কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা কি কখনো নোবেল পুরস্কার জিতবে

টাইম ম্যাগাজিন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে একটি বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ করেছে। ‘কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা: সম্ভাবনার নতুন যুগ’ শীর্ষক এ বিশেষ সংখ্যার সন্নিবেশিত লেখাগুলোর ওপর ভিত্তি করে প্রথম আলোর জন্য ধারাবাহিকভাবে লিখছেন ইশতিয়াক মান্নান। মূল লেখার সারাংশ, ভাষান্তর ও প্রাসঙ্গিক তথ্য-ব্যাখ্যা যুক্ত করেছেন তিনি। আজকের লেখার মূল প্রদায়ক: ব্রায়ানা ব্রাউনেল। আগামী সপ্তাহের লেখা, ‘কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা: মানবজাতি কি অস্তিত্বের সঙ্কটে?

প্রায় প্রতিদিনই এখন আর্টিফিশিয়াল ইন্টিলিজেন্স (এআই) বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে বিস্ময়কর সব শিরোনাম দেখা যায়। এআই কঠিন পরীক্ষায় পাশ করেছে, ছবি আঁকার প্রতিযোগিতায় জিতেছে কিংবা কাউকে ভালোবাসা জানিয়েছে ইত্যাদি। বিজ্ঞান ইতিহাসবিদরা বলছেন, এই যে এখন আমরা এআই’র অসম্ভবকে সম্ভব করার ক্ষমতা দেখে মুগ্ধ হচ্ছি, তা আসলে মানুষের ক্রমাগত আরো ভালো, আরো চৌকষ, দ্রুততর, আরো শক্তিশালী হয়ে ওঠার চেষ্টারই অংশ। এই চেষ্টার শুরু প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকেই।

আমরা চশমা, শোনার যন্ত্র কিংবা কৃত্রিম অঙ্গপ্রত্যঙ্গ ব্যবহার করতে শিখেছি নিজেদের শারীরিক ঘাটতি পূরণ করবার জন্য। কিন্তু এআই যখন পূর্ণ মাত্রায় ও শক্তিতে ব্যবহারযোগ্য হয়ে উঠবে, তখন মানুষের ক্ষমতার সীমানা ছাড়িয়ে যাবে অনায়াসে। ‘জেনারেটিভ এআই’ ইতোমধ্যেই মানুষের কাজ করবার ক্ষমতা, আরো দ্রুত শেখার, আরো কার্যকরভাবে যোগাযোগ করবার এমনকি আরও উদ্ভাবনী হয়ে ওঠার সম্ভাবনা তৈরী করেছে। এইসব বিচারে, এআই’র যাত্রায়, মানুষের সাথে পরিপূরক ও সম্পূরক আন্তঃসম্পর্কের ক্ষেত্রে উজ্জ্বলতর দিন অপেক্ষা করছে বলেই ধারণা করা হচ্ছে।

১৯৭৯ সালে এআই’র ইতিহাস নিয়ে লেখা, ‘যে যন্ত্র ভাবতে পারে’ বইতে পামেলা ম্যাকরডাক এআই নিয়ে বলছেন যে, ‘এই দুঃসাহসী উদ্যোগটি মানুষের সবচেয়ে নিজস্ব, সবচেয়ে পরিচায়ক গুন-বুদ্ধিমত্তাকে, যন্ত্রের মধ্যে নকল করতে চাইছে। অথচ এই বুদ্ধিমত্তাই মানুষকে মানুষ করে তুলেছে।’ তার মতে, এআই’র যাত্রা শুরু হয়েছে, খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে মহাকবি হোমারের ইলিয়াডের সময় থেকে। সেখানকার অতি ক্ষমতাবান চরিত্রগুলো যন্ত্র আর মানুষেরই এক ধরণের কল্পিত সমন্বয়।

এআই’র গবেষণা ও উন্নয়নে মানুষের বুদ্ধিমত্তার প্রায় সব মানবিক দিকগুলোই বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে। গণিত, বিজ্ঞান, ভাষা, কৌশল এই সবকিছুই গবেষণায় অন্তর্ভুক্ত ছিলো। সেই গবেষণাগুলোর ফলাফল থেকে মানুষ অবাক বিস্ময়ে লক্ষ করেছে যে, মানুষের চিন্তাপদ্ধতির প্রায় সবগুলো মৌলিক ধারাই যন্ত্রের মধ্যে ঢোকানো সম্ভব।

এআই’র আধুনিক ইতিহাস শুরু হয়েছে ১৯৫৫ সালের শেষে। নোবেলবিজয়ী অর্থনীতিবিদ হার্বার্ট সাইমন আর তাঁর সহকর্মী কম্পিউটার বিজ্ঞানী এলেন নিউয়েল তাদের কম্পিউটারকে, গণিতবিদ্যার বিখ্যাত মৌলিক বই ‘প্রিন্সিপিয়া ম্যাথমেটিকা’র তত্বগুলো প্রমাণ করতে দিয়েছিলেন। কম্পিউটার প্রোগ্রাম তখন শুধু সফলই হয়নি, মূল লেখকদের চেয়ে অনেক ভালোভাবেই প্রমান হাজির করেছিলো। মূল লেখকদের একজন, বার্ট্রান্ড রাসেল শুনে বলেছিলেন, ‘আমিও দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি যে কম্পিউটারের পক্ষে “ডাইডাক্টিভ লজিক” এর সবকিছুই করা সম্ভব।’

একই সময়ে, মানুষের জানার বা শেখার পদ্ধতিটাকে এআই’র মধ্যে সন্নিবেশিত করার চেষ্টা শুরু হলো। ‘ইন্ডাক্টিভ লজিক’ এর মাধ্যমে, অনুমান বা প্রস্তাবনাকে সাধারণের জন্য প্রযোজ্য করার এবং যুক্তি ব্যবহার করে উপসংহারে পৌঁছানোর যে বৈজ্ঞানিক কর্মপদ্ধতি সেগুলো কম্পিউটারকে শেখানোর চেষ্টা শুরু হলো।

ষাটের দশকে, কম্পিউটারের এই ‘শেখার পদ্ধতি’ মানুষের ভাষার প্রাচুর্য্য নিয়ে কাজ করতে শুরু করলো। এই কাজটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ কারণ ভাষার মাধ্যমেই মানুষ চিন্তা করে। এই কাজগুলোই আজকের এআই’র ক্ষেত্র প্রস্তুত করেছিলো। ১৯৯৪ তে টুরিং পুরস্কার বিজয়ী রাজ্ রেড্ডি ও মানুষের কথা শনাক্তকরণ নিয়ে কাজ করা ফাইঘেনবাম এই কাজগুলোতে নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন।

কম্পিউটারের পক্ষে আসলেই মানুষের মতো চিন্তা করা সম্ভব কি না, এটা নির্ধারণ করতে ব্রিটিশ বিজ্ঞানী অ্যালেন টুরিং, ‘নকল করার খেলা’ নামে পরিচিত একটা বিখ্যাত পরীক্ষা করেছিলেন। একজন প্রশ্নকারী না দেখে কম্পিউটারের সাথে আলাপ করবেন। যদি কম্পিউটার প্রশ্নকারীকে বোকা বানাতে পারে যে সে একজন মানুষ, তাহলে সে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ। কিন্তু বহু বছর পর্যন্ত কম্পিউটার এই পরীক্ষায় ফেল করে এসেছে-মানুষ প্রশ্নকারী খুব সহজেই বুঝে যাচ্ছিলো যে অপর প্রান্তের আলাপকারী আসলে মানুষ নয়। তখনকার সময়ে, এটা যুগান্তকারী পরীক্ষা ছিলো।

কম্পিউটার যে স্মার্ট হতে পারে তার প্রথম প্রমাণ হয়েছিলো ১৯৯৭। সবাইকে অবাক করে দিয়ে, আইবিএমের ‘ডিপ ব্লু’ সুপারকম্পিউটার দাবায় বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন গ্যারি কাস্পারভকে হারিয়ে দিলো। ধরা হয়, একজন গ্র্যান্ডমাস্টারের যে ধরণের কৌশলগত চিন্তার ক্ষমতা লাগে তা খুবই বিশেষায়িত এবং স্বভাবতই সাধারণ মানুষের চাইতে ওপরে। কিন্তু খেলার সময় দেখা গেলো, কম্পিউটার অনেকগুলো চাল এগিয়ে চিন্তা করতে পারছে—বিস্ময়কর তার দূরদৃষ্টি।

মাত্র দশ-বারো বছর আগে, চ্যাটবটগুলো টুরিংয়ের পরীক্ষায় পাশ করার পর্যায়ে পৌঁছাতে পেরেছে। পরীক্ষাটাও মজার ছিলো। ইউজিন গুস্টম্যান নামে এক চ্যাটবট বানানো হলো এমনভাবে যে সে ইউক্রেনের একজন তেরো বছরের ছেলে এবং বোধগোম্যভাবেই তার ইংরেজি খুব দুর্বল। পাঁচ মিনিট আলাপ আলোচনার পর প্রতি তিনজনের একজন বিচারক তাকে মানুষ বলেই রায় দিলেন। ইউজিন অতি দক্ষতার সাথে, দুর্বল ইংরেজি ও একেবারে একজন বয়োসন্ধির বাচ্চার মতো আলাপ করে বিচারকদের বোকা বানাতে পেরেছিলো। আলাপের এক পর্যায়ে সে টাইম ম্যাগাজিনের একজন সাংবাদিকের কাছে আবদার করে বসলো, তাকে যেন সে সিয়াটলে যাবার আমন্ত্রণ জানায়!

এআই কি কখনো নোবেল পুরস্কার জিতবে? সম্ভবত না, কিন্তু এমনটা হতে পারে যে কোনো একদিন ‘মানুষ এবং যন্ত্র’ যৌথভাবে নোবেল জিতে নেবে। ভবিষ্যতটা আমরা কেউ নিশ্চিত করে পড়তে পারছি না ঠিকই, কিন্তু এটা অবধারিত যে অভাবনীয় অনেক কিছু ঘটতে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে, বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনীতে যা লেখা হবে, বিজ্ঞান সেখানেই যাবে।

টুরিংয়ের পরীক্ষাই বুদ্ধিমত্তা বিচারের সবচেয়ে ভালো উপায় কি না এ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। তারপর, কম্পিউটারের স্মার্টনেস যাচাই করার জন্য একের পর এক অনেক পরীক্ষা তৈরী করা হয়েছে। যেমন উইনোগ্রাদ স্কিমা চ্যালেঞ্জ, বহুনির্বাচনী পদ্ধতিতে পরীক্ষা করলো কম্পিউটারের অস্পষ্টতা নির্ধারণ ও সাধারণ জ্ঞান প্রয়োগের ক্ষমতা, মার্কস টেস্ট কম্পিউটারকে ভিডিও দেখিয়ে সেখান থেকে প্রশ্ন করলো।

২০১৪ সালে লাভলেস ২.০ টেস্ট দেখলো, গাণিতিক ও বৈজ্ঞানিক যুক্তির বাইরে গিয়ে কম্পিউটার সৃষ্টিশীল কিছু করতে পারে কি না। সৃষ্টিশীলতার অনেক রকমফের আছে কিন্তু এটি মানুষের বুদ্ধিমত্তার একটা গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। ছবি আঁকা, কবিতা লেখা, গল্প লেখা, বাড়ির নকশা করা এই রকম সৃষ্টিশীল কাজে এখনকার এআই এপ্লিকেশনগুলো সেই টেস্ট ভালোভাবেই পাশ করবে বলে মনে হচ্ছে।

এআই’র অগ্রযাত্রা সম্ভব হয়েছে সমানতালে কম্পিউটেশনাল দক্ষতার বৃদ্ধি ও ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েবের কারণে। আগে তথ্য পাওয়া কঠিন ও ব্যয়সাধ্য ছিলো, কম্পিউটার ছিলো ধীরগতির। ফাইঘেনবাম বলছেন, ‘আগে আমাদের খুঁজে খুঁজে এক একজন বিশেষজ্ঞের মাথা থেকে তথ্য ও বুদ্ধি জোগাড় করতে হতো, আর এখন ব্যাপারটা এতো সহজ হয়ে গেছে যেনো বালির মধ্য থেকে হাতা দিয়ে সোনার গুঁড়া তুলছি।’ প্রচন্ড এবং দানবীয় শক্তি ছাড়া এই অসীম পরিমান জ্ঞান সেঁচে, ছক বা প্যাটার্ন চিহ্নিত করে কম্পিউটার শিখতে পারতো না।

তাঁর সময়ে, ফাইঘেনবাম একটাই মাত্র প্রোটিনের গঠন জানতেন-তা হচ্ছে হিমোগ্লোবিন। এখন কম্পিউটারের শক্তির ব্যাপ্তির কারণে এক লক্ষের বেশি প্রোটিনের গঠন জানা গেছে। এই তথ্য দিয়ে ‘ডিপ মাইন্ড’ এর তৈরী করা এআই প্রোগ্রাম ‘আলফাফোল্ড’ বহু রোগের আসল কারণ নির্ধারণ ও খুব সুনির্দিষ্ট চিকিৎসা নির্ধারণে সাহায্য করতে পারছে।

পর্দার অন্তরালে এআই’র প্রযুক্তিটা জটিল, কাজ করতে অনেক শক্তি লাগে, একে বোঝাও প্রায় অসম্ভব, কিন্তু সে যা করতে পারছে তা আমাদের ক্ষমতাকে কল্পনার দিগন্ত পার করে বিস্তৃত করে দিচ্ছে। আজ পর্যন্ত ‘চ্যাটজিপিটি’ ১০ কোটি বই পড়ে ফেলেছে। আমি বা আপনি যদি প্রতিদিন একটা করেও বই পড়ি তাহলে সারাজীবনে মাত্র ৪০ হাজার বই পড়া হবে। কাজেই কোনোভাবেই একজন মানুষের পক্ষে এই পরিমান জ্ঞান আয়ত্বে আনা সম্ভব নয়।

আজকে এআই’র কল্যাণে যে সুফলগুলো আমরা ভোগ করছি, সেগুলো আসলে তৈরী হয়েছে গত প্রায় ৭০ বছর ধরে, একটু একটু করে। এই সুফল আটকে নেই সরকারি গবেষণাগার বা সিলিকন ভ্যালির বড়ো টেক কোম্পানিগুলোর মধ্যে বরং পৌঁছে গেছে লাখ লাখ মানুষের পকেটে-একজন শিক্ষক, একজন চিত্রকর, একজন থেরাপিস্ট কিংবা একজন প্রোগ্রামার হয়ে।

একদিন যেগুলো বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী হিসাবেই আমরা পড়তাম, আজ সেগুলোই বাস্তবে ধরা দিচ্ছে। এআই’র কারণে মানবসভ্যতায় এই প্রথমবারের মতো সম্ভব হচ্ছে মানবজাতির চিন্তাকে এক সূত্রে গাঁথার এবং সুযোগ তৈরী হয়েছে একটা সম্মিলিত ভবিষ্যৎ গড়ার। রেড্ডি, এজিওনি, মেয়র, ফাইঘেনবামের মতো এআই এর চিন্তাবিদ এবং কারিগররা বলছেন, আসলে মানুষ ক্রমশ আরো স্মার্ট হয়ে উঠবে, এআই’র সাহায্য নিয়ে।

এআই কি কখনো নোবেল পুরস্কার জিতবে? সম্ভবত না, কিন্তু এমনটা হতে পারে যে কোনো একদিন ‘মানুষ এবং যন্ত্র’ যৌথভাবে নোবেল জিতে নেবে। ভবিষ্যতটা আমরা কেউ নিশ্চিত করে পড়তে পারছি না ঠিকই, কিন্তু এটা অবধারিত যে অভাবনীয় অনেক কিছু ঘটতে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে, বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনীতে যা লেখা হবে, বিজ্ঞান সেখানেই যাবে।

  • ইশতিয়াক মান্নান আন্তর্জাতিক সংস্থায় কর্মরত বিশেষজ্ঞ