তিস্তার পর কি ধরলার পানিও হারাচ্ছে বাংলাদেশ

সপ্তাহখানেক আগে দেখলাম অনেকে তিস্তা নদী হেঁটে পার হচ্ছেন। ২০১৪ সালের আগে তিস্তার শুকিয়ে কাঠ হওয়ার এ রূপ কেউ দেখেনি। ওই বছর ভারত তিস্তার পানি সবটুকুই একতরফা প্রত্যাহার করেছিল।

তার পর থেকে বাংলাদেশে যে সামান্য পানি আসে, তাতে না হয় সেচ প্রকল্পের কাজ, না বাঁচে তিস্তা। ২০১৪ সালের আগে তিস্তার পানিতে ভারত-বাংলাদেশ উভয় দেশ সেচ প্রকল্প বাস্তবায়ন করছিল। তখন সম্পূর্ণ তিস্তায় কিছুটা পানি থাকত। ভারত নতুন করে দুটি খাল খনন করছে কৃষি সেচের জন্য। এটি বাস্তবায়িত হলে বাংলাদেশ আর ন্যূনতম পানি পাবে বলেও মনে না। তিস্তা চুক্তি না হওয়ার শেষ পেরেক হতে পারে ভারতের তিস্তানির্ভর বর্ধিত সেচ প্রকল্প।

ভারত পশ্চিমবঙ্গের গজলডোবায় সেচ প্রকল্প চালু করার পর থেকে বাংলাদেশে তিস্তায় যে পরিমাণ পানি আসত, তা ন্যায্য পাওনার চেয়ে অনেক কম। ২০১১ সালের সেপ্টেম্বরে তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তি চূড়ান্ত হওয়ার কথা ছিল। সেই সেপ্টেম্বর মাসের ৩–৪ তারিখে আমরা তিস্তার ডালিয়া পয়েন্টে নৌমিছিল করেছিলাম। আমাদের দাবি ছিল, চুক্তিতে বাংলাদেশ-ভারত ও নদী—তিন পক্ষের যেন কেউ বঞ্চিত না হয়।

আন্তসীমান্ত নদীর প্রশ্নে ভারত কোন পথে হাঁটছে, তা পরিষ্কার। বাংলাদেশ সরকার কিসের অপেক্ষায় রয়েছে আমরা জানি না। তিস্তা, ধরলাসহ অভিন্ন সব নদী রক্ষায় সরকার সর্বোচ্চ পদক্ষেপ নিক, সেটাই আমাদের চাওয়া

ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারকে কখনোই তিস্তা চুক্তির বিষয়ে তেমন কোনো শক্ত পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়নি, বরং চুক্তি ভেস্তে যাওয়ার তিন বছরের মাথায় ২০১৪ সাল থেকে ভারত একতরফা পানি প্রত্যাহার শুরু করেছে। পশ্চিমবঙ্গ সরকার নিজেরা সিদ্ধান্ত নিয়ে বাংলাদেশের চরম ক্ষতি করছে আর কেন্দ্রীয় সরকার কিছুই জানে না—এটি যাঁরা ভাবছেন, তাঁরা বোকার রাজ্যে বাস করছেন। ঘটনাগুলো পর্যালোচনা করলে বোঝা যায়, পশ্চিমবঙ্গ সরকার ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের সম্মতিতে তিস্তার পানি প্রত্যাহার করছে।

ভারত দীর্ঘমেয়াদি যে পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছে, তাতে শুষ্ক মৌসুমে বাংলাদেশ পানিশূন্য হয়ে পড়বে। তারই পরীক্ষামূলক কার্যক্রম পরিচালনা করেছে তিস্তায়। এতে তারা বেশ ভালোভাবেই সফল হয়েছে। প্রথমে ‘চুক্তি’ নামের একটি মুলা ঝুলিয়েছে। এরপর একতরফা পানি প্রত্যাহার করেছে। এখন তাদের সেচ প্রকল্পের আওতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে দুটি খাল খননের জন্য এক হাজার একর জমি অধিগ্রহণ করেছে। খাল খনন শেষ হলে আরও প্রায় এক লাখ হেক্টর জমিতে চাষাবাদ করবে তিস্তার পানিতে। বর্তমানে বাংলাদেশ বছরভেদে পানি পাওয়া সাপেক্ষে রেশনিং পদ্ধতিতে শুষ্ক মৌসুমে ২০ হাজার থেকে ৪৫ হাজার একর জমিতে সেচ প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে।

বাংলাদেশে যখন তিস্তা সেচ প্রকল্প শুরু হয়, তখন প্রথম পর্যায়ে লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১ লাখ ১১ হাজার হেক্টর জমিতে সেচ প্রকল্প পরিচালনা করা। পানির অভাবে প্রথমে ৯০ হাজার হেক্টর জমিতে চাষাবাদ শুরু হয়েছিল। আর এখন তার প্রায় অর্ধেকে নেমে এসেছে। কোনো কোনো বছর ১০ ভাগের এক ভাগ জমিতেও চাষাবাদ করার মতো পানি থাকে না। কোনো কোনো বছর তিস্তার পানি এতটাই কম আসে যে পানির পরিমাপ নির্ণয়ক যন্ত্রটিও কাজ করে না। এ অবস্থায় পানির প্রাপ্যতা বিচার না করেই বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে তিস্তা সেচ প্রকল্পের আওতা বৃদ্ধির কাজ শুরু করেছে। এতে ভারতের কাছে এ ভুল বার্তা যেতে পারে যে বাংলাদেশ তিস্তায় প্রচুর পানি পাচ্ছে। 

ভারত ইতিমধ্যে যে পানি প্রত্যাহার করছে, সে পানির উপযোগিতা সেখানে তারা তৈরি করেছে। ফলে ভারত নতুন করে যে এক লাখ কৃষকের জমিতে সেচ দেওয়ার কাজ শুরু করছে, তা বাংলাদেশ যে পানিটুকু পায়, সে পানিতেই করবে। ভবিষ্যতে শুষ্ক মৌসুমে তিস্তার কোনো পানিই সম্ভবত বাংলাদেশ পাবে না।

বর্তমানে বাংলাদেশে যে সামান্য পানি আসে, এর সবটুকু প্রত্যাহার করে নিলেও ভারতের নতুন এক লাখ কৃষকের জমিতে চাষ করার জন্য পর্যাপ্ত পানি পাবে না। সে জন্য জলঢাকা নদীর পানি প্রত্যাহারের পথ ধরবে বলে খবর প্রকাশিত হয়েছে ভারতের পত্রিকায়। ভারতে যে নদীর নাম জলঢাকা, বাংলাদেশে তার নাম ধরলা। এরপর উজানের অন্য সব নদীর পানি ভারত প্রত্যাহার করলেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।

২০১৪ সালে ভারত যখন তিস্তা থেকে পানি প্রত্যাহার শুরু করে, তখনই আমরা নদী আন্দোলনকারীরা বলেছিলাম, ভারতের এ উদ্যোগ দ্রুত বন্ধ করতে হবে। এটা করতে ব্যর্থ হলে ভারত ক্রমান্বয়ে উজানের সব নদীর পানি প্রত্যাহারের পথ ধরতে পারে। কৃষি অর্থনীতির ওপর নির্ভরশীল বাংলাদেশের রংপুর অঞ্চলে মরুকরণের আশঙ্কা দেখা দেবে। সেই আশঙ্কাই যেন বাস্তবে রূপ নিচ্ছে।

২০১৪ সালে তিস্তার পানি একতরফা প্রত্যাহারের যতটা প্রতিবাদ হওয়া প্রয়োজন ছিল, ততটা হয়নি। বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে তিস্তার পানি চাওয়া হলেও সেটি মনে হয়েছে দুর্বল চাওয়া। ১৯৯৭ সালে জাতিসংঘ প্রণীত পানিপ্রবাহ কনভেনশনে বাংলাদেশ অনুসমর্থন করেনি।

ভারত ওই আইন চায় না। বাংলাদেশ ভারতের একতরফা পানি প্রত্যাহারের বিরুদ্ধে একাধিক দৃষ্টিকোণ থেকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে প্রতিকার দাবি করতে পারত। তিস্তার পানি উজানে আটকে রাখার কারণে আমাদের দেশে কৃষি উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে, পরিবেশের ক্ষতি হচ্ছে, জলবায়ুর অভিঘাত বাড়ছে। সবকিছু মিলিয়ে অর্থনীতি, পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের যে ক্ষতির মুখে পড়ছে বাংলাদেশ, এর সব কটির জন্য আন্তর্জাতিক আদালতে যাওয়ার সুযোগ আছে।

আন্তসীমান্ত নদীর প্রশ্নে ভারত কোন পথে হাঁটছে, তা পরিষ্কার। বাংলাদেশ সরকার কিসের অপেক্ষায় রয়েছে আমরা জানি না। তিস্তা, ধরলাসহ অভিন্ন সব নদী রক্ষায় সরকার সর্বোচ্চ পদক্ষেপ নিক, সেটাই আমাদের চাওয়া।

  • তুহিন ওয়াদুদ বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এবং নদী রক্ষাবিষয়ক সংগঠন রিভারাইন পিপলের পরিচালক