রম্যকথন

আগাম অভিনন্দন তাকসিম এ খান, কংগ্রেচুলেশনস এমডি মহোদয়

তাকসিম এ খান
তাকসিম এ খান

যাক বাবা বাঁচা গেছে! তিনি আবার ‘ডেকো না আমারে তুমি পিছু ডেকো না’ বলে চলেটলে যান কি না, তাই নিয়ে বিরাট টেনশনে ছিলাম। কিন্তু ভারি আমোদ-আহ্লাদের কথা, তিনি ‘চলে যাব’ বলার আগেই সবাই মামাবাড়ির আবদার তোলার মতো করে তাঁকে বলে দিয়েছেন, ‘যেতে নাহি দিব’।

কারওয়ান বাজারের ওয়াসা ভবনের ইট-কাঠ, নিয়োগ-বদলি-পদোন্নতির ফাইলপত্র ও টেন্ডারের কাগজ যেন গুমরে-গুমরে বলছে, ‘আমি ভালোবাসি যারে, সে কি কভু আমা হতে দূরে যেতে পারে?’

না, পারে না। এই কারণে তিনি যাচ্ছেন না। ঠিক হয়েছে, যেকোনো উপায়ে হোক, ধরেবেঁধে হলেও তাঁকে ধরে রাখতে হবে। কর্মী থেকে কর্মকর্তারা তাঁকে বেঁকে না বসে থেকে যাওয়ার অনুরোধ করে মীরাক্কেলীয় কায়দায় বলছেন, ‘আপনি থাকছেন, স্যার!’
এই তিনি হলেন সেই তিনি, যিনি না থাকলে কী দশা হবে, সেই টেনশনে কষা বাধিয়ে ফেলে ঢাকা ওয়াসা। এই তিনি হলেন সেই তিনি, যিনি হয়তো ভাবেন তিনি না থাকলে ‘অভাগা দেশের হইবে কী?’ এই তিনি হলেন, ঢাকা ওয়াসার অজেয়, অক্ষয় এমডি মহোদয় তাকসিম এ খান।

২০০৯ সালে তিনি এসেছিলেন। সেই থেকে দায় ঠেকে থেকে গেছেন। ‘থেকে গেছেন’ বলতে তাঁকে যেতে দেওয়া হচ্ছে না। পরপর পাঁচ দফায় তাঁর মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে। আগামী অক্টোবরে তাঁর ষষ্ঠবারের মেয়াদ শেষ হচ্ছে। ষষ্ঠবারের পর কষ্ট করে যাতে তিনি সপ্তমবারও থেকে যান, সে জন্য ওয়াসা বোর্ডের চেয়ারম্যান সুজিত কুমার বালা তাকসিম এ খানের পালা তথা মেয়াদ বাড়ানোর পক্ষে জোরালো সুপারিশ করেছেন। এ বিষয়ে একটি প্রস্তাব করা হয়েছে। প্রস্তাবটি স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে যাবে। সেখান থেকে প্রস্তাবের সারাংশ প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে পাঠানো হবে। প্রধানমন্ত্রীর সই পেলে আর বাধা থাকল কই?

ওয়াসার ইতিহাসে আর কাউকে এত লম্বা সময় ধরে এমডির দায়িত্ব পালনের মতো কষ্টকর কাজটি করতে হয়নি। তাঁর প্রতি আমাদের কৃতজ্ঞই থাকা উচিত। কারণ, এই রেকর্ড না করে তাকসিম এ খানের উপায় ছিল না, এখনো নেই। কারণ, তিনি গেলে ওয়াসাকে কে দেখেশুনে রাখবে? তিনি গেলে ‘কে খেলে কে না খেলে’ তা তদারকি কে করবেন? আমরা কি বিকল্প কাউকে তৈরি করতে পেরেছি?

পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে, তাকসিম এ খান সপ্তম মেয়াদে থেকে গিয়ে থাকার রেকর্ড করবেন। ওয়াসার ইতিহাসে আর কাউকে এত লম্বা সময় ধরে এমডির দায়িত্ব পালনের মতো কষ্টকর কাজটি করতে হয়নি। তাঁর প্রতি আমাদের কৃতজ্ঞই থাকা উচিত। কারণ, এই রেকর্ড না করে তাকসিম এ খানের উপায় ছিল না, এখনো নেই। কারণ, তিনি গেলে ওয়াসাকে কে দেখেশুনে রাখবে? তিনি গেলে ‘কে খেলে কে না খেলে’ তা তদারকি কে করবেন? আমরা কি বিকল্প কাউকে তৈরি করতে পেরেছি? বিকল্প কেউ কি আছে? নেই তো! তিনিই তাঁর একমাত্র বিকল্প।

গত বছরের নভেম্বরে প্রথম আলো একটি খবরে বলেছে, ১৩ বছরে তাকসিম বেতন-ভাতা হিসেবে নিয়েছেন মাত্র ৫ কোটি ৮০ লাখ টাকা। তাঁর মাসিক বেতন সোয়া ছয় লাখ টাকা। আনুষঙ্গিক সুবিধার কথা বাদ থাকল। করোনা মহামারিতে যখন দেশে মরার দশা, তখন একলাফে তাঁর বেতন বাড়ানো হয়েছিল পৌনে দুই লাখ টাকা। কী করা যাবে, শুধু মুখের কথায় তো চিড়ে ভেজে না। এত বড় একজন মানুষকে ধরে রাখবা আর পয়সা ফেলবা না, তা তো হয় না।

আর তিনি এ দেশে থাকেন বটে, তাঁর কেউ তো আর এ দেশে থাকেন না। তিনি নিজেও আমেরিকার নাগরিক। স্ত্রী ও সন্তানেরাও আমেরিকান সিটিজেন। ওই মাপের কথা মাথায় রেখে তাঁর জন্য ওয়াসা বড়মাপের বড় বেতন ধরেছে। এর আগে আমেরিকায় তাঁর অঢেল সম্পদ ও একাধিক ফ্ল্যাট থাকার কথা পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল। সে সময় তিনি পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছেন, তিনি যে দেশের নাগরিক, সেই আমেরিকায় তাঁর মোটে একটি বাড়ি আছে, তা-ও তাঁর স্ত্রীর কেনা।

দারা-পুত্র-পরিবারকে যাতে সময় দেওয়া যায়, সে জন্য তিনি যুক্তরাষ্ট্রে বসে অফিস করতে চেয়েছিলেন। মানে আমেরিকায় তিনি যত দিন থাকবেন, তত দিন তিনি ‘অন ডিউটিতে’ থাকবেন। এই রিমোট কন্ট্রোল অন ডিউটির মতো বিউটিফুল আইডিয়া সরকার মানেনি। সরকার বলেছে, দুর্নীতি দমন কমিশনে তাঁর নামে একাধিক দুর্নীতির মামলা চলায় এই আবদার করা ঠিক হবে না।

মন্দ লোকেরা বলাবলি করে, তাকসিম এ খানকে নাকি ‘অদৃশ্য শক্তি’ চেয়ার ছেড়ে যেতে দেয় না। তাঁর ব্যাপারে নাকি সব আইনকানুন ভেঙে ফেলা হয়েছে। তিনি নাকি আইনের ঊর্ধ্বে উঠে গেছেন। তাঁর আয়ু নাকি সরকারের মেয়াদের সমান।
তবে আমরা জানি, তাকসিম এ খান তাঁদের কথায় রাগ করে চলে যাবেন না। কারণ তিনি দায়িত্বশীল মানুষ, ওয়াসাকে তো তিনি আর পানিতে ফেলে চলে যেতে পারেন না! শত্তুরের মুখে ছাই দিয়ে তিনি সপ্তমবারের মতো ওয়াসার এমডি হবেন।
আপনাকে টুপিখোলা অভিনন্দন, তাকসিম এ খান। কংগ্রেচুলেশনস এমডি মহোদয়।

  • সারফুদ্দিন আহমেদ প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক
    sarfuddin 2003 @gmail. com