার পাচার হতে পারে। গত দুই বছরে প্রায় ১ হাজার ২০০ কোটি টাকার ১ লাখ ৩৮ হাজার ৬৭৫ টন আমদানি করা সরকারি সার পরিবহনকালে গায়েবে দুদকের অভিযোগ রয়েছে দুটি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে। (৭ সেপ্টেম্বর ২০২৩, আজকের পত্রিকা)
অভিযোগ আছে স্থানীয় সার আমদানিতেও। বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশন (বিসিআইসি) আমদানি করা সারের প্রতি টন সারের দাম পড়েছে ২৬৮ দশমিক ৩৩ ডলার। একই সময়ে সরকারের দেওয়া গ্যাসে উৎপাদন সচল রাখা কাফকো থেকে প্রতি টন সার কেনা হচ্ছে ৩৬০ ডলার মূল্যে, টনপ্রতি ৯২ ডলার বেশি দাম নিচ্ছে কাফকো। (আজকের পত্রিকা, ১১ অক্টোবর ২০২৩)
করোনা মহামারির আগে থেকেই দেশে গ্যাস-সংকট চলছে। অভ্যন্তরীণ উৎপাদন কমায় এবং বড় আমদানি চুক্তি না থাকায় সার কারখানাগুলোয় গ্যাস দিতে পারছে না সরকার। এ কারণে বাধ্য হয়ে একে একে উৎপাদন বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে চিটাগাং ইউরিয়া ফার্টিলাইজার লিমিটেড (সিইউএফএল), আশুগঞ্জ ফার্টিলাইজার অ্যান্ড কেমিক্যাল কোম্পানি লিমিটেড (এএফসিসিএল) এবং যমুনা ফার্টিলাইজার কোম্পানি লিমিটেড (জেএফসিএল)।
দীর্ঘদিন কারখানাগুলো বন্ধ থাকায় সেগুলোর মূল্যবান যন্ত্রাংশে মরিচা ধরেছে, এসব যন্ত্রাংশের কিছু কিছু মিলিয়ন ডলার মূল্যের। কারখানা বন্ধ থাকায় মরিচা ধরে কিছু কিছু যন্ত্রাংশ নষ্ট হওয়ার কথা স্বীকারও করেছেন বিসিআইসির চেয়ারম্যান (আজকের পত্রিকা, ১১ অক্টোবর ২০২৩)।
গ্যাস-সংকটের কারণে গত মার্চ থেকে সার উৎপাদন বন্ধ রয়েছে আশুগঞ্জ এএফসিসিএল। এই কারখানায় দিনে ১ হাজার ২০০ টন সার উৎপাদিত হতো, গ্যাস সরবরাহ ঠিক থাকলে এখানে ১৬-১৭ হাজার টাকা খরচে এক টন সার উৎপাদন করা যায়। দীর্ঘদিন কারখানা বন্ধ থাকায় অনেক যন্ত্রাংশ নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। একদিকে নষ্ট হচ্ছে খরুচে যন্ত্রাংশ এবং অন্যদিকে ভুল পরিকল্পনায় করা যাচ্ছে না ডলার সাশ্রয়।
গত বছরের ২১ নভেম্বর বয়লারে অগ্নিকাণ্ডের পর থেকে চিটাগাং ইউরিয়া ফার্টিলাইজার লিমিটেডে (সিইউএফএল) ইউরিয়া সার ও অ্যামোনিয়া উৎপাদন বন্ধ হয়ে যায়। কারিগরি সমস্যা এবং গ্যাস-সংকটের কারণে ১০ মাস ধরে কারখানাটি উৎপাদনে নেই। গ্যাস-সংকটের কারণে দীর্ঘদিন সচল কারখানা বন্ধ থাকায় অনেক গুরুত্বপূর্ণ যন্ত্রাংশ নষ্ট হয়ে যাচ্ছে এবং নতুন নতুন সমস্যা দেখা দেয়। মেরামতের পর সচল কারখানাও অচল হয়।
গত ৫ সেপ্টেম্বর থেকে যমুনা ফার্টিলাইজার কোম্পানি লিমিটেড (জেএফসিএল) বন্ধ হয়ে যায়। এর পেছনেও গ্যাস-সংকট দায়ী, আছে কারিগরি সমস্যাও। দেশীয় সার উৎপাদন কারখানার মধ্যে একমাত্র শাহজালাল সার কারখানা (এসএফসিএল) চালু আছে, যার বার্ষিক উৎপাদন ক্ষমতা পৌনে ৬ লাখ মেট্রিক টন।
দেশে মোট ২৭ লাখ টন ইউরিয়া সারের চাহিদা রয়েছে। অন্যান্য সার মিলে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জন্য ৬৮ লাখ ৪২ হাজার ৫০০ টন সারের চাহিদা নির্ধারণ করা হয়েছে, বিপরীতে মোট উৎপাদনের সক্ষমতা ২৩ লাখ টন। গ্যাস সরবরাহ স্বাভাবিক থাকলে ১০ লাখ টন দেশীয় কারখানাগুলো থেকে জোগান দেওয়া হতো, বর্তমানে সেটাও হচ্ছে না। অথচ আমদানিতে ডলার যাচ্ছে।
১৪ বছরে বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণ ৩২২ শতাংশ বেড়েছে (নিউ এজ, ২৭ সেপ্টেম্বর, ২০২৩)। ২৩ দশমিক ৫ বিলিয়ন থেকে ৯৯ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে বৈদেশিক ঋণ, কিন্তু দেশে রিফাইনারি তৈরি হয়নি। এই যুগেও পরিশোধিত তেল কিনে বাংলাদেশে ডলার গচ্চা দেয়, এটা ভাবা যায়?
না হয়েছে ইস্টার্ন রিফাইনারির নতুন ইউনিট, না হয়েছে বেসরকারি রিফাইনারি। রিফাইনারি না থাকায় রাশিয়ার মতো বড় তেল রপ্তানিকারক দেশ, যারা পরিশোধিত তেল বিক্রিই করে না, তাদের কম মূল্যের ক্রুড তেলের সুবিধা নিতে ব্যর্থ বাংলাদেশ। বেসিক পেট্রো কেমিক্যাল, হাইড্রো-কার্বন, মেলামাইন, প্লাস্টিক কাঁচামাল ইত্যাদি সবকিছু আমদানি করা লাগে। শিল্পের নাম এ যেন বড় লজ্জা!
অথচ শিল্প উন্নত রাষ্ট্রের একটা ভিত্তি হচ্ছে মৌলিক কেমিক্যাল উৎপাদনের সক্ষমতা, পেট্রো কেমিক্যাল, হাইড্রো কার্বন আলাদা করার সক্ষমতা এবং জ্বালানি শোধন শিল্পের উৎকর্ষ।
অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, সরকারের মধ্যে মেধার প্রকটতা এত বেশি যে বাংলাদেশ জানেই না কীভাবে ডলার সেভ করা লাগে এবং মৌলিক আমদানির বিকল্প কী? অথচ প্রতিদিন রেওয়াজ করে চলছে বেশি আমদানির অজুহাত আর ডলার ক্ষয়ের মিথ্যা কান্না।
প্রকৃত রিজার্ভ যখন ৪০ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছায়, আমরা দেখেছি স্পট মার্কেট থেকে উচ্চ মূল্যে জ্বালানি আমদানি করে ডলার ক্ষয়ের মহা আয়োজন, তবুও চেষ্টা হয়নি সাশ্রয়ী চুক্তির স্থায়ী আমদানির।
ডলার ক্ষয়ের একই অবস্থা শিক্ষা খাতে! বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা দক্ষতা উৎপাদনে অক্ষম বলে শিক্ষার্থীরা অধিক হারে ইংরেজি মাধ্যমে পড়ছে, দলে দলে বিদেশে আন্ডারগ্র্যাজুয়েশন করতে দেশ ছাড়ছে, এতে ব্যাংক লুটেরাদের অসৎ পাচারের পাশাপাশি তৈরি হয়েছে দরকারি পাচারের নতুন চ্যানেল।
একই অবস্থা স্বাস্থ্য খাতেও, ঢাকা ও বিভাগীয় পর্যায়ে চীন ও সৌদি আরবের বড় আকারের হাসপাতাল নির্মাণের প্রস্তাবে সরকারের আগ্রহ ছিল না। অথচ প্রতিবছর বিদেশ যাওয়া পর্যটকদের বড় অংশ ‘মেডিকেল ট্যুরিস্ট’। এই সব খাতে চ্যানেলে হুন্ডির চাহিদা বেড়ে রেমিট্যান্স কমছে!
পাঁচ-সাত বছরের ব্যবধানে অন্তত চার গুণ বেশি শ্রমিক বিদেশে গিয়েছেন, অথচ রেমিট্যান্স গ্রোথে তার রিফ্লেকশন নেই!
ডলার পাচারের বড় খাত বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাত, আরও বিশেষভাবে বললে ক্যাপাসিটি চার্জ এবং সবুজ বিদ্যুৎ না থাকা। সাশ্রয়ে জ্বালানি সরবরাহের পরও দেশি কোম্পানিকে ক্যাপাসিটি চার্জ দেওয়া হয় ডলারে, কী অনুর্বর উন্নয়ন চিন্তা! দেশে লাভ কমলেও বিদ্যুৎ খাতের দুই শীর্ষ কোম্পানি সিঙ্গাপুরে শীর্ষ ধনী হয়ে উঠেছে।
ডলার পাচারের বড় খাত বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাত, আরও বিশেষভাবে বললে ক্যাপাসিটি চার্জ এবং সবুজ বিদ্যুৎ না থাকা। সাশ্রয়ে জ্বালানি সরবরাহের পরও দেশি কোম্পানিকে ক্যাপাসিটি চার্জ দেওয়া হয় ডলারে, কী অনুর্বর উন্নয়ন চিন্তা! দেশে লাভ কমলেও বিদ্যুৎ খাতের দুই শীর্ষ কোম্পানি সিঙ্গাপুরে শীর্ষ ধনী হয়ে উঠেছে।
১৪ বছরে ৯০ হাজার কোটি টাকা ডলারে গচ্চা গেছে ক্যাপাসিটি চার্জ হিসেবে। গত ১২ বছরে পিডিবি লোকসান গুনেছে প্রায় ১ লাখ ৫ হাজার কোটি টাকা। বিপরীতে চলমান ও আগামী দুই অর্থবছরে পিডিবি লোকসান গুনবে প্রায় ১ লাখ ১৩ হাজার কোটি টাকা।
অর্থাৎ বিগত ১২ বছরে বিদ্যুৎ খাতে সরকার মোট যা লোকসান করেছে, শুধু আগামী ২ বছরেই তার চেয়ে বেশি লোকসান করবে। এসব পেমেন্টের উল্লেখ্যযোগ্য ডলারে যাবে।
বিদ্যুতের মাস্টারপ্ল্যান পিএসএমপি-২০১৬ মতে, ২০২১ সালের মধ্যে নন নিউক্লিয়ার নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ মোট সক্ষমতার অন্তত ১০ শতাংশ হওয়ার কথা ছিল, আমাদের আছে মাত্র সাড়ে ৪ শতাংশ।
আজকে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ থাকলে প্রাথমিক জ্বালানি আমদানির চাহিদা কমে আসত, এভাবে আমদানিতে ডলার গচ্চা যেত না এবং ডলার বকেয়া (বর্ধিত সুদ) এত বড় হতো না!
সব মিলিয়ে উন্নয়ন দর্শনে মোটাদাগের ভুল আছে সরকারের! ডলার বাঁচাতে গিয়েই গচ্চা দেওয়া হচ্ছে আরও বেশি ডলার।
ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব টেকসই উন্নয়নবিষয়ক লেখক। গ্রন্থকার: চতুর্থ শিল্পবিপ্লব ও বাংলাদেশ; বাংলাদেশ: অর্থনীতির ৫০ বছর; অপ্রতিরোধ্য উন্নয়নের অভাবিত কথামালা; বাংলাদেশের পানি, পরিবেশ ও বর্জ্য। ই-মেইল: faiz.taiyeb@gmail.com