নদী পার হতে হতে বাবুমশাই মাঝিকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘জোয়ার কেন আসে? চাঁদটা কেন বাড়ে কমে?’ প্রশ্নের উত্তর দিতে না পারা মাঝির জীবনের বারো আনাই মিছে, বাবুমশাই সেটি মাঝিকে বুঝিয়ে দিলেন। এরপর ঝড় উঠে নৌকা ডুবতে বসলে বাবুমশাইকে মাঝি জিজ্ঞেস করে, ‘সাঁতার জানো নাকি?’ বাবুমশাই মাথা দুলিয়ে ‘না’ বলতেই সুকুমার রায়ের কবিতার মাঝি শুনিয়ে দিল, ‘বাঁচলে শেষে আমার কথা হিসেব করো পিছে, তোমার দেখি জীবন খানা ষোলো আনাই মিছে!’
পদ্মার সেতুর কল্যাণে দক্ষিণ বাংলার অনেক জেলাতেই এখন দিনে গিয়ে দিনে ফিরে আসা যায়। সকাল প্রায় আটটার দিকে ঢাকা থেকে যে যাত্রা আমরা শুরু করেছিলাম, দুপুরবেলায় সে যাত্রার যাত্রীরা দাঁড়িয়ে রইলাম মোংলা নদীর মাঝির খেয়ায়। নদীর মাঝখানে গিয়ে আঙুল উঁচিয়ে মাঝিকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘এই পথে আর কত দূর গেলে সুন্দরবন?’ মুচকি হেসে একেবারে উল্টো দিকে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে মাঝি জবাব দিলেন, ‘সুন্দরবন সেদিকে না, সুন্দরবন ওই দিকে।’
আমাদের সবার হাতভর্তি বই। বিজ্ঞানের বই, গণিতের বই। এগুলো আমরা নিয়ে যাচ্ছিলাম বাগেরহাটের রামপাল উপজেলার, বলতে গেলে একেবারে মফস্বলের এক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, পেড়িখালী মডেল উচ্চবিদ্যালয়ে। সেখানে হচ্ছে স্টেম ফেস্ট। স্টেমের আওতায় যেহেতু বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, প্রকৌশল ও গণিতের বিষয়গুলো বিবেচিত হয়ে থাকে, সেহেতু এ ধরনের উৎসবে সাধারণত বিজ্ঞান মেলা, প্রোগ্রামিং, রোবট কিংবা প্রজেক্ট প্রদর্শনী হয়ে থাকে। সে কারণে আমাদের সঙ্গে বিজ্ঞান ও গণিতের বই।
স্কুলের গেটে যেতেই সেখানকার শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা আমাদের বরণ করে নিলেন। কাছাকাছি উপজেলা মোরেলগঞ্জের নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) কয়েক ঘণ্টার পথ পাড়ি দিয়ে এসেছেন পেড়িখালী স্কুলের স্টেম ফেস্ট দেখতে। তিনি নিজের উপজেলায় শিক্ষার্থীদের জন্য বেশ কিছু ল্যাব তৈরি করেছেন, ভাষাচর্চার জন্য তৈরি করেছেন ক্লাব। সীমিত বাজেটের মধ্যে কীভাবে আরও বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি ল্যাবে যুক্ত করা যায়, এখন সেটি নিয়ে চলছে পরিকল্পনা।
আশপাশের আরও ছয়টি স্কুলের শিক্ষার্থীরা এই প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে। রামপালের এক স্কুলে এসেও যে নির্দিষ্ট এক লাইন অনুসরণ করে চলতে থাকা স্মার্ট রোবট দেখতে পাব, সেটি আমার সুদূর কল্পনায়ও ছিল না।
বিজ্ঞান মেলায় গিয়ে দেখা গেল কীভাবে সূর্যের আলো ও তাপ ব্যবহার করে শক্তি তৈরি সম্ভব, তার প্রদর্শনী। আমি প্রশ্ন করলাম, ‘সূর্য না থাকলে এটি কীভাবে কাজ করবে?’ কিছুক্ষণ চিন্তা করে দলনেতা জবাব দিল, ‘মেঘের কারণে হয়তো সূর্য থেকে আলো আসবে না, কিন্তু সূর্য থাকবে না, সেটি তো কখনো হবে না, তাই না?’ মোংলা নদীর মাঝি জীবনের যত আনা বাকি রেখেছে, সেটি মিছে হওয়ার আগেই আমি পরবর্তী স্টলের দিকে এগিয়ে গেলাম।
শুধু মোটর ব্যবহার করে যে সেচের কাজ, চাকা ঘোরানোর কাজ, আলো জ্বালানোর কাজ, আরও কত-কী করা যায়, সেটি দেখাল একটি দল। জিজ্ঞাসা করলাম, ‘এই যন্ত্রপাতিগুলো কোথা থেকে পেয়েছ?’ নদী পার হয় গিয়ে কোন বাজার থেকে কিনে আনতে হবে, সেটি তারা আমাকে জানিয়ে দিল তারা।
পোস্টার প্রদর্শনীতে গিয়ে দেখি ‘বাল্যবিবাহ’ নামের পোস্টারে বড় বড় করে লেখা, ‘হতে চাই না বিয়ের পাত্রী, হতে চাই স্কুলছাত্রী’। বিচারকদের রায়ে ফলাফল তৈরির পর সবশেষে হলো পুরস্কার বিতরণ। পুরস্কার পেয়ে ছেলেমেয়েদের সে কী উচ্ছ্বাস! এতটুকু স্বীকৃতিই হতে পারে তাদের সামনে এগিয়ে যাওয়ার অনুপ্রেরণা।
এ ধরনের আয়োজনে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলোর ব্যাপক ভূমিকা রাখার সুযোগ আছে। প্রায় প্রতিটি জেলায় বা কয়েক জেলা পাশেই বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় আছে। সেখানকার বিভিন্ন বিভাগ, শিক্ষার্থী বা ক্লাবগুলোকে এসব উদ্যোগে যুক্ত হতে হবে। মালালা ফান্ডের পৃষ্ঠপোষকতায় পেড়িখালীর এই উৎসবের উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ ফ্রিডম ফাউন্ডেশন, সহায়তা দিয়েছে বাংলাদেশ ওপেনসোর্স নেটওয়ার্কের সঙ্গে যুক্ত স্বেচ্ছাসেবকেরা।
ফেরার পথে রামপালের ইউএনওর চায়ের আমন্ত্রণ রক্ষা করতে গিয়ে দেখলাম, তিনি ইতিমধ্যেই পরিকল্পনা করতে বসে গেছেন, কী করে গোটা উপজেলার সব স্কুলের জন্য প্রশিক্ষক তৈরি করবেন। প্রশিক্ষকদের প্রশিক্ষণ কীভাবে হবে, কোথায় হবে, সেটি নিয়েও চলছে আলোচনা। এই উদ্যমটুকুই আমাদের শক্তি।
আমাদের অনেক সীমাবদ্ধতা আছে। শহর-গ্রামের সুযোগ-সুবিধায় বৈষম্য আছে। কিন্তু তারপরও কি আমরা এগিয়ে চলছি না? কেউ কি কখনো ভেবেছিল বিশ্বের নানা দেশের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে আমাদের ছেলেমেয়েরা স্বর্ণপদক নিয়ে আসবে? তা-ও যেনতেন কোনো প্রতিযোগিতা নয়, মেধার প্রতিযোগিতা। এই তো কয়েক দিন আগে গ্রিসে অনুষ্ঠিত ২৫তম আন্তর্জাতিক রোবট অলিম্পিয়াডে ৩টি স্বর্ণসহ মোট ১৫টি পদক নিয়ে এসেছে বাংলাদেশের ছেলেমেয়েরা।
বিশ্ব জয় করে আসা এই ছেলেমেয়েদের অনুশীলনের আয়োজনটুকু তো আমাদেরই করে দিতে হবে। তাদের বিজ্ঞানের যন্ত্রপাতি তো আমাদেরই জোগাড় করে দিতে হবে। আমাদের ছেলেমেয়েরা যথেষ্ট মেধাবী, তাদের সে মেধা বিকাশের সুযোগটুকু যেন আমরা করে দিতে পারি। পেড়িখালীর এই আয়োজন ছড়িয়ে পড়ুক সমস্ত বাংলাদেশে, এগিয়ে আসুক বিভিন্ন সামাজিক–সাংস্কৃতিক সংগঠন।
ড. বি এম মইনুল হোসেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্যপ্রযুক্তি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ও পরিচালক
ই-মেইল: bmmainul@du.ac.bd