মতামত

ভূমধ্যসাগরে ডুবছে ইউরোপীয় মানবাধিকার

গ্রিসের উপকূলের কাছে ভূমধ্যসাগরে ডুবে যাওয়া জাহাজ থেকে উদ্ধার করা এক অভিবাসনপ্রত্যাশী।
ছবি: এএফপি

ভূমধ্যসাগর ক্রমশই হতে চলেছে সলিলসমাধির সাগর। বুধবার ১৪ জুন গভীর রাতে গ্রিসের উপকূলে আবারও ডুবেছে প্রায় সাড়ে ৭০০ শরণার্থী বোঝাই একটি জাহাজ। উদ্ধার করা গেছে মাত্র ১০৪ জনকে। সাগরে সলিলসমাধি ঘটেছে পাঁচ শতাধিক মানুষের।

এ ঘটনা যখন ঘটল, ঠিক তার এক সপ্তাহ আগেই ইউরোপীয় ইউনিয়ন ইউরোপে শরণার্থীদের প্রবেশের বিষয়ে কড়া আইন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। জাতিসংঘের অভিবাসীবিষয়ক সংস্থা আইওএম জানায়, ২০১৪ সাল থেকে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিতে গিয়ে ২০ হাজারের বেশি মানুষ মারা গেছেন।

বুধবারের এ ঘটনার পর গ্রিসে তিন দিন রাষ্ট্রীয় শোক পালনের ঘোষণা আর ইউরোপের কিছু নেতার লোকদেখানো দুঃখ প্রকাশ ছাড়া আর কিছু শোনা যাচ্ছে না। ইইউ সদর দপ্তর থেকে বরাবরের মতো এ ঘটনার জন্য মানব পাচারকারীদের শায়েস্তা করার কথা বলা হচ্ছে। কিন্তু এই শরণার্থীরা কেন তাঁদের দেশ ছেড়ে বিপৎসংকুল পথ পাড়ি দিচ্ছেন, সেই উত্তর তারা খুঁজছে না। ওই দেশগুলোর সমাজ, অর্থনীতি, যুদ্ধাবস্থা ও রাজনৈতিক সংকট কাদের কারণে ঘটেছে, তা বলা হবে না।

আজ যারা বিশ্বের মানবাধিকার ও গণতন্ত্রের জন্য সদা সোচ্চার, তাদের ইতিহাসটা আমরা সবাই জানি। সেই ১৫০০ শতাব্দীর শেষ দিক থেকেই ইউরোপীয়রা নিজেদের অর্থনৈতিক দৈন্যদশা থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার উপায় খুঁজতে সমুদ্রপথের পথিক হয়েছিলেন। বণিকের বেশে প্রবেশ করে অপরের ভূখণ্ডের মালিক হয়েছিলেন।

এই বণিকেরা পৃথিবীর কোনো প্রান্ত বাদ দেননি। আফ্রিকা, এশিয়া, লাতিন আমেরিকা—সব মহাদেশেই তাঁরা ব্যবসা করেছেন আর অঢেল মুনাফার পাহাড় গড়ে নিজেদের দেশের চাকচিক্য বাড়িয়েছিলেন। আবার একসময় অপর ভূখণ্ডের শাসক হয়ে বসেছিলেন।

গ্রিসের উপকূলের কাছে ভূমধ্যসাগরে ডুবে যাওয়ার আগে অভিবাসনপ্রত্যাশীদের বহনকারী সেই জাহাজ।

আজ প্রায় ৫০০ বছর পর ঘটনাটি বিপরীত—পৃথিবীর দারিদ্র্য, নিপীড়িত, যুদ্ধ-দাঙ্গাপীড়িত অভাবী অর্ধাহারে থাকা মানুষেরা স্বাবলম্বী মহাদেশের মানুষের কাছে একটু স্বপ্ন দেখতে চাইছেন, একটু আশ্রয় খুঁজছেন। কিন্তু সেই স্বপ্ন, সেই আশ্রয়ের সলিলসমাধি ঘটছে ইউরোপের সর্বদক্ষিণে ভূমধ্যসাগরের লোনাজলে। এই মানুষদের ইউরোপে আসা রুখতে তারা নিত্যনতুন আইন তৈরি করছে।

ভূমধ্যসাগরে এবারের এ ঘটনা সম্পর্কে ইউরোপের বিভিন্ন পত্রপত্রিকা জানিয়েছে, ১৪ জুন বুধবার সকালে গ্রিসের দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূল থেকে প্রায় ৯২ কিলোমিটার দূরে পেলোপনিস উপদ্বীপের কাছে প্রায় ৩০ মিটার দীর্ঘ, মরিচা পড়ে যাওয়া পুরোনো মাছ ধরার জাহাজটি ডুবে যায়। জাহাজটি যাত্রা শুরু করেছিল মিসর থেকে। তারপর জাহাজটি লিবিয়ার টোব্রুকে থামে এবং আরও লোক নিয়ে ইতালি অভিমুখে রওনা হয়। জাহাজটির বেশির ভাগ যাত্রী ছিল সিরিয়া, আফগানিস্তান ও পাকিস্তানের।

গ্রিসে রাষ্ট্রীয় রেডিওতে কোস্টগার্ডের একজন মুখপাত্র বলেছেন, জাহাজটিতে সাত শতাধিক শরণার্থী ছিলেন। বেশির ভাগ যাত্রীরা সময়মতো জাহাজটি ছাড়তে পারেননি। প্রায় ১০০ শিশুসহ অনেক নারী ডেকের নিচে অবস্থান করেছিলেন। বেশির ভাগ যাত্রীদের কোনো লাইফ জ্যাকেট ছিল না। বেঁচে যাওয়া ১০৪ জনকে আপাতত দক্ষিণ গ্রিসের বন্দর কালামাতায় তাঁবুতে রাখা হয়েছে। বেঁচে যাওয়া যাত্রীদের মধ্যে ৯ মিসরীয়কে জাহাজটির নাবিক ও মানব পাচারকারী সন্দেহে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

গ্রিসের বিরোধীদলীয় নেতা ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী অ্যালেক্সিস সিপ্রাস গ্রিসের কোস্টগার্ডের আচরণ নিয়ে সমালোচনা করেছেন। বলেছেন ভিন্ন কথা। তিনি ঘটনার পরের দিন কালামাতা বন্দরে উদ্ধারকৃত শরণার্থীদের তাঁবু পরিদর্শনের সময় বেঁচে থাকা ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলেন। তিনি বলেন, ডুবে যাওয়ার আগে সাহায্যের জন্য ডাকাডাকি করলেও উদ্ধারের জন্য কেউ এগিয়ে আসেনি।

জার্মানির ডের স্পিগেল পত্রিকাটি উদ্ধার হওয়া ব্যক্তিদের উদ্ধৃত করে জানিয়েছে, ‘জাহাজটি ডুবে যাওয়ার আগে সবাই চিৎকার করছিল এবং একে অপরকে ধরে রাখার চেষ্টা করছিল।’

ইউরোপের পথে সিরিয়া, লিবিয়া, ইরাক, আফগানিস্তান বা আফ্রিকার দেশগুলো থেকে কেন এত শরণার্থী জীবন বাজি রেখে নিজের জন্মভূমি ফেলে দুর্গম সাগর বা সড়কপথ পাড়ি দিয়ে ইউরোপের পথে পা বাড়াল, সেই আলোচনা ইউরোপে খুব কম। এই দেশগুলোর মানুষকে বাস্তুহারা করার পেছনে ইউরোপের অনেক দেশ, আমেরিকা আর ন্যাটো জোট তাদের ভুল যুদ্ধনীতি অস্বীকার করতে পারবে না।

জার্মানিতে বসবাসরত একজন সিরিয়ান তাঁর স্ত্রীকে কালামাতা বন্দরে খুঁজছিলেন। তিনি জানান, তিনি পাচারকারীদের সাড়ে চার হাজার ডলার প্রদান করেছিলেন। ঘটনার এক দিন পরেই গ্রিসের রাজধানী এথেন্স এবং বন্দর শহর থেসালোনিকিতে সন্ধ্যায় অসংখ্য মানুষ ইইউ অভিবাসন নীতির বিরুদ্ধে বিক্ষোভ করে বলেছেন, ‘ইউরোপীয় ইউনিয়ন মানুষ হত্যা করছে।’

জার্মানির টাজ পত্রিকা লিখেছে, ইউরোপীয় ইউনিয়নকে এ ঘটনায় জড়িত করার সময় এসেছে। কারণ হিসাবে তারা বলেছে, ‘ইইউ মানবাধিকারের প্রসঙ্গে সব সময় কথা বললেও বছরের পর বছর এ ঘটনা ঘটছে। শরণার্থীদের প্রশ্নে মূল সমস্যা অগোচরে রেখে তারা ইউরোপে নতুন শরণার্থী আইন প্রণয়ন করতে যাচ্ছে।’

৮ জুন লুক্সেমবার্গে ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলো শরণার্থীদের জন্য ইউরোপে আরও কড়া নিয়ম করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। ইইউ কমিশনার ইভা ইয়োহান্সসনের মতে, এই ঐকমত্য ঐতিহাসিক পদক্ষেপ। তাঁর মতে, ইইউভুক্ত দেশগুলো এখন থেকে একসঙ্গে কাজ করলে ইউরোপে আগত শরণার্থীদের সমস্যা মানবিক অথচ কঠোর পন্থায় সামলানো যাবে।

শরণার্থী বিষয়ে ইইউর দেশগুলোর এই অভিন্ন সিদ্ধান্ত কতটা মানবিক, তা তাদের মুখ্য সংস্কার নীতিটি জানলেই বোঝা যাবে। তাদের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, ইউরোপীয় ইউনিয়নের ২৭টি দেশের কোনো একটি দেশের সীমান্তে কোনো শরণার্থী রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনা করলে প্রথমে আশ্রয়প্রার্থীকে ১২ সপ্তাহের জন্য সীমান্তবর্তী আশ্রয়শিবিরে রাখা হবে। সেখানে সেই রাজনৈতিক আশ্রয়প্রার্থীর আবেদন যাচাই-বাছাই করা হবে।

অর্থাৎ, ইইউ ঠিক করবে কোন দেশটি সমস্যাপূর্ণ বা সংকটবহুল এবং আদৌ তিনি রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনার যোগ্য কি না। নয়তো ১২ সপ্তাহ পর থাকে ফেরত পাঠানো হবে।

ইউরোপের পথে সিরিয়া, লিবিয়া, ইরাক, আফগানিস্তান বা আফ্রিকার দেশগুলো থেকে কেন এত শরণার্থী জীবন বাজি রেখে নিজের জন্মভূমি ফেলে দুর্গম সাগর বা সড়কপথ পাড়ি দিয়ে ইউরোপের পথে পা বাড়াল, সেই আলোচনা ইউরোপে খুব কম। এই দেশগুলোর মানুষকে বাস্তুহারা করার পেছনে ইউরোপের অনেক দেশ, আমেরিকা আর ন্যাটো জোট তাদের ভুল যুদ্ধনীতি অস্বীকার করতে পারবে না। যুদ্ধের কারণে আজকের যে মানবিক সমস্যা, তাতে তাদের দায়ভারের কথা তাদের ভাবতে হবে। নতুবা ইউরোপীয় মানবাধিকারের বারবারই সলিলসমাধি ঘটবে ভূমধ্যসাগরের লোনাজলে।

  • সরাফ আহমেদ প্রথম আলোর জার্মানি প্রতিনিধি
    sharaf.ahmed@gmx.net