যুক্তরাষ্ট্র প্রথমবারের মতো গাজায় যুদ্ধবিরতি প্রস্তাবটির বিপক্ষে ভোট না দিয়ে ভোটদানে বিরত থাকে।
যুক্তরাষ্ট্র প্রথমবারের মতো গাজায় যুদ্ধবিরতি  প্রস্তাবটির বিপক্ষে ভোট না দিয়ে ভোটদানে বিরত থাকে।

মতামত

জাতিসংঘের মৃত্যু

তারিখটা ক্যালেন্ডারে দাগ দিয়ে রাখার মতো—২৫ মার্চ ২০২৪।

এদিন জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ গাজায় যুদ্ধবিরতি দাবি করে ২৭২৮ নম্বর প্রস্তাব গ্রহণ করে। নিরাপত্তা পরিষদের মোট ১৫ সদস্যের ১৪ জন প্রস্তাবটির পক্ষে ভোট দেয়। যুক্তরাষ্ট্র ইতিপূর্বে একাধিক যুদ্ধবিরতি প্রস্তাবে ভেটো প্রয়োগ করলেও এদিন প্রথমবারের মতো প্রস্তাবটির বিপক্ষে ভোট না দিয়ে ভোটদানে বিরত থাকে। ফলে দীর্ঘ ছয় মাস পর গাজায় যুদ্ধবিরতি দাবি সমর্থন করে একটি প্রস্তাব গৃহীত হয়।

প্রস্তাবটি গৃহীত হওয়ার পরপরই পরিষদ কক্ষে স্বতঃস্ফূর্ত করতালি দিয়ে তাকে স্বাগত জানায় বিশ্বসভা। কিন্তু সেই করতালির শব্দ মিইয়ে যাওয়ার আগেই যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে জানানো হলো, যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব গৃহীত হলেও সেই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন বাধ্যতামূলক নয়। এই প্রস্তাবে এমন কিছুই বলা হয়নি, যার কারণে ইসরায়েলকে অবিলম্বে যুদ্ধবিরতি কার্যকর করতে হবে।

নিরাপত্তা পরিষদ জাতিসংঘের সর্বোচ্চ আইন প্রণয়নকারী অঙ্গ। এর প্রধান কাজ আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। এই সংস্থার অন্য প্রধান অঙ্গ সাধারণ পরিষদ, সেও শান্তি, নিরাপত্তাসহ নানা বিষয়ে প্রস্তাব গ্রহণ করে থাকে। কিন্তু সেই প্রস্তাবগুলো সদস্যরাষ্ট্রগুলোর প্রতি নির্দেশিত সুপারিশ বা পরামর্শমাত্র, তার বাস্তবায়ন বাধ্যতামূলক নয়। পক্ষান্তরে নিরাপত্তা পরিষদের প্রস্তাবের বাস্তবায়ন বাধ্যতামূলক। এই প্রস্তাব যাতে বাস্তবায়িত হয়, সে জন্য কোন সদস্যরাষ্ট্রকে বাধ্য করার জন্য একাধিক শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের সুযোগ রয়েছে।

জাতিসংঘ সনদের সপ্তম অধ্যায়ে নির্দেশিত বিধিব্যবস্থা অনুসারে অর্থনৈতিক, কূটনৈতিক ও সামরিক নিষেধাজ্ঞা আরোপের সুযোগ রয়েছে। এমনকি সরাসরি সামরিক ব্যবস্থা গ্রহণও এই বিধিব্যবস্থার অন্তর্গত। এসব ব্যবস্থা ‘চ্যাপটার সেভেন’ সিদ্ধান্ত নামে পরিচিত।

যুক্তরাষ্ট্রের বক্তব্য, গাজায় অবিলম্বে যুদ্ধবিরতি প্রস্তাব গৃহীত হলেও এই সিদ্ধান্ত ‘চ্যাপটার সেভেন’ ধারাভুক্ত নয়। এখানে কোথাও স্পষ্টভাবে কোনো নিষেধাজ্ঞা বা সামরিক ব্যবস্থার কথা বলা হয়নি। এখানে ‘পরিষদ দাবি করছে’ (দ্য কাউন্সিল ডিমান্ডস) বা পরিষদ এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে (দ্য কাউন্সিল ডিসাইডস) বলা হলেও কোথাও চ্যাপটার সেভেনের ধারাভুক্ত হওয়ার কথা উল্লেখিত হয়নি।

মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র ম্যাথু মিলার বিষয়টি এভাবে ব্যাখ্যা করেন, ‘আমরা যখন বলি, প্রস্তাবটির বাস্তবায়ন বাধ্যতামূলক নয়, তার মানে এখানে কোথাও সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্র, ব্যক্তি বা সংস্থার ওপর কোনো সুনির্দিষ্ট দায়িত্ব আরোপিত হয়নি, যেভাবে অন্য অনেক প্রস্তাবে ঠিক (শাস্তিমূলক) কী ব্যবস্থা নিতে হবে, তার উল্লেখ থাকে।’

এ কথা ঠিক, সপ্তম অধ্যায়ের অধীনে গৃহীত সিদ্ধান্তে সদস্যরাষ্ট্রগুলোকে সুনির্দিষ্ট ব্যবস্থা গ্রহণের কথা বলা হয়ে থাকে। যেমন লিবিয়ায় যুদ্ধাবস্থা বন্ধের দাবিতে গৃহীত ১৯৭৩ নম্বর সিদ্ধান্তের শুরুতেই বলা হচ্ছে, পরিষদ সদস্যরাষ্ট্রগুলোকে শান্তি ও নিরাপত্তা রক্ষায় ব্যবস্থা গ্রহণে অনুমতি দিচ্ছে (‘অথরাইজেস’)। একইভাবে ২০২৩ সালে হাইতির গৃহযুদ্ধ ঠেকাতে সেখানে একটি বহুজাতিক শান্তিরক্ষী বাহিনী গঠনের প্রস্তাব অনুমোদন করে নিরাপত্তা পরিষদ যে ২৬৯৯ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে, তাতেও শান্তিরক্ষী বাহিনীতে অংশগ্রহণসহ অন্য কী কী ব্যবস্থা নেওয়া যাবে, নিরাপত্তা পরিষদ তা বেশ সবিস্তারেই উল্লেখ করে।

বস্তুত, এই তথাকথিত নিয়মভিত্তিক বিশ্বব্যবস্থা যুক্তরাষ্ট্রের কাছে প্রয়োজনে ব্যবহার্য একটি হাতিয়ার মাত্র। যে নিয়ম বা আইন তার কাজে লাগবে তাকে ব্যবহার করা হবে, না লাগলে ছুড়ে ফেলা হবে। ইরানের আণবিক কর্মসূচি ঠেকাতে নিরাপত্তা পরিষদের মাধ্যমে সে কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়, যুক্তরাষ্ট্র তা লুফে নেয়।

সমস্যা হলো, যুক্তরাষ্ট্র যে অজুহাতে নিরাপত্তা পরিষদের ২৭২৮ নম্বর সিদ্ধান্ত বাধ্যতামূলক নয় বলে সাফাই দিচ্ছে, তা ভাষার মারপ্যাঁচমাত্র। বিশ্বসভা কী চায়, কী তার লক্ষ্য, এই প্রস্তাবের ভাষায় তা না বোঝার মতো কিছু নেই। এখনই যুদ্ধ বন্ধ করে, পরিষদ ইসরায়েলকে এই কথাই বলছে, তা তার ভাষা যত নমনীয় বা কূটনৈতিক সুলভ হোক না কেন।

বস্তুত নিরাপত্তা পরিষদের যেকোনো সিদ্ধান্তমূলক প্রস্তাব সব সদস্যরাষ্ট্রের জন্যই অবশ্যপালনীয়। এই প্রশ্নে আন্তর্জাতিক আদালত (ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অব জাস্টিস) কোনো রাখঢাক ছাড়াই তার মতামত জানিয়েছে। ১৯৬৬ সালে নামিবিয়ায় দক্ষিণ আফ্রিকার অধিগ্রহণ অবৈধ ঘোষণা করে আন্তর্জাতিক আদালত তার রায়ে জানিয়েছিল, নিরাপত্তা পরিষদের সিদ্ধান্ত শুধু যে সপ্তম অধ্যায়ভিত্তিক হতে হবে তা নয়, পরিষদের সব সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নই সদস্যরাষ্ট্রের জন্য বাধ্যতামূলক।

অন্য কথায়, বিশ্ব আদালতের সে রায় অনুসারে, গাজার যুদ্ধবিরতি প্রশ্নে ২৭২৮ নম্বর সিদ্ধান্তে নিরাপত্তা পরিষদ স্পষ্টভাবেই বলেছে, অবিলম্বে যুদ্ধবিরতি কার্যকর করা হোক। বিষয়টির গুরুত্ব বোঝাতে পরিষদ ‘ডিমান্ডস’ কথাটি ব্যবহার করেছে। ফলে এটি যে অবশ্যপালনীয়, তা না বোঝার কোনো অবকাশ নেই।

যুক্তরাষ্ট্রের আলাবামা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনবিষয়ক অধ্যাপক ড্যান জয়নার লিখেছেন, সপ্তম অধ্যায়ের অধীনে হোক বা না হোক, নিরাপত্তা পরিষদ যখন বলে, সে দাবি করছে অথবা সে এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করছে, তখন সে সিদ্ধান্ত অবশ্যই পালনীয়। ইতিপূর্বে ইরানের আণবিক কর্মসূচি বন্ধের দাবি-সংবলিত যে সিদ্ধান্তগুলো নিরাপত্তা পরিষদ গ্রহণ করে, তাতে ইরানকে আণবিক কর্মসূচি বন্ধের দাবি জানানো হয়েছিল। সে সিদ্ধান্ত বাধ্যতামূলক নয়, এমন কথা কেউ বলেনি, বরং উল্টোটাই বলেছিল।

নিরাপত্তা পরিষদের সর্বসম্মত প্রস্তাব মেনে চলা যদি বাধ্যতামূলক না হয়, তাহলে এমন প্রস্তাবের কী মূল্য? এমন নিরাপত্তা পরিষদেরই-বা কী দরকার? ২৬ মার্চ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সংবাদ সম্মেলনে একজন সাংবাদিক ঠিক এই প্রশ্নই করেছিলেন ম্যাথু মিলারকে। তাঁর জবাব ছিল, ‘আমরা চাই, জাতিসংঘ আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা প্রশ্নে তার মতামত প্রকাশ করুক। কারণ, সেটা গুরুত্বপূর্ণ। আর সে কারণেই (অর্থাৎ নিরাপত্তা পরিষদে প্রস্তাব গ্রহণ) প্রক্রিয়ার সঙ্গে আমরা জড়িত ছিলাম।…তবে শেষ পর্যন্ত গাজায় যুদ্ধবিরতি ও জিম্মিদের মুক্তির ব্যাপারটি জাতিসংঘের মাধ্যমে নয়, এর বাইরে (দোহায় যে কূটনৈতিক আলাপ-আলোচনা চলছে) তার মাধ্যমেই অর্জিত হবে।

ম্যাথু মিলার বলতে চান বা না চান, তাঁর উত্তর থেকে স্পষ্ট, জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে বা অন্য কোনো ফোরামে যে আলোচনাই হোক না কেন, সেটা একটা লোকদেখানো ব্যাপারমাত্র। আসল যে সিদ্ধান্ত, তা আসবে মার্কিন তত্ত্বাবধানে, জাতিসংঘের বাইরে দ্বিপক্ষীয় বা বহুপক্ষীয় ভাবে। নিরাপত্তা পরিষদের যে প্রক্রিয়া, তার ওপর যুক্তরাষ্ট্রের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই, সেখানে রাশিয়া বা চীন তার বিপক্ষে ভেটো প্রয়োগ সক্ষম। অতএব এই পরিষদ এড়িয়ে নিজের পছন্দমতো ব্যবস্থা গ্রহণই ভালো।
তাহলে সেই সাংবাদিকের ভাষা ধার করে আমরা প্রশ্ন করতে পারি, জাতিসংঘ দিয়ে তাহলে কি কচু হবে?

দ্বিতীয় মহাযুদ্ধোত্তর যে আন্তর্জাতিক ব্যবস্থা, তার প্রধান স্থপতি যুক্তরাষ্ট্র। আমরা প্রায়ই ওয়াশিংটনের কাছ থেকে যুদ্ধোত্তর সময়ে প্রতিষ্ঠিত নিয়মভিত্তিক বিশ্বব্যবস্থার (রুল-বেজড ওয়ার্ল্ড অর্ডার) দোহাই শুনে থাকি। এই ব্যবস্থার কেন্দ্রে রয়েছে জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানের স্বাক্ষরিত প্রায় সাড়ে পাঁচ শ বহুপক্ষীয় চুক্তি।

মানবাধিকার, গণতন্ত্র ও অলঙ্ঘনীয় জাতীয় সার্বভৌমত্ব—তিনটি হলো নিয়মভিত্তিক বিশ্বব্যবস্থার প্রধান স্তম্ভ। আন্তর্জাতিক আইনের ভিত্তিতে গঠিত হলেও যুক্তরাষ্ট্র এই ব্যবস্থাকে আইনভিত্তিক ব্যবস্থা বলে না, তার কারণ সে নিজেই একাধিক আন্তর্জাতিক আইনের স্বাক্ষরকারী নয়। যেমন আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত। নারীর বিরুদ্ধে বৈষম্য বা উদ্বাস্তু চুক্তিকেও যুক্তরাষ্ট্র স্বীকৃতি দেয় না।

বস্তুত, এই তথাকথিত নিয়মভিত্তিক বিশ্বব্যবস্থা যুক্তরাষ্ট্রের কাছে প্রয়োজনে ব্যবহার্য একটি হাতিয়ার মাত্র। যে নিয়ম বা আইন তার কাজে লাগবে তাকে ব্যবহার করা হবে, না লাগলে ছুড়ে ফেলা হবে। ইরানের আণবিক কর্মসূচি ঠেকাতে নিরাপত্তা পরিষদের মাধ্যমে সে কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়, যুক্তরাষ্ট্র তা লুফে নেয়। কিন্তু জাতিসংঘ যখন পূর্ব জেরুজালেমকে ইসরায়েলের রাজধানী ঘোষণাকে আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন বলে, যুক্তরাষ্ট্র তা কানে না তুলে সেখানে নিজের রাজধানী সরিয়ে আনে। একইভাবে কিউবায় মার্কিন অবরোধের বিরুদ্ধে অসংখ্য প্রস্তাব নেওয়া হলেও সেসবের কোনোটাই যুক্তরাষ্ট্র হিসাবে আনার প্রয়োজন দেখেনি।

আলাবামা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক স্টেফান ওয়াল্টের কথায়, বিশ্বব্যবস্থা, তা তাকে যে নামেই ডাকা হোক, আসলে এমন এক ব্যবস্থা যেখানে যুক্তরাষ্ট্র যেকোনো আইন বা সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করতে পারে, এড়িয়ে যেতে পারে, বা নিজের ইচ্ছামতো নতুন করে লিখতেও পারে।

২৫ মার্চ নিরাপত্তা পরিষদের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন বাধ্যতামূলক নয় বলে যে বিধান হোয়াইট হাউস দিয়েছে, তা আমাদের পরিচিত বিশ্বব্যবস্থা ‘উপেক্ষা করা, এড়িয়ে যাওয়া ও নিজের খুশিমতো নতুন করে লেখা’র সর্বশেষ উদাহরণ। এই খেয়ালখুশির একটি বলি হলো জাতিসংঘ। যে বিশ্বব্যবস্থা তৈরির পেছনে প্রধান ভূমিকা রেখেছিল যুক্তরাষ্ট্র, (অর্থাৎ নিরাপত্তা পরিষদে প্রস্তাব গ্রহণ) তার হাতে নির্মিত হচ্ছে এই ব্যবস্থার শবাধার।

  • ১১ এপ্রিল ২০২৪
    নিউইয়র্ক
    হাসান ফেরদৌস প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক