চারটি যুদ্ধ ও অবিরাম উত্তেজনা থাকা সত্ত্বেও ভারত ও পাকিস্তান সিন্ধু পানি চুক্তি ব্যবহার করে নির্বিরোধ তাদের সীমান্তের উভয় পাশের উর্বর জমিতে সেচ দেয়। তবে সেই চুক্তি নয়াদিল্লি ও ইসলামাবাদের মধ্যে ভঙ্গুর সম্পর্কের সর্বশেষ কেন্দ্র হিসেবে আবির্ভূত হতে পারে। চুক্তির শর্তাদি পুনর্বিবেচনা করার জন্য পাকিস্তানকে একটি নোটিশ পাঠিয়েছে ভারত।
ভারতীয় গণমাধ্যমের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে ১৮ সেপ্টেম্বর পাকিস্তানকে একটি আনুষ্ঠানিক নোটিশ পাঠায় ভারত। মানুষের সংখ্যা বেড়ে যাওয়া, পরিবেশগত চ্যালেঞ্জ, অন্যান্য কারণসহ বিভিন্ন উদ্বেগের কথা উল্লেখ করে ভারত চুক্তির পুনর্মূল্যায়নের জন্য অনুরোধ করেছে।
এই নোটিশের মানে কী আসলে? সিন্ধু পানি চুক্তি উভয় দেশের সম্পর্কে আর কী নতুন মোড় ঘোরাবে?
১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ শাসনের অবসানের পর ভারত ও পাকিস্তান দুটি সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে আবির্ভূত হয়। সিন্ধু পানি চুক্তির জন্ম হয় এই বিভাজনের পর। পাঞ্জাবের সেচব্যবস্থায় ব্রিটিশরা প্রচুর বিনিয়োগ করেছিল। ভারত আর পাকিস্তান, কৃষির জন্য দুই দেশই এই নদীব্যবস্থার ওপর অত্যন্ত নির্ভরশীল। ফলে দেশভাগের পরই পাঞ্জাবের সমন্বিত সেচব্যবস্থা পরিচালনার বিষয়ে সমাধান জরুরি হয়ে পড়ে।
৯ বছর আলোচনার পর বিশ্বব্যাংকের সহায়তায় তৎকালীন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু ও পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতি আইয়ুব খান ১৯৬০ সালের সেপ্টেম্বরে সিন্ধু পানি চুক্তিত স্বাক্ষর করেন। চুক্তির অধীনে, ভারত পূর্ব দিকের তিনটি নদী রাভি, সাতলেজ ও বিয়াস নিয়ন্ত্রণ করে। পাকিস্তান পশ্চিমের তিনটি নদী ঝিলাম, চেনাব ও সিন্ধু নিয়ন্ত্রণ করে। সীমিত ব্যতিক্রম ছাড়া ভারত পশ্চিমের নদীগুলোর পানি পাকিস্তানে প্রবাহিত হতে দিতে বাধ্য।
চুক্তি অনুযায়ী ভারত কিছু শর্তে পশ্চিমের নদীগুলোয় জলবিদ্যুৎ প্রকল্প করতে পারবে। প্রকল্পগুলো উল্লেখযোগ্যভাবে পানির প্রবাহ বা সঞ্চয়স্থান পরিবর্তন করতে পারবে না। অর্থাৎ, ভাটিতে পাকিস্তানের পানির অধিকার প্রতিকূলভাবে প্রভাবিত করা যাবে না।
সংক্ষেপে, ভারত বলেছে যে তারা চুক্তির শর্তাবলি নিয়ে আবার আলোচনা করতে চায়। নয়াদিল্লির রাজনৈতিক বিশ্লেষক অনুত্তমা ব্যানার্জির মতে, ভারত মনে করে যে চুক্তির বর্তমান শর্তগুলো তার অনুকূলে নয়। পাকিস্তানের নিয়ন্ত্রণে থাকা নদীগুলোয় ভারত নিয়ন্ত্রিত নদীগুলোর চেয়ে অনেক বেশি পানি রয়েছে। অনুত্তমা জানান যে চুক্তির আওতায় থাকা মোট পানির প্রায় ২০ শতাংশে ভারতের অভিগম্যতা রয়েছে।
নদীর পানি ব্যবহারের এই অনুপাত ভারতের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠেছে। কারণ, সাম্প্রতিক দশকগুলোয় দেশটির জনসংখ্যা বেড়েছে। ভারত এখন বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল দেশ। জনসংখ্যার চাপ, জলবায়ু পরিবর্তন ও চুক্তির অন্য প্রভাবগুলোর সাপেক্ষে চুক্তির শর্তগুলো নতুন করে বিবেচনা করা উচিত বলে মনে করে ভারত।
তবে ভারত এই চুক্তিতে কোন সুনির্দিষ্ট পরিবর্তন চায়, তা স্পষ্ট করেনি। অনেক বিশ্লেষক মনে করেন যে নয়াদিল্লি পাকিস্তানের নিয়ন্ত্রিত নদীগুলোয় জলবিদ্যুৎ ও অন্যান্য অবকাঠামো তৈরির শর্তগুলো নিয়ে পরিবর্তন চাইবে। এদিকে, সম্প্রতি চুক্তির বাস্তবায়ন নিয়ে নিজেদের উদ্বেগ প্রকাশ করেছে পাকিস্তান।
ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে উত্তেজনা চলমান থাকা সত্ত্বেও সিন্ধু পানি চুক্তি নিয়ে ঝামেলা হয়নি। কিন্তু ১৯৯০-এর দশকের শেষের দিকে ভারত চেনাবের ওপর ভারত–শাসিত কাশ্মীরে বাগলিহার জলবিদ্যুৎ প্রকল্প নির্মাণের পরিকল্পনা ঘোষণা করে। সম্প্রতি ঝিলম নদীর ওপর কিষানগঙ্গা জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রও নির্মাণ করেছে ভারত।
লাহোরভিত্তিক পরিবেশ আইনজীবী ড. আহমেদ রাফায় আলম বলেন, পাকিস্তানের যুক্তি হলো, ভারত যেভাবে বাঁধগুলোর নকশা করেছে, তা পানির প্রবাহ নিশ্চিত করার বাধ্যবাধকতা লঙ্ঘন করে। অন্যদিকে, ভারত জোর দিয়ে বলছে যে তার প্রকল্পগুলো চুক্তির শর্তাবলি মেনেই করা হয়েছে। আলমের মতে, ভারত যুক্তি দেয় যে যদি তারা পানির প্রবাহকে বাধা দেয়, তাহলে তার নিজস্ব অঞ্চলেই বন্যা হবে। এ তো অবাস্তব। তবে পাকিস্তান আনুষ্ঠানিকভাবে নিজে চুক্তিতে কোনো পরিবর্তন চায়নি।
পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র মমতাজ জাহরা বালোচ গত বৃহস্পতিবার বলেছেন যে দ্বিপক্ষীয় যত চুক্তি আছে, তার মধ্যে এই চুক্তি আদর্শ। আর পাকিস্তান এটির প্রতিপালনের জন্য ‘পুরোপুরি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ’। বালোচ সাপ্তাহিক সংবাদ সম্মেলনে প্রেস ব্রিফিংয়ে বলেন, ‘পাকিস্তান বিশ্বাস করে যে পরিবেশগত ভারসাম্য বজায় রাখা এবং পরিবেশে বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে এমন ব্যবস্থা এড়ানো আমাদের সম্মিলিত দায়িত্ব। চুক্তি নিয়ে দুই দেশের সমন্বয়ে সিন্ধু কমিশন আছে। আমরা বিশ্বাস করি যে এই চুক্তির সঙ্গে সম্পর্কিত সব বিষয় সেখানে আলোচনা করা যেতে পারে।’
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ইঙ্গিত দিয়েছিলেন যে নয়াদিল্লি সিন্ধু উপত্যকার উজানে থাকার সুবিধাটি পাকিস্তানকে শাস্তি দিতে হাতিয়ার হিসেবে কাজে লাগাবে। ‘রক্ত আর জল একসঙ্গে প্রবাহিত হতে পারে না’, মোদি তাঁদের বলেছিলেন।
সিন্ধু পানি চুক্তি এই অঞ্চলের ভূরাজনীতি থেকে মুক্ত নয়। ২০১৬ সালের সেপ্টেম্বরে কিছু সশস্ত্র যোদ্ধা ভারত–শাসিত কাশ্মীরের উরিতে একটি ভারতীয় সেনা ঘাঁটিতে হামলা চালাযন। এতে অন্তত ১৯ জন সেনা নিহত হযন। হামলার জন্য পাকিস্তানকে দায়ী করেছে ভারত। ইসলামাবাদ তা অস্বীকার করেছে।
হামলার পর ভারতীয় কর্মকর্তারা জানান যে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ইঙ্গিত দিয়েছিলেন যে নয়াদিল্লি সিন্ধু উপত্যকার উজানে থাকার সুবিধাটি পাকিস্তানকে শাস্তি দিতে হাতিয়ার হিসেবে কাজে লাগাবে। ‘রক্ত আর জল একসঙ্গে প্রবাহিত হতে পারে না’, মোদি তাঁদের বলেছিলেন। আসলেও পানি ভাগাভাগিকে রাজনৈতিক, ভূরাজনৈতিক ও আর্থিক বাস্তবতা থেকে বিচ্ছিন্ন কোনো বিষয় হিসেবে দেখা হবে এক অলীক চিন্তা।
বিশ্লেষকদের মতে, চুক্তিটি নিজে বিতর্কিত নয়। কিন্তু এর ভেতরের জটিল শর্তগুলো সম্পর্কে সাধারণ জনগণের বোধগম্যতা কম। এর ফলে রাজনৈতিক অংশীজনদের চুক্তিটিকে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে উত্তেজনা বাড়াতে টোপ হিসেবে ব্যবহার করার সুযোগ থেকেই যায়। লক্ষণীয়, সবাই জানেন যে ভারত চুক্তি সংশোধন কথা বলেছে। কিন্তু এ সম্পর্কে বিস্তারিত কিছু কোথাও পাওয়া যায় না।
পাকিস্তানের পক্ষ থেকে বলা হয় যে পশ্চিমের নদীগুলোর ওপর তার ঐতিহাসিক অধিকার রয়েছে। চুক্তিতে তা উল্লেখ করা আছে। ঔপনিবেশিক যুগ থেকে পাকিস্তান তার বিশাল কৃষি অবকাঠামো বজায় রাখতে এসব নদীর ওপর নির্ভর করে।
টাফট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ইরম সাত্তার বলেন, সাম্প্রতিক দশকগুলোয় ভারতের অবস্থান ধীরে ধীরে পরিবর্তিত হয়েছে। ভারত পশ্চিমের নদীগুলোর বেশির ভাগ পানি নিয়ন্ত্রণ করার জন্য আরও অবকাঠামো তৈরি করার চেষ্টা করেছে। এর অর্থ হলো, ভারত নিজের জন্য সম্ভবত আরও ভালো ভালো শর্ত নিয়ে আলোচনার জন্য চুক্তিটি আবার চালু করতে চায়।
আলম বলেন যে এই চুক্তি পৃথিবীর একমাত্র আন্তসীমান্ত পানি চুক্তি যা নদীর পানি ভাগ না করে নদীগুলোই নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নিয়েছে। ইসলামাবাদ পশ্চিমের নদীগুলোয় ভারতের জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের বিষয়ে বারবার আপত্তি তুলেছিল। বিষয়টি তারা হেগ-ভিত্তিক স্থায়ী সালিসি আদালতে নিয়ে গিয়েছিল। ভারত এরপর ২০২৩ সালের জানুয়ারিতে, চুক্তি বাস্তবায়নের বিষয়ে পাকিস্তানকে ‘অনিচ্ছুক’ বলে অভিযুক্ত করে।
ভারত এই বিরোধের বিষয়ে হেগের সালিসি আদালতের এখতিয়ার প্রত্যাখ্যান করেছে। তাদের যুক্তি হলো, পাকিস্তান সিন্ধু পানি চুক্তির অন্যান্য বিরোধ নিষ্পত্তির প্রক্রিয়াগুলো শেষ করতে ব্যর্থ হয়েছে।
চুক্তির অধীনে ভারত–পাকিস্তান স্থায়ী সিন্ধু কমিশন প্রতিষ্ঠা করেছে। সেখানে প্রতিটি পক্ষ থেকে একজন কমিশনার আছেন। ছোটখাটো বিরোধগুলো কমিশনের মাধ্যমে সমাধান করা হয়। তবে অমীমাংসিত সমস্যাগুলো বিশ্বব্যাংক দ্বারা নিযুক্ত একজন নিরপেক্ষ বিশেষজ্ঞের কাছে হাজির করার সুযোগ আছে। এর ফলে চুক্তির বিরোধ নিষ্পত্তির প্রক্রিয়া সহজ হয়।
পাকিস্তান প্রথমে পশ্চিমের নদীগুলোয় ভারতীয় প্রকল্প নিয়ে বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য একজন নিরপেক্ষ বিশেষজ্ঞের নিয়োগ চেয়েছিল। কিন্তু পরে হেগের সালিসে গেছে। এদিকে ভারতও তখন একজন নিরপেক্ষ বিশেষজ্ঞের নিয়োগ চেয়েছে। ২০২২ সালে বিশ্বব্যাংক নিরপেক্ষ বিশেষজ্ঞ নিয়োগ করার ও হেগ সালিসের সহায়তা নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ভারত শুধু নিরপেক্ষ বিশেষজ্ঞদের মধ্যস্থতার অংশটুকু মেনে নিয়েছে।
ভারত–শাসিত কাশ্মীরের স্বায়ত্তশাসন প্রত্যাহার করা হয় ২০১৯ সালের আগস্টে। এরপর দুই দেশের মধ্যে সম্পর্কের আরও অবনতি হয়েছে। ভারতের বৈশ্বিক প্রভাব বাড়ছে। তাই পাকিস্তান সম্ভবত আন্তর্জাতিক আইনের মাধ্যমে তার পানি নিয়ে দাবিগুলো আদায়ের চেষ্টা করবে। আর ভারত কাজে লাগাবে তার ভূরাজনৈতিক গুরুত্ব।
যে ভাবনার জায়গা থেকে এই চুক্তি করা হয়েছিল, সেই আস্থা আর পারস্পরিক সম্মানের জায়গায় যদি যেতে পারে দুই দেশ, তাহলেই হয়তো সবচেয়ে ভালো হবে।
আবিদ হুসেইন ইসলামাবাদে আল–জাজিরার একজন সংবাদকর্মী
আল–জাজিরা থেকে নেয়া, জাভেদ হুসেন অনূদিত