বাঁশের ঝুড়িটা বড্ড ছোট। দুটি বেগুনচারা, একটি কাঁটা মুকুট, আনার, মরিচ, থাই স্যুপ, পামট্রি আর অ্যালোভেরা—ঝুড়িতে আর জায়গা নেই। বাড়তি হিসেবে দুই প্যাকেট সার রাখা হয়েছে চারাগুলোর গোড়ায় ঠেস দিয়ে।
দেখে যে কারও মনে হতে পারে, কেউ একজন শখ করে নার্সারি থেকে চারাগুলো কিনে এনেছেন তাঁর বাসার একফালি বারান্দা, সিঁড়ির পাশ বা জানালার ফ্রেমে ঝুলিয়ে রাখবেন বলে। কিংবা ছাদবাগানের নতুন সদস্যও হতে পারে গাছগুলো।
এ মহানগর যতটা না কংক্রিটময়, তার চেয়ে বেশি সবুজবিনাশী! গাছ কেটে রাস্তা বানাই, ভবন তুলি, পার্ক সাজাতে ঘাস তুলে ইট বিছাই।
বাসা–বাড়িতে দু-চারটে গাছ রাখার সুবিধা তাই বিস্তর; ফেসবুকে ছবি দেওয়া যায়, ‘প্রকৃতিপ্রেমী’ হিসেবে একখানা পরিচয়ও দাঁড়ায় বৈকি। আর ‘ফাও’ হিসেবে প্রকৃতির কল্যাণ মায় জলবায়ু পরিবর্তনের খাঁড়ার নিচে কম্পমান ধরিত্রীর একটুখানি উপকার তো করা হলোই!
কিন্তু গাছের চারা ভরা ছোট্ট ঝুড়িটির ছোটখাটো ‘মালিক’কে দেখে বুঝতে বাকি থাকে না, তাঁর জীবনের পুরোটাই মাটির ওপর দাঁড়িয়ে, অনলাইনে দেখনদারির অবস্থা তাঁর নয়। বেঁচে আছেন তিনি শতভাগ ‘অফলাইনে’। সুতরাং নাম ফুটানো কিংবা ‘জলবায়ুযোদ্ধা’ হওয়া তাঁর দূরকল্পনার সীমারও বাইরে।
বিশ্বাস করতে কিছুটা দোনোমোনো হয় বটে; কিন্তু এটাই সত্যি—প্রতিদিন এই চার-পাঁচ শ টাকার ফুলের চারা বিক্রি করে পেট চালানো লোকটির একটি বাটনওয়ালা মুঠোফোনও নেই। এমনকি নেই তাঁর জাতীয় পরিচয়পত্র—এনআইডিও। পড়তে জানতে না বলে মুঠোফোন চালাতে পারেন না।
আর কোথায় কোন ঠিকানা দেবেন নিজের—এই চিন্তা থেকে এনআইডি করা হয়নি। এমন নয়, তাঁর বাপ-দাদার ভিটা ছিল না। বিক্রমপুরের শ্রীনগরে নিজ বাড়িতেই তাঁর জন্ম। স্বৈরশাসক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের আমলের কোনো এক সময় বড় ধরনের সড়ক দুর্ঘটনায় পড়েছিলেন। চিকিৎসার খরচ জোগাতে তখন নিজের অংশের জায়গা বেচে দেন। সেই থেকে তাঁর শিকড় ওপড়ানো, ভাসমান কচুরিপানার জীবন।
অর্থাৎ ফুল-ফলের চারা বিক্রি করেন বটে, কিন্তু একটি চারা লাগানোর মতো একচিলতে জায়গার মালিকানাও নেই তাঁর। ফলে ফুলের সুবাস, ফলের স্বাদ—দুই-ই থেকে বঞ্চিত প্রায় ৬০ ছোঁয়া এই মানুষটির নাম মো. মোসলেম মোল্লা।
বিয়ে করেছিলেন বটে, তবে বছর ১২ আগে ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে। দুটি মেয়ে—তাঁদের বিয়ে দিয়েছেন। তাঁদের সংসারেও অভাব-অনটন। তাই একটু-আধটু টাকা-পয়সা জমাতে পারলে ভালো-মন্দ কেনাকাটা করে মেয়েদের বাড়ি যান। ‘ওরা ভালো খাইতে পারলে আত্মায় শান্তি পাই’, বললেন মোসলেম। ঈদের সময় কেউ কেউ কিছু টাকা-পয়সা দেন। সেই টাকায় মেয়ে-জামাইসহ নাতি-নাতনিদের জন্য কাপড়চোপড় কেনেন।
অন্তত ২৫ বছর ধরে ঢাকার রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে ফুল-ফল-সবজির চারা বেচেন। এতে করে মাসে আয় দুই থেকে তিন হাজার টাকা। আর দুটি বাড়ির বাগানে মাসে একবার করে মালির কাজ করেন। এর বিনিময়ে পান হাজার টাকা। কীভাবে সম্ভব এত কম টাকায় চলা?
তিনি জানান, তালতলা এলাকায় একটি বাসার নিচে একজন বিনা পয়সায় থাকতে দিয়েছেন; সেখানে আছেন ১২-১৩ বছর। নিজেই রান্না করে খান। ভাত, ভাজি আর ডাইলটাইল খাওয়া হয় বেশি। কখনো ২০-৩০ টাকায় মাছ পেলে কেনেন। আর মাংস? কোরবানির সময় খাওয়ার ‘ভাগ্য’ হয়। সংসারে কেউ নেই—এই প্রশ্নে যেন একটু হোঁচট খেলেন; কথা থামালেন কিছুক্ষণের জন্য।
বিয়ে করেছিলেন বটে, তবে বছর ১২ আগে ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে। দুটি মেয়ে—তাঁদের বিয়ে দিয়েছেন। তাঁদের সংসারেও অভাব-অনটন। তাই একটু-আধটু টাকা-পয়সা জমাতে পারলে ভালো-মন্দ কেনাকাটা করে মেয়েদের বাড়ি যান। ‘ওরা ভালো খাইতে পারলে আত্মায় শান্তি পাই’, বললেন মোসলেম। ঈদের সময় কেউ কেউ কিছু টাকা-পয়সা দেন। সেই টাকায় মেয়ে-জামাইসহ নাতি-নাতনিদের জন্য কাপড়চোপড় কেনেন।
মোসলেমের জবানিতে, মুক্তিযুদ্ধের আগে ঢাকায় আসেন তিনি। এক বাসায় তাঁর বড় ভাই তাঁকে রেখে গিয়েছিলেন। সেই থেকে ‘কর্মজীবন’ শুরু। গাছের চারা ফেরি করে বেচা শুরুর আগে একজন নামকরা মানুষের বাসায় থাকতেন। তবে কিছু কারণে সেখানে থাকা হয়নি।
পাঁচ দশকে ঢাকাকে চোখের সামনেই আড়ে–বহরসহ উচ্চতায় বাড়তে দেখেছেন মোসলেম। তাঁর ভাষ্যে, আগে পুরো ঢাকা শহরে যা না ছিল, এখন একটা ওয়ার্ডেই তা আছে! আগে সস্তার আমলে কষ্ট আরও বেশি ছিল। তবে এখনকার মতো এত মারামারি-খুনাখারাবি ছিল না।
এই যে প্রায় গোটা জীবনটা কেটে গেল, কী পেলেন-না পেলেন? হিসাব–টিসাব কিছু মেলান? মোসলেম যা বললেন, তার সারকথা এমন—তাঁর কিছু না হোক, অন্যদের তো অনেক কিছু হয়েছে! কত মানুষকে চোখের সামনে বড়লোক হতে দেখলেন। মোসলেমের কথায়, ‘আর আশা করি না, আর কখনো কিছু হইবোও না।’ একটু থেমে যোগ করলেন, ‘যার কেউ নাই, তার আল্লায় আছে!’
শৈশবে শুধু মা-বাবাকেই হারাননি মোসলেম, তাঁর একটা চোখও গেছে। গুটিবসন্ত হয়েছিল; এতে করে ডান চোখটি খোয়াতে হয়েছে তাঁকে।
মোসালেমের কথায় উপলব্ধি হয়, ‘মন কানা’ না হলে জীবনটা আসলে সরল-সিধা, জটিলতামুক্ত; চর্মচক্ষুর সংখ্যা সেখানে কোনো মানে তৈরি করে না। তাই না পাওয়াকে ‘নিয়তি’ ধরে নেন তাঁরা। কিন্তু পুঁজির একমুখী ধারা, অলিগার্কির বাড়বাড়ন্ত, লুটেরাতন্ত্রের বিস্তার—এসবের চক্করে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে মোসলেমরা যে ‘দারিদ্র্যরেখা’র নিচেই পড়ে থাকছেন, এই জায়গা তাঁদের দৃষ্টিসীমার আড়ালে থেকে যাচ্ছে। ন্যূনতম মৌলিক অধিকার থেকেও যে তাঁরা বঞ্চিত, তা–ও থাকছে তাঁদের জানা-বোঝার বাইরে।
এসব ম্লান মানুষের এই সরলতা যে ‘ফাঁকির গরলতায়’ পূর্ণ, কবি তারাপদ রায় কথিত ‘ঝকঝকে লম্বা রেখাটি’র নিচে ‘অন্ধকারে’ তাঁদের রাখার ব্যবস্থা যে অটুট, কে কবে তাঁদের এই ‘ইহজাগতিক ফাঁদ’দেখিয়ে দেবে? আর কবেই বা তাঁরা এই ফাঁদ থেকে মুক্ত হবে?
হাসান ইমাম প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ সহসম্পাদক
hello.hasanimam@gmail.com