বলীখেলা ও বৈশাখী মেলা চট্টগ্রামের শতাব্দীপ্রাচীন সর্বজনীন এক লোক উৎসবের নাম। ‘বলী’র আভিধানিক অর্থ পরাক্রমশালী, বীরপুরুষ। বলীদের অতীতে অঞ্চলভেদে ‘মল্ল’ ও ‘মাল’ বলা হতো। এর আভিধানিক অর্থ কুস্তিগির,পালোয়ান। শক্তি, সাহস ও কৌশলই বলীদের কুস্তিতে জেতার প্রধান মন্ত্র।
ধারণা করা হয়, চট্টগ্রামে বলীখেলা আরবদের দ্বারাই প্রচলিত হয়েছে। আরব মুসলিমরা অষ্টম শতকেই চট্টগ্রামে আসা শুরু করে। তবে মুসলমানদের প্রথম চট্টগ্রাম বিজয় হয় চতুর্দশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে। সুলতানি ও মোগল আমলে মল্ল বা বলীখেলা সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পায়।
‘মল্ল’ শব্দটি দেশীয়, মল্লযুদ্ধে যাঁরা অংশ নিতেন, তাঁরা ‘মল্লবীর’ নামে খ্যাতি পেতেন। নিজেদের শক্তিমত্তা প্রদর্শনের জন্য সে সময় রাজা ও জমিদারেরা কুস্তিগির রাখতেন বেতনের বিনিময়ে। মল্লযুদ্ধই চট্টগ্রামে বলীখেলা নামে সমধিক পরিচিতি পায়।
এ ছাড়া মোগল আমলে বলীখেলা ব্যাপক জনপ্রিয় ছিল। তবে বলীখেলার স্বর্ণযুগ ছিল প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পর্যন্ত। সে সময় চট্টগ্রাম জেলার সর্বত্র চৈত্র থেকে বৈশাখ মাস পর্যন্ত বলীখেলার আয়োজন করা হতো। তখন এ অঞ্চলের অনেকেই ছিলেন ইয়াঙ্গুন তথা মিয়ানমারপ্রবাসী। তাঁদের বলা হতো ‘রেঙ্গুইন্যা’। তাঁরাই ছিলেন বলীখেলার প্রধান পৃষ্ঠপোষক।
পরবর্তীকালে রেঙ্গুইন্যাদের ছাড়াও প্রথিতযশা অনেক ব্যক্তি বলীখেলার সমঝদার ছিলেন। জানা যায়, ঢাকার নবাব আবদুল গনিও এই বলীখেলার পৃষ্ঠপোষক ছিলেন।
খ্যাতনামা গবেষক ও চট্টলবিদ আবদুল হক চৌধুরী ‘বন্দর শহর চট্টগ্রাম’ নামের বইতে লিখেছেন, ‘মল্লযুদ্ধে চট্টগ্রামের ঐতিহ্য সুপ্রাচীন কালের। চট্টগ্রামে মল্ল নামে খ্যাত বহু প্রাচীন পরিবার দেখা যায়।
চট্টগ্রামের ২২টি মল্ল পরিবার ইতিহাস–প্রসিদ্ধ। যেমন আশিয়া গ্রামের আমান শাহ মল্ল, চাতরি গ্রামের চিকন মল্ল, কাতারিয়া গ্রামের চান্দ মল্ল, জিরি গ্রামের ঈদ মল্ল ও নওয়াব মল্ল, পারি গ্রামের হরি মল্ল, পেরলা গ্রামের নানু মল্ল, পটিয়ার হিলাল মল্ল ও গোরাহিত মল্ল, হাইদগাঁওয়ের অলি মল্ল ও মোজাহিদ মল্ল, শোভনদণ্ডীর তোরপাচ মল্ল, কাঞ্চননগরের আদম মল্ল, ঈশ্বরখাইনের গনি মল্ল, সৈয়দপুরের কাসিম মল্ল, পোপাদিয়ার যুগী মল্ল, খিতাপচরের খিতাপ মল্ল, ইমামচরের ইমাম মল্ল, নাইখাইনের বোতাত মল্ল, মাহাতার এয়াছিন মল্ল, হুলাইনের হিম মল্ল, গৈরলার চুয়ান মল্ল।’
কবি আলাদিন আলীনুর বলীখেলার উদ্ভবের ইতিহাস বিবরণ দিয়েছেন ঠিক এভাবে, ‘প্রতিবছর চৈত্রের শেষার্ধে আর বৈশাখের প্রথমার্ধে আসে মাসব্যাপী বলীখেলার মৌসুম। সঙ্গে সঙ্গে বসে আনন্দ মেলা, নয়া নয়া পণ্যের হয় আমদানি, চলে হরদম বেচাকেনা। চারদিকে শুনি শুধু বাদ্যধ্বনি আর সানাইয়ের আওয়াজ। যখন শোনা যায় যে দক্ষিণ চট্টগ্রাম থেকে, অর্থাৎ ১৩৪৫-৪৬ সালে পরিব্রাজক ইবনে বতুতার পরিদর্শন ধন্য বরহনক থেকে আনক্যা বলীরা খেলায় যোগ দিতে আসছে, তখন দর্শকদের আগ্রহ ও উত্তেজনা বেড়ে যায়। কবি কালিদাসের জন্মভূমি পশ্চিম মালব, অর্থাৎ পটিয়ার মালিয়ারা থেকে এবং কবি আফজল আলীর জন্মভূমি পূর্ব মালব, অর্থাৎ সাতকানিয়ার মল্ল দেশ মিলুয়া থেকে প্রথম মল্লক্রীড়ার অনুষঙ্গ হিসেবে বলীখেলার উদ্ভব এবং পরে সমগ্র চট্টগ্রামে ব্যাপ্ত হয়।’ (‘চট্টগ্রামের সমাজ ও সংস্কৃতির রূপরেখা’: আবদুল হক চৌধুরী)
অন্যদিকে কথাসাহিত্যিক ও শিক্ষাবিদ আবুল ফজলের আত্মজীবনী ‘রেখাচিত্রে’ চট্টগ্রামের বলীখেলা ও মেলার একটি চিত্র দিয়েছেন এরূপ: তখন আমাদের দেশে বলী বা কুস্তিখেলা ছিল গ্রাম্য উৎসবের এক অপরিহার্য অঙ্গ। চৈত্র–বৈশাখ এলেই গ্রামে গ্রামে পড়ে যেত এক সাড়া। আজও চট্টগ্রামের জনজীবন থেকে কুস্তিখেলা নিশ্চিহ্ন হয়নি। তবে এখন কুস্তির চেয়ে মেলাটাই হয়ে উঠেছে বড়। ছোটকালে সমবয়সীদের সঙ্গে জুটে সাত–আট মাইল দূরের বলীখেলায়ও চলে যেতাম। একটু বড় হয়ে ওঠার পর দূর গ্রামেও চলে যেতাম যাত্রা কি কবির গান শুনতে। সারা রাত বিনিদ্র কাটিয়ে চোখ দুটো প্রায় জবা ফুল করে যখন বাড়ি ফিরতাম, তখন বেলা উঠে গেছে। মা বকবেন কি, ফিরে যে এসেছি, এতেই যেন তিনি হাতে আসমান পেয়ে যেতেন। চাঁদনি রাতে ছেলেরা ‘বদর’ দিয়ে উঠলে কিছুতেই ঘরে স্থির থাকতে পারতাম না, ফলে ছুটে এসে ভিড়ে পড়তাম। অনেক রাত পর্যন্ত দাঁড়িয়াবান্ধা কি হাডুডু খেলা আপাদমস্তক প্রায় ধূলি–ধূসরিত হয়ে ঘরে ফিরে এসে নীরবে মায়ের পাশে শুয়ে পড়তাম।
চট্টগ্রামের সামাজিক জীবনে বলীরা যে মানুষের সমীহ আদায় করে নিয়েছিলেন, তার একটি প্রমাণ বলীর নামে যত্রতত্র রাস্তাঘাট ও হাটবাজারে ছড়িয়ে আছে। বাকলিয়ায় একজন বিখ্যাত বলী ছিলেন ঊনবিংশ শতাব্দীতে, তার স্মৃতি বহন করে একটি হাট আজও টিকে আছে সেখানে। হালিশহরেও সল্টগোলায় বশর বলী নামের একজন প্রচণ্ড শক্তিধর বলী ছিলেন।
সেকালের বলীরা ছিলেন তাঁদের নিজ নিজ এলাকায় মানুষের শক্তি, সাহস ও পৌরুষের প্রতীক। তখন এক এলাকার সঙ্গে আরেক এলাকায় নানা ছুতানাতায় মারামারি লেগেই থাকত। তা থেকে দাঙ্গা–হাঙ্গামা পর্যন্ত হয়ে যেত। সেনাপতি হিসেবে নেতৃত্ব দিতেন তৎকালীন সময়ের বলীরা।
চট্টগ্রাম শহরের বদরপাতি মহল্লার সরের জাহাজের বিশিষ্ট ব্যবসায়ী গোলাম রসুল সওদাগরের পুত্র আবদুল জব্বার ছিলেন কংগ্রেসি এবং স্বদেশি আন্দোলনের সক্রিয় সংগঠক। আবদুল জব্বার সওদাগর ১৯০৯ সালের ১২ বৈশাখ নিজ নামে লালদিঘির মাঠে বলীখেলার প্রবর্তন করেন। সে কারণে লালদিঘির খেলা বা মেলার চাইতেও জব্বারের বলীখেলা হিসেবেই এটি লোকমুখে সমধিক প্রসিদ্ধ।
বলীখেলা প্রবর্তনের উদ্দেশ্য সম্পর্কে সবচেয়ে চালু ও অবিসংবাদী অভিমতটি হলো স্বদেশিয়ানায় উদ্বুদ্ধ হয়ে তিনি দৈহিক শক্তি প্রদর্শনের খেলাটি চালু করেছিলেন। তরুণ ও যুবকের মনে দেশপ্রেমের চেতনা সঞ্চার করাই ছিল তাঁর মূল লক্ষ্য। তখন চট্টগ্রামে গুপ্ত বৈপ্লবিক সংগঠন ও সমিতিগুলো গড়ে উঠেছিল। ক্লাব, ব্যায়ামের আখড়া, শরীরচর্চাকেন্দ্র ইত্যাদির আড়ালে নবজাগ্রত যুবসমাজ ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসক ও শোষণের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের সংকল্পে সংগঠিত হচ্ছিল। তিনি চেয়েছিলেন, যুবকেরা সাহসী হয়ে উঠুক, শক্তি সঞ্চয় করুক এবং যেদিন দেশের ডাক আসবে, সেদিন যাতে ভয়ে দেশের জন্য জীবন বিলিয়ে দিতে তাঁদের পিছিয়ে আসতে না হয়।
আবদুল জব্বার সওদাগর যে উদ্দেশ্যেই বলীখেলাটি চালু করে থাকুন না কেন, এটি এখন চট্টগ্রাম বৃহত্তম বার্ষিক লোক উৎসব। চট্টগ্রাম কেন বাংলাদেশেও বোধ করি, এত বড় খেলা ও মেলা দ্বিতীয়টি নেই।
আবদুল জব্বার সওদাগরের স্মৃতি আজও সগৌরবে টিকে আছে এই খেলা ও মেলার মধ্য দিয়ে। শতবর্ষের পরও এই বলীখেলার খ্যাতি ও গুরুত্ব দেশ ছেড়ে ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্বব্যাপী। প্রতিবছর বৈশাখ মাসের ১২ তারিখ বলীখেলা হয়।
বলীখেলা দিয়ে শুরু হলেও পরে চট্টগ্রামের লোকশিল্প ও কৃষিজ পণ্যসামগ্রীর প্রদর্শন ও বেচাকেনাও এর সঙ্গে যুক্ত হয়ে গেলে এটি জব্বারের বলীখেলা ও বৈশাখী মেলা হিসেবে পরিচিতি হয়ে ওঠে। যতই দিন যেতে থাকে, ততই বাড়তে থাকে মেলার পরিসর। নগরের আন্দরকিল্লা, বক্সিরহাট, লালদিঘি পাড়, কেসিদে রোড, সিনেমা প্যালেস, শহীদ মিনার সড়ক, কোতোয়ালি মোড়, জেল রোডসহ প্রায় তিন কিলোমিটার জুড়ে এ মেলার বিস্তৃতি ঘটে।
বলীখেলা ও মেলায় সারা দেশ থেকে রকমারি পণ্যের পসরা নিয়ে হাজির হয় মৃৎশিল্পী, বাঁশ-বেতশিল্পী, কামার-কুমার, কাঠমিস্ত্রি, আসবাব নির্মাতারা। কী থাকে না লালদিঘির মেলায়! জীবনের, সংসারের এমন কোনো প্রয়োজনীয় বস্তু নেই, যা লালদিঘির মেলায় পাওয়া যায় না। আধুনিক, শিক্ষিত গৃহবধূ পর্যন্ত সারা বছর অপেক্ষা করে থাকেন লালদিঘির মেলার জন্য। এ মেলা থেকেই তাঁরা সংগ্রহ করেন সংসারের অতিপ্রয়োজনীয় সব জিনিস—ডালা, কুলা, পিঁড়ি, মাথাল, দা, ছুরি, বঁটি, পাটা, ঝাড়ু, হাতপাখা, বাঁশ ও বেতের তৈরি নানা আসবাব। পরিবারের নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রী কেনার জন্য খুব ভোরে ভিড় করেন নারীরা। এ ছাড়া মেলার একটা বিশাল অংশজুড়ে থাকে নার্সারি, বনসাই গাছের প্রদর্শনী।
লালদিঘির মেলায় যাঁরা জীবনে একবার গেছেন, তাঁদের স্মৃতিতে চিরদিন উজ্জ্বল হয়ে গাঁথা থাকে এই লোকায়ত মেলার রঙিন ক্যানভাস।
উল্লেখ্য, করোনা মহামারির কারণে দুই বছর বলীখেলা ও মেলার আয়োজন হয়নি। এর আগে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় দুই বছর বলীখেলা হয়নি।
২৪ থেকে ২৬ এপ্রিল তিন দিনব্যাপী বৈশাখী মেলা অনুষ্ঠিত হচ্ছে। গতকাল ২৫ এপ্রিল অনুষ্ঠিত হয়েছে এবারের বলীখেলা। এবারের ছিল বলীখেলার ১১৫তম আসর।
গাজী মোহাম্মদ নুরউদ্দিন ডেপুটি রেজিস্ট্রার, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগার