মতামত

বিশ্বব্যাংক আমাদের কতটা বন্ধু

১৯৮৯ সালের সেপ্টেম্বর মাস, অনেক দিন আগের কথা। আমি গিয়েছিলাম ওয়াশিংটন ডিসিতে। উদ্দেশ্য মহৎ, ওয়ার্ল্ড ব্যাংক ও ইন্টারন্যাশনাল মনিটরি ফান্ডের (আইএমএফ) বার্ষিক মিটিং দেখতে। দুটি সহোদর প্রতিষ্ঠান। ব্যাংককে বলা হয় বৈশ্বিক মহাজন। আমরা বুঝে কিংবা না বুঝে তাকে গালাগাল করি। বলি, সাম্রাজ্যবাদের খুঁটি, নষ্টের গোড়া।

আমি গিয়েছিলাম নাগরিক সংগঠন থার্ড ওয়ার্ল্ড নেটওয়ার্কের প্রতিনিধি হিসেবে। সেখানে পৃথিবীর নানা প্রান্ত থেকে নাগরিক অধিকারকর্মীরা সমবেত হয়েছেন। ব্যাংক-ফান্ডের সভা বসেছে ওয়াশিংটন শেরাটন হোটেলে। আমরা তার প্রবেশপথ আটকে দাঁড়িয়ে আছি।

নানা রকম স্লোগান দিচ্ছি, ‘বিশ্বব্যাংক নিপাত যাক’, ‘সাম্রাজ্যবাদ ধ্বংস হোক’ ইত্যাদি। যাঁরা সভায় যোগ দিতে এসেছেন, তাঁরা বেশির ভাগই কোনো না কোনো দেশের অর্থমন্ত্রী বা উঁচু পদের কর্মকর্তা।

আমাদের বাধার কারণে তাঁরা কেউ গাড়ি নিয়ে হোটেলে ঢুকতে পারছেন না। এভাবে কেটে গেল প্রায় ৩০ মিনিট। তারপর পুলিশ এল। সবার দশাসই চেহারা। কোমরে বেল্টের সঙ্গে বাঁধা ব্যাটন। কারও সঙ্গে রিভলবার। তারা সবাইকে হোটেলের প্রবেশপথ থেকে সরে যেতে বলল।

কে শোনে কার কথা! কিছু উত্তপ্ত বাক্যবিনিময় আর ধাক্কাধাক্কি হলো। আমরা অনেকেই সরে দাঁড়ালাম। কিন্তু কয়েকজন গেটের সামনে বসে পড়ল। তারা সবাই আমেরিকান বা ইউরোপীয়। একজন ফিলিপিনো—আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু অধ্যাপক ওয়াল্ডেন বেলো। পুলিশ তাদের ১১ জনকে ধরল। পিছমোড়া করে প্লাস্টিকের হাতকড়া পরাল। তারপর গাড়িতে তুলে নিয়ে গেল। একজন এসে আমাদের কাছ থেকে এক ডলার করে চাঁদা ওঠাল। সেই টাকা দেওয়া হলো এক অ্যাটর্নিকে। পরদিন সকালে ১১ জনই ছাড়া পেয়ে গেল।

তখন আমার বয়স অল্প। রক্ত গরম। একবার ভেবেছিলাম, আমিও ওই ১১ জনের সঙ্গে গিয়ে বসি। পরে মনে হলো, এই ‘অপরাধে’ ভবিষ্যতে হয়তো এ দেশের ভিসা পাব না। পাকিস্তানি নির্বাসিত লেখক তারিক আলী একবার ভিয়েতনাম যুদ্ধবিরোধী এক সমাবেশে মার্কিন পতাকা পুড়িয়েছিলেন। শুনেছি, এরপর তিনি আমেরিকায় ব্রাত্য। ওয়াল্ডেন বেলোর অবশ্য কিছু হয়নি। তিনি এখন ফিলিপাইনের সিনেটর।

গল্পটা এ জন্য বললাম যে এভাবেই বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে আমার পরিচয়। এরপর নানান মিটিং উপলক্ষে তাদের অফিসে কয়েকবার গিয়েছি। বিশ্বব্যাংক সম্পর্কে আমার বাগাড়ম্বর খুব বদলেছে বলে মনে হয় না।

বিশ্বব্যাংক ঋণদানকারী সংস্থা হিসেবে বাংলাদেশে বেশ জনপ্রিয় ছিল। পদ্মা সেতুতে ঋণ দিতে গিয়ে যে ক্যাচাল লেগেছিল, তার ফলে ব্যাংকের সঙ্গে সরকারের দূরত্ব বেড়েছে। কয়েকজন ষড়যন্ত্রকারী কাশিমবাজার কুঠিতে বসে একদিন সিদ্ধান্ত নিলেন, ‘চলো, আমরা বাংলাদেশকে একহাত দেখিয়ে দিই’—বিষয়টি কি এমন ছিল? এ নিয়ে নিশ্চয়ই একদিন অনুসন্ধানী গবেষণা হবে। তখন আমরা জানতে পারব, আসলে কী ঘটেছিল।

বিশ্বব্যাংকের জন্ম জাতিসংঘেরও আগে। আমরা অনেকেই মনে করি, এটা বুঝি একটা বিদেশি সংগঠন। আসলে এটি একটি আন্তর্জাতিক সংস্থা। যেকোনো দেশ এর সদস্য হতে পারে। কয়েকটি দেশ, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র এটি নিয়ন্ত্রণ করে বলে একটা কথা চালু আছে। কথাটা মিথ্যা নয়, কিন্তু তারা তো জাতিসংঘকেও নিয়ন্ত্রণ করে! বাংলাদেশ জাতিসংঘের সদস্য হওয়ার আগেই বিশ্বব্যাংকের সদস্য হয়েছে।

শুধু সদস্য নয়, দক্ষিণ এশিয়ার কোটা থেকে বাংলাদেশ এই সংস্থার বিকল্প নির্বাহী পরিচালক। নির্বাহী পরিচালকের পদটি সংরক্ষিত আছে ভারতের জন্য। আমাদের দেশের সাবেক সচিবেরা অনেকেই অবসরে যাওয়ার আগে বা পরে পুরস্কার বা রিট্রিট হিসেবে ওই পদে যান দুই বা তিন বছরের জন্য। সেখানে তাঁরা কী করেন, জানি না। আমি বেশ কয়েকবার জিইএফের (গ্লোবাল এনভায়রনমেন্ট ফ্যাসিলিটি) কাউন্সিল মিটিংয়ে বিশ্বব্যাংকের সদর দপ্তরে গিয়েছি। তাঁদের দেখা পাইনি। একবার জরুরি প্রয়োজনে ভারত ও পাকিস্তানের প্রতিনিধির সঙ্গে কথা বলেছিলাম। তাঁরা সময় দিয়েছিলেন।

বাংলাদেশ বিশ্বব্যাংক থেকে নিয়মিত ঋণ নেয়। বিশ্বব্যাংক হলো বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণের সবচেয়ে বড় উৎস। স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে বাংলাদেশ এত বছর ‘সফট লোন’ পেয়ে আসছে। এই ঋণের মাজেজা হলো, সুদের হার খুব কম, অনেক ক্ষেত্রেই ১ শতাংশও নয়। শোধ দিতে হয় ৪০ বছরে। প্রথম ১০ বছর হলো গ্রেস পিরিয়ড, অর্থাৎ এ সময়ে ঋণের কোনো কিস্তি শোধ দিতে হয় না। ধরে নেওয়া হয়, ঋণের টাকায় প্রকল্প বাস্তবায়নে সময় লাগে।

তা ছাড়া বিনিয়োগের সুফল চটজলদি পাওয়া যায় না। সে জন্য ১০ বছরের একটা গ্রেস পিরিয়ড ঋণগ্রহীতার জন্য অনেক সুবিধাজনক। অর্থনীতির সূত্র অনুযায়ী জানি, আজ ১ হাজার টাকা ধার নিলে ৪০ বছর পর ওই ১ হাজার টাকার কী দাম আছে! সেই অর্থে বিশ্বব্যাংকের ঋণ পাওয়া মানে অনেকটা মুফতে টাকা পাওয়া। বিশ্বব্যাংক কোনো এজেন্টকে কমিশন দেয় না। তাদের প্রকল্প নজরদারি খুব কড়া। অনেক আমলা বা ঠিকাদার এসব শর্ত পছন্দ করেন না। নিজেদের অর্থে করলে ঋণদাতার কাছে জবাবদিহি করতে হয় না। অনেক বন্ধুদেশ আমাদের চড়া সুদে ঋণ দেয়।

বিশ্বব্যাংক ঋণদানকারী সংস্থা হিসেবে বাংলাদেশে বেশ জনপ্রিয় ছিল। পদ্মা সেতুতে ঋণ দিতে গিয়ে যে ক্যাচাল লেগেছিল, তার ফলে ব্যাংকের সঙ্গে সরকারের দূরত্ব বেড়েছে। কয়েকজন ষড়যন্ত্রকারী কাশিমবাজার কুঠিতে বসে একদিন সিদ্ধান্ত নিলেন, ‘চলো, আমরা বাংলাদেশকে একহাত দেখিয়ে দিই’—বিষয়টি কি এমন ছিল? এ নিয়ে নিশ্চয়ই একদিন অনুসন্ধানী গবেষণা হবে। তখন আমরা জানতে পারব, আসলে কী ঘটেছিল।

এটা ঠিক, বিশ্বব্যাংকসহ অন্যান্য ঋণদানকারী সংস্থা ও দেশ অনেক অপ্রয়োজনীয়, এমনকি ক্ষতিকর প্রকল্পে ঋণ দেয়। প্রকল্পের প্রস্তাব আসে আমাদের কর্তাদের কাছ থেকেই। একটা উদাহরণ দিই। বিশ্বব্যাংকের ঋণের টাকায় চকরিয়া সুন্দরবন ধ্বংস করে চিংড়ি চাষের সুযোগ তৈরি করে দেওয়া হয়েছিল। আরেকটি উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। বিশ্বব্যাংক ও এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) চলে একই নিয়মে। তারা আমাদের গ্রামীণ অবকাঠামোতে অনেক বিনিয়োগ করেছে। এর বেশির ভাগ প্রকল্প হলো স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের।

তারা যেভাবে রাস্তাঘাট, কালভার্ট আর সেতু বানিয়েছে, তার অনেকগুলোই এখন বিষফোড়া। খাল মজে গেছে, নদী মরে গেছে, খাল-নদীতে নৌকা চলে না, খাল রাস্তা হয়ে গেছে আর রাস্তা হয়ে গেছে খাল। কথা উঠেছে এসব কালভার্ট-সেতু ভেঙে নতুন করে বানাতে হবে।

সম্প্রতি বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে বাংলাদেশের ২২৫ কোটি ডলারের কয়েকটি ঋণচুক্তি হয়েছে। আমাদের প্রধানমন্ত্রী এবং বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট সেখানে উপস্থিত ছিলেন। প্রধানমন্ত্রী ব্যাংকের প্রেসিডেন্টকে পদ্মা সেতুর একটা ছবি উপহার দিয়েছেন। ছবিটা ভাইরাল হয়েছে।

এটা নাকি ‘মধুর প্রতিশোধ’, প্রধানমন্ত্রীর ‘বিশ্বব্যাংক জয়’ ইত্যাদি। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, বাংলাদেশ কখনো ঋণের ফাঁদে পড়েনি, খেলাপি হয়নি। তিনি আরও বলেছেন, ‘এখানে (বিশ্বব্যাংকে) আমার উপস্থিতি ইঙ্গিত দেয় যে আমরা বিশ্বব্যাংকের প্রতি আস্থা রেখেছি’ (প্রথম আলো, ৩ মে ২০২৩)। বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে সম্পর্কটা বরাবরই ভালো। মাঝখানে পদ্মা সেতু নিয়ে সম্পর্কে ঝাঁকুনি লেগেছিল।

বিশ্বব্যাংকে চাকরিতে থাকা আমাদের দেশের কর্মকর্তারা কিংবা বিকল্প নির্বাহী পরিচালকেরা যদি তাঁদের অভিজ্ঞতার বিবরণ লেখেন, আমরা অনেক আলোকপ্রাপ্ত হব। তাহলে ভেতরের অনেক কথা জানতে পারব। তা না হলে যা শুনি, তা-ই বিশ্বাস করতে হবে।

  • মহিউদ্দিন আহমদ লেখক ও গবেষক