স্বাস্থ্য খাতে খামখেয়ালিপনার শেষ কোথায়

করোনা মহামারির পরও দেশের স্বাস্থ্য খাতে খামখেয়ালিপনা বন্ধ হয়নি।
ফাইল ছবি

করোনা মহামারির পরও দেশের স্বাস্থ্য খাতে খামখেয়ালিপনা বন্ধ হয়নি। বরং দিন দিন হঠকারী সিদ্ধান্ত বেড়েই চলেছে। উদ্দেশ্য ভালো হওয়া সত্ত্বেও দূরদর্শিতার অভাব এবং বিজ্ঞানভিত্তিক তথ্য-উপাত্ত ব্যবহার না করে সিদ্ধান্ত গ্রহণের কারণে এ খাত আজ চরম সংকটে। এখানে খামখেয়ালিপনার কিছু চিত্র তুলে ধরা হয়েছে।

১.

হরেদরে মেডিকেল কলেজের সংখ্যা বৃদ্ধি এই খাতের খামখেয়ালিপনার বড় উদাহরণ। সরকারি ও বেসরকারি মেডিকেল কলেজের সংখ্যা দিন দিন ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি এবং প্রয়োজনীয় অবকাঠামো তৈরি না করে কিংবা উপযুক্তসংখ্যক শিক্ষকের সংস্থান না করে নতুন মেডিকেল কলেজে পাঠদান চালু করার যে প্রবণতা চলছে, তাকে একটি ‘রোগ’ বলা যেতে পারে।

এখনো মানের বিবেচনায় আমাদের সিনিয়র এবং মধ্যম সারির চিকিৎসকেরা উন্নত বিশ্বের চিকিৎসকদের সমতুল্য, ক্ষেত্রবিশেষে এগিয়েও আছেন। কিন্তু নামসর্বস্ব মেডিকেল কলেজের স্নাতকেরা যখন চিকিৎসকের জায়গায় উপবিষ্ট হবেন, তখন রোগীর পক্ষে হাসপাতালে না গিয়ে বাড়িতে বিনা চিকিৎসায় থাকাই বেশি নিরাপদ হবে বলে মনে হচ্ছে।

এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণের সুযোগ এখনো কিছুটা আছে। প্রথমটি, থাইল্যান্ডের মতো মেডিকেল এবং ডেন্টাল স্নাতকদের বিএমডিসির যোগ্যতা যাচাই পরীক্ষায় পাসের সাপেক্ষে প্র্যাকটিস করার অনুমোদন ও নবায়ন ব্যবস্থা চালু করা।

দ্বিতীয়টি, যেসব সরকারি মেডিকেল কলেজে এখন পর্যন্ত প্রয়োজনীয় অবকাঠামো তৈরি হয়নি এবং উপযুক্ত শিক্ষকের সংস্থান করা যায়নি, সেখান থেকে শিক্ষার্থীদের পার্শ্ববর্তী মেডিকেল কলেজে যেখানে এ ধরনের সংকট নেই, সেখানে স্থানান্তর করা এবং এ সংকট দূর না করা পর্যন্ত শিক্ষার্থী ভর্তি বন্ধ রাখা। পাশাপাশি যেসব বেসরকারি মেডিকেল কলেজে প্রয়োজনীয় অবকাঠামো এবং উপযুক্ত শিক্ষকের সংস্থান নেই, সে বিষয়ে সংশ্লিষ্ট অনুমোদনকারী বিশ্ববিদ্যালয় এবং বিএমডিসির সমন্বয়ে গঠিত একটি শক্তিশালী কমিটির মাধ্যমে যাচাই–বাছাই সাপেক্ষে প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণ।

সবচেয়ে বেশি দরকার যেটি, সেটি হলো সরকারি কিংবা বেসরকারি পর্যায়ে আর কোনো নতুন মেডিকেল কলেজের অনুমোদন না দেওয়া।

সরকারকে একটি বিকল্প উপায় ভাবতে হতে পারে। তুরস্কের মতো সরকারি হাসপাতালে প্রত্যেক চিকিৎসক কর্তৃক একটি নির্দিষ্টসংখ্যক রোগী দেখা বা সার্জারি করা কিংবা সার্জারিসংক্রান্ত আনুষঙ্গিক কাজ করার পর অতিরিক্ত রোগী দেখা বা সার্জারি করার জন্য রোগীপ্রতি সংশ্লিষ্ট হাসপাতালের একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ সরকারি অর্থপ্রাপ্তির সুযোগ প্রচলন করা যেতে পারে।

 ২.

এই খাতের খামখেয়ালিপনার চূড়ান্ত রূপ হলো অযাচিতভাবে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে দুটি বিভাগে ভাগ করে উক্ত মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন দপ্তরকে অযৌক্তিক এবং অবৈজ্ঞানিকভাবে এ দুটি বিভাগের অধীনে বণ্টন করা। এর ফলে কার্যত বিগত ছয় বছরে দুই বিভাগের মধ্যে রেষারেষি চরমে পৌঁছেছে এবং সমন্বয়হীনতায় কাজের গতি অনেকটা ধীর হয়েছে।

পরিবার–পরিকল্পনা সেবা প্রতিরোধমূলক প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। বাংলাদেশ ছাড়া পৃথিবীর কোনো দেশেই এ দুটি সেবা আলাদাভাবে দুটি ভিন্ন সংস্থার মাধ্যমে প্রদান করা হয় না। বাংলাদেশে পরিবার–পরিকল্পনা অধিদপ্তর গঠনের মাধ্যমে ১৯৭৫ সাল থেকে স্বাস্থ্যসেবা এবং পরিবার–পরিকল্পনা সেবা মাঠপর্যায়ে (অর্থাৎ জেলা থেকে ইউনিয়ন পর্যায়ে) দুটি ভিন্ন সংস্থার মাধ্যমে বাস্তবায়িত হচ্ছে।

উল্লেখ্য, ১৯৯৮ সালে মাঠপর্যায়ে স্বাস্থ্যসেবা ও পরিবার–পরিকল্পনা সেবা একীভূত করা হয়। কিন্তু ২০০১ সালে একটি অযাচিত সিদ্ধান্তের মাধ্যমে তা রহিত করে পূর্বের অবস্থায় ফেরানো হয়। পরবর্তী সময়ে ২০১৭ সালের ১৬ মার্চ ‘স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগ’ এবং ‘স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ’ নামে দুটি বিভাগে ভাগ করার মাধ্যমে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কেও বিভাজিত করে পুনরেকত্রীকরণের সুযোগের কফিনে শেষ পেরেক ঠুকে দেওয়া হয়।

তবে এ ক্ষেত্রেও সুযোগ এখনো শেষ হয়ে যায়নি। কার্যাবলি পুনর্বিন্যাসের মাধ্যমে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মতো এই দুটি বিভাগের একটিকে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা বিভাগে পরিণত করা যেতে পারে, যার অধীনে থাকবে গ্রাম। শহরের সব মানুষের জন্য পরিবার কল্যাণ এবং পুষ্টিসহ প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা থাকতে পারে।

এ ক্ষেত্রে মাঠপর্যায়ে স্বাস্থ্য, পুষ্টি এবং পরিবারকল্যাণ সেবা প্রতিষ্ঠানসমূহ একীভূত করে উপজেলা বা থানা পর্যায়ের প্রাথমিক স্বাস্থ্যব্যবস্থাকে পুনর্গঠন করতে হবে। অন্যটিকে মেডিকেল শিক্ষা এবং সেকেন্ডারি ও টারশিয়ারি সেবা বিভাগে পরিণত করা।

৩.

স্বাস্থ্য খাতে খামখেয়ালিপনার নতুন সংযোজন হলো উপযুক্ত প্রস্তুতি ছাড়া আগের দিন নোটিশ পাঠিয়ে কিছু সরকারি হাসপাতালে ইনস্টিটিউশনাল প্রাইভেট প্র্যাকটিস প্রচলন করা। ইনস্টিটিউশনাল প্র্যাকটিস চালুর শর্তগুলো হলো সংশ্লিষ্ট হাসপাতালে পর্যাপ্তসংখ্যক চিকিৎসক ও সহায়ক জনবলের উপস্থিতি নিশ্চিত করা এবং একই ক্লিনিক্যাল গ্রুপের একাধিক বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক কর্মরত থাকা এবং প্রয়োজনীয় ডায়াগনস্টিক টেস্টের ব্যবস্থা থাকা।

কিন্তু এই শর্তগুলো পূরণ ছাড়া ইনস্টিটিউশনাল প্র্যাকটিস চালুর ফলে এটির উদ্দেশ্য ব্যাহত হবে। তবে ফল যা–ই হোক, এ ব্যবস্থার কিছু উল্টো ফলের আশঙ্কা রয়েছে। যেমন এ ব্যবস্থা চালুর ফলে কর্মক্ষেত্রে নির্ধারিত কর্মঘণ্টায় চিকিৎসকদের উপস্থিতি কমতে পারে। তাই নির্ধারিত কর্মঘণ্টায় সেবা নিতে আসা রোগীরা মানসম্মত সেবা থেকে বঞ্চিত হতে পারেন। এটি সত্যি হলে মানুষ সরকারি হাসপাতালে সকালের তুলনায় বিকেলেই বেশি ভিড় করবে।

ফলে সামগ্রিকভাবে ব্যক্তিগত ব্যয় বাড়বে। তবে সবচেয়ে বড় প্রভাব পড়বে ডাক্তার-রোগীর সম্পর্কের ওপর। এমনিতেই আমাদের দেশে স্বাস্থ্যব্যবস্থার নানা সীমাবদ্ধতার কারণে ডাক্তার-রোগীর সম্পর্ক তলানিতে। এর একটি কারণ হলো প্রাইভেট প্র্যাকটিসে সরাসরি ফি গ্রহণ। চিকিৎসক যখন সরাসরি ফি গ্রহণ করেন, তাঁকে মানুষ শ্রদ্ধা করেন না। কারণ, মানুষ জানেন, তাঁকে টাকা দিয়ে কেনা যায়। তাই ডাক্তার-রোগীর আদর্শিক সম্পর্কটা শেষ পর্যন্ত ক্রেতা-বিক্রেতার সম্পর্ক হিসেবে দাঁড়ায়।

সরকারি হাসপাতালে বিকেলে ইনস্টিটিউশনাল প্র্যাকটিস অর্থাৎ নির্ধারিত ফির বিনিময়ে রোগী দেখার প্রচলন, তাই ডাক্তার-রোগীর সম্পর্কে আরও চিড় ধরালে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।

তাই সরকারকে একটি বিকল্প উপায় ভাবতে হতে পারে। তুরস্কের মতো সরকারি হাসপাতালে প্রত্যেক চিকিৎসক কর্তৃক একটি নির্দিষ্টসংখ্যক রোগী দেখা বা সার্জারি করা কিংবা সার্জারিসংক্রান্ত আনুষঙ্গিক কাজ করার পর অতিরিক্ত রোগী দেখা বা সার্জারি করার জন্য রোগীপ্রতি সংশ্লিষ্ট হাসপাতালের একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ সরকারি অর্থপ্রাপ্তির সুযোগ প্রচলন করা যেতে পারে।

এ ক্ষেত্রে নির্ধারিত কর্মঘণ্টায় সেবা নিতে আসা রোগী এবং নির্ধারিত কর্মঘণ্টার পর সেবা নিতে আসা রোগীদের সরকার কর্তৃক নির্ধারিত ফিতে একই মানের সেবাপ্রাপ্তি নিশ্চিত হবে। অন্যদিকে, চিকিৎসকেরাও অধিক আগ্রহী হবেন। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে সবাইকে সাশ্রয়ী মূল্যে মানসম্মত চিকিৎসা প্রদানে এই বিকল্প উপায়টিই বেশি কার্যকর হতে পারে।

  • ড. সৈয়দ আব্দুল হামিদ অধ্যাপক, স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়