রাজধানীর ধানমন্ডির গাউসিয়া টুইন পিক ভবনের ছাদে থাকা একটি রেস্তোরাঁ গুঁড়িয়ে দেয় রাজউক
রাজধানীর ধানমন্ডির গাউসিয়া টুইন পিক ভবনের ছাদে থাকা একটি রেস্তোরাঁ গুঁড়িয়ে দেয় রাজউক

মতামত

রেস্তোরাঁয় অভিযান: পদক্ষেপের বাড়াবাড়ি সমস্যার সমাধান দেবে কি

রাজধানীর বেইলি রোডে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে ৪৬ জনের প্রাণহানিতে গোটা জাতি মর্মাহত। সবাই চায় এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধ এবং দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা।

এ ধরনের ঘটনা অভিনব বা আকস্মিক নয়। মাঝেমধ্যেই ঘটে চলেছে। বরাবরই এর পরপর ঘনঘটা করে গঠিত হয় তদন্ত কমিটি। কিন্তু কোনো ক্ষেত্রে দায়দায়িত্ব নির্ধারণ করে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে—এমনটি আমরা শুনিনি।

ভবন নির্মাণকালে অগ্নিদুর্ঘটনা প্রতিরোধে যথাযথ ব্যবস্থা না নেওয়া কিংবা সে ভবনে বিভিন্ন ধরনের কার্যক্রম পরিচালনায় দায়িত্বজ্ঞানহীন আচরণ এ ধরনের দুর্ঘটনার প্রধান কারণ হওয়ারই কথা। সুতরাং এর সঙ্গে যাঁরা প্রত্যক্ষভাবে দায়ী, তাঁদের আইনের আওতায় নিয়ে আসাই যৌক্তিক। এমনটা করতে পারলে এসব ঘটনার পুনরাবৃত্তি কমে যাবে, এটা বলার অপেক্ষা রাখে না। কিন্তু এ ধরনের ঘটনার কোনো ক্ষেত্রেই এমনটা করা গেছে বলে জানা যায়নি। তারপরও থাকছে নেপথ্যের লোকদেরও দায়দায়িত্বের বিষয়টি।

সাধারণত এ ধরনের ভয়াবহ ঘটনা জনবহুল আবাসিক, বাণিজ্যিক বা শিল্পাঞ্চলে ঘটে থাকে। এসব ইমারত নির্মাণে বা ব্যবসাসহ যেকোনো কার্যক্রম পরিচালনায় অনেক প্রতিষ্ঠান বা সংস্থার অনুমোদন আবশ্যক হয়। যাঁরা অনুমোদন দেন, তাঁদের এর যথাযথ বাস্তবায়ন ও তদারক করার কথা।

যেমন বেইলি রোডের যে ভবনে নকশার বিচ্যুতি ঘটিয়ে এর সিঁড়ির অনুমোদিত প্রস্থ দুই–তৃতীয়াংশ কমিয়ে ফেলা হয়, এর নির্মাণকাজ তদারক করার দায়িত্ব ছিল ভবন নির্মাণ অনুমোদন প্রদান করা সংস্থাটির।

তেমনি এখানে রেস্তোরাঁ পরিচালনার জন্য একাধিক সংস্থার অনুমোদনের আবশ্যকতা রয়েছে। কিছু কিছু তা দিয়েছেও। যাঁরা দিয়েছেন, তাঁদেরও দেখার কথা ছিল এখানে এমনটি দেওয়া সঠিক হচ্ছে কি না। আর সেসব রেস্তোরাঁ যথাযথভাবে পরিচালিত হচ্ছে কি না, এটাও দেখার কথা ছিল তাঁদেরই। তদুপরি অগ্নিনিরাপত্তাবিষয়ক সংস্থাটি তিনবার সতর্কতামূলক চিঠি দিয়েই দায়িত্ব শেষ করেছে। আগুনের ঝুঁকিপূর্ণ নির্মাণ বা রেস্তোরাঁ পরিচালনার জন্য দেয়নি কোনো মামলা বা উদ্যোগ নেওয়া হয়নি এগুলো বন্ধ করার।

এ থেকে ধরে নিতে হবে, সরকারের বহু সংস্থা বা প্রতিষ্ঠান রয়েছে এসবের দায়িত্বে। তারা কোনো না কোনো কারণে এ ধরনের স্থাপনা নির্মাণ কিংবা কার্যক্রম পরিচালনায় যথেষ্ট ঝুঁকি থাকা সত্ত্বেও কোনো কার্যক্রমে বাধা দেয়নি।

প্রথম আলোর অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে লিখেছে, ভবনের অনিয়ম চাপা পড়ে কর্মকর্তাদের ‘খুশি’ করলে। এ ধরনের ‘খুশি’ করেই এ দেশে শিল্প, ব্যবসা এমনকি আবাসিক ভবন ব্যবস্থাপনার বিষয়টি এখন রাজধানীসহ দেশের প্রায় সর্বত্র অনেকাংশে স্বাভাবিক হয়ে গেছে। একাকার হয়ে গেছে আবাসিক, প্রাতিষ্ঠানিক বা বাণিজ্যিক সব এলাকাই।

সে ক্ষেত্রে এসব দুর্ঘটনার দায়দায়িত্ব তাদের ওপর অবশ্যই আসবে। তাদের কেউবা হবেন ফৌজদারি মামলার সহযোগী আসামি আর অন্যদের বিরুদ্ধে রুজু হওয়ার কথা বিভাগীয় মামলা। সে জবাবদিহি যে পর্যন্ত নিশ্চিত করা যাবে না, তত দিন একইভাবে চলতে থাকবে লোভী ভবনমালিক কিংবা ব্যবসায়ীদের কার্যক্রম।

এর পুনরাবৃত্তি রোধে রাজধানীতে ঝুঁকিপূর্ণ বা বেআইনি রেস্তোরাঁ খুঁজে বের করার জন্য অভিযান চলমান। পরিচালনা করছে রাজউক, সিটি করপোরেশনসহ একাধিক আইন প্রয়োগকারী সংস্থা। তাদের অভিযানকালে বন্ধ করা হয়েছে কিছু রেস্তোরাঁ। করা হয়েছে জরিমানা কিংবা গ্রেপ্তার। কাউকে দেওয়া হয়েছে সংশোধনের সময়াবদ্ধ সুযোগ। আপাতদৃষ্টে এ ধরনের অভিযানকে স্বাগত জানানোরই কথা। তবে হয়রানির অভিযোগ করছে রেস্তোরাঁ মালিক সমিতি। তাদের কর্মকর্তারা বলছেন, এতে একটা ভীতির ভাব সৃষ্টি হয়েছে।

কিছু মালিক বা কর্মচারী পালিয়েছেন ব্যবসা ছেড়ে। অনেক ক্ষেত্রেই সমাগম কমেছে ক্রেতার। তবে এক দৃষ্টিতে অভিযানটিকে অসমন্বিত, পরিকল্পনাহীন এবং ক্ষেত্রবিশেষে বাড়াবাড়ি বলে উল্লেখ করছে কোনো কোনো গণমাধ্যম।

প্রথম আলোর অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে লিখেছে, ভবনের অনিয়ম চাপা পড়ে কর্মকর্তাদের ‘খুশি’ করলে। এ ধরনের ‘খুশি’ করেই এ দেশে শিল্প, ব্যবসা এমনকি আবাসিক ভবন ব্যবস্থাপনার বিষয়টি এখন রাজধানীসহ দেশের প্রায় সর্বত্র অনেকাংশে স্বাভাবিক হয়ে গেছে। একাকার হয়ে গেছে আবাসিক, প্রাতিষ্ঠানিক বা বাণিজ্যিক সব এলাকাই।

বেইলি রোড ঘটনার পর রাজধানীর চলমান অভিযানে মূল উদ্দেশ্যের সঙ্গে কারও ভিন্নমত থাকতে পারে না। জনগণের জানমালের নিরাপত্তা বিধানের জন্য এ ধরনের ঝুঁকিপূর্ণ রেস্তোরাঁসহ সব স্থাপনাই অপসারণ কিংবা সংশোধনের জন্য কার্যক্রম নেওয়া যৌক্তিক। তবে রেস্তোরাঁ মালিক সমিতি হয়রানির যে অভিযোগ করছে, সেটাও বিবেচনায় রাখা দরকার।

এ ধরনের অভিযান পরিকল্পিত ও সুনিয়ন্ত্রিত হলে অভিযোগ আসার কথা নয়। আর ন্যায়নিষ্ঠ ও দৃঢ় কার্যক্রম কারও পছন্দ না হলেও তা চলমান থাকবে, এ বিষয়ে ভিন্নমত নেই। তবে যেভাবে অভিযানটি চলছে, তাকে বাড়াবাড়ি বলে কেউ মন্তব্য করলেও দোষ দেওয়া যাবে না।

সমালোচকেরা বলছেন, এগুলো লোকদেখানো, মানুষের ক্ষোভ সামাল দেওয়ার কৌশল এবং নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর দায় ধামাচাপা দেওয়ার একটি তৎপরতা। অতীত ব্যবস্থাদি পর্যালোচনা করলে এসব বক্তব্য অসত্যও বলা যাবে না। উল্লেখ করতে হয়, একটি ইংরেজি দৈনিকের প্রতিবেদন অনুসারে, রাজধানীতেই ছোট-বড় মিলিয়ে ২৫ হাজার এবং সারা দেশে ৪ লাখ ৮০ হাজার রেস্তোরাঁ রয়েছে। এতে কমবেশি ৩০ লাখ লোক কর্মরত।

ইংরেজি দৈনিকটির মতে, এসব তথ্য রেস্তোরাঁ মালিক সমিতি পরিবেশন করেছে। তবে বেশ কিছু রেস্তোরাঁয় নিম্নমানের অস্বাস্থ্যকর খাবার পরিবেশন ও ঝুঁকিপূর্ণ স্থাপনার অভিযোগটির মতো এগুলোকে বিবেচনায় রাখার প্রয়োজন রয়েছে। রেস্তোরাঁগুলো জনবান্ধব করে গড়ে তোলার আবশ্যকতা নিয়ে কোনো বিতর্ক থাকতে পারে না। তবে বিবেচনা করতে হবে এগুলো এক দিনে গড়ে ওঠেনি।

আমাদের চোখের সামনে নগরায়ণের আবশ্যিক চাহিদার সঙ্গেই এগুলোর বিকাশ ঘটে। এর একটি অংশের মধ্যে অভিযোগ করার মতন যৌক্তিক কারণ রয়েছে। তবে এগুলো দূরীভূত করা বা সংশোধনের জন্য এ ধরনের সাঁড়াশি অভিযানের যৌক্তিকতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে থাকবে।

পবিত্র রমজান ও ঈদ সামনে রেখে বিষয়টি আরও গুরুত্বের সঙ্গে নেওয়ার দাবি রাখে। যে বা যাঁরা এগুলোর অনুমোদন দেন, তাঁরা অনিয়ম দেখলে যেকোনো সময় সে রেস্তোরাঁ পরিচালনা বন্ধ করা বা সংশোধনের জন্য চাপ দেওয়া আদৌ অযৌক্তিক নয়। তবে করতে গিয়ে জনগণের চাহিদা, কর্মসংস্থানের একটি বিশাল ক্ষেত্র ও অর্থনীতিতে বিপরীত ধারা সৃষ্টি হচ্ছে কি না, এমনটিও বিবেচনায় নিতে হবে।

সে ক্ষেত্রে বর্তমানের প্রধান লক্ষ্য রাজধানীর রেস্তোরাঁগুলোকে আইনি বিধিমালা অনুশীলনে নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোকে দৃঢ় ও সুশৃঙ্খল ব্যবস্থা নিতে হবে। বাস্তবতাকে উপেক্ষা করে কোনো সুফল মিলবে না। বাস্তবতা হচ্ছে, এগুলোর অনুমোদন যাঁরা দিয়েছেন, তাঁদের আইন ভঙ্গকারী মালিকদের সঙ্গে সক্রিয় সহযোগিতা কিংবা দুঃখজনক নীরবতা। ফলে পরিস্থিতি অনেকটাই নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে।

জনগণের জানমাল হুমকির মুখে। অবস্থা থেকে পরিত্রাণের পথ অবশ্যই খুঁজে নিতে হবে। এর জন্য প্রয়োজন রয়েছে সমন্বিত কিংবা বিলম্বিত নয় এমন পদক্ষেপের। অত্যধিক ঝুঁকিপূর্ণ ও অনুমোদনহীন রেস্তোরাঁ বন্ধ করার প্রয়োজন রয়েছে। পাশাপাশি তুলনামূলক কম ঝুঁকিপূর্ণগুলোকে একটি নির্দিষ্ট সময় দিয়ে সংশোধনের সুযোগ দেওয়া যায়। চলমান অভিযানকালে দ্রুত এসব বিষয়ে সমন্বিত ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব ও সমীচীন।

এখানে রবীন্দ্রনাথের ‘জুতা আবিষ্কার’ কবিতার মতো রাজ্যের ধুলা দূর করতে সাড়ে ১৭ লাখ ঝাঁটা দিয়ে ধরণি ধূলিময় করা কিংবা সব জলাশয় থেকে পানি তুলে সেগুলোয় বসবাসকারী জীবের জীবন বিপন্ন করে কর্দমাক্ত করার প্রয়োজন নেই। সেই চর্মকারের মতোই ধীর ও দৃঢ় লয়ে কাজ করলেই সমস্যার সমাধান অনেকটা হয়ে যাবে।

● আলী ইমাম মজুমদার সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব

majumderali1950@gmail.com