ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে মালয়েশিয়ান মডেল ঢাকার দুই সিটি কি অনুসরণ করবে

ঢাকা শহরে ডেঙ্গু জ্বর একটি ক্রমবর্ধমান উদ্বেগের কারণ হয়ে উঠেছে। মশাবাহিত এ রোগের বিস্তার রোধে জরুরি পদক্ষেপ ও কার্যকর নিয়ন্ত্রণব্যবস্থার প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে। ডেঙ্গুর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সাফল্যের একটি উজ্জ্বল উদাহরণ মালয়েশিয়া থেকে পাওয়া যেতে পারে, যেখানে একটি সুপ্রতিষ্ঠিত মডেল রোগের প্রকোপ কমাতে কার্যকরভাবে প্রমাণিত হয়েছে। এটি মাথায় রেখে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন উঠেছে: ঢাকা সিটি করপোরেশন কি মালয়েশিয়ার সাফল্য থেকে অনুপ্রেরণা নেবে এবং ডেঙ্গু সংকট মোকাবিলায় তাদের মডেল গ্রহণ করবে?

ঢাকা শহরে ডেঙ্গুর বর্তমান পরিস্থিতি উদ্বেগের কারণ ডেঙ্গু রোগীর উল্লেখযোগ্য বৃদ্ধি এবং জনস্বাস্থ্যের ওপর ক্ষতিকর প্রভাব। সাম্প্রতিক পরিসংখ্যানগুলো ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা তীব্র হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে সেটিই ইঙ্গিত দেয়। ক্রমবর্ধমান এ হুমকি মোকাবিলায় সক্রিয় পদক্ষেপের প্রয়োজন আগের চেয়ে আরও গুরুত্বপূর্ণ। কার্যকর কৌশল, যেমন মশা নিয়ন্ত্রণ, জনসচেতনতামূলক প্রচারাভিযান ও উন্নত স্যানিটেশন অনুশীলনগুলো ডেঙ্গুর সংক্রমণ প্রশমিত করার জন্য প্রয়োগ করা উচিত। উপরন্তু, আক্রান্ত রোগীদের প্রয়োজনীয় সহায়তা প্রদানের জন্য প্রাথমিক শনাক্তকরণ, দ্রুত চিকিৎসাসেবা ও পর্যাপ্ত স্বাস্থ্যসেবা অবকাঠামোকে শক্তিশালী করতে হবে। শুধু সহযোগিতামূলক প্রচেষ্টা ও সক্রিয় পদক্ষেপের মাধ্যমে আমরা ক্রমবর্ধমান ডেঙ্গু সংকট মোকাবিলা করতে পারি এবং ঢাকা শহরের নাগরিকদের স্বাস্থ্য রক্ষা করতে পারি।

মালয়েশিয়া ব্যাপকভাবে একটি পদ্ধতি প্রয়োগ করেছে, যা বেশ কয়টি মূল উপাদানকে অন্তর্ভুক্ত করে ডেঙ্গুর প্রকোপ উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাসের দিকে পরিচালিত করে। তাদের কৌশলের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো, জনসম্পৃক্ততা, ব্যক্তি, সমাজের নেতা এবং বিভিন্ন সংস্থার সক্রিয় অংশগ্রহণ জড়িত। এ দৃষ্টিভঙ্গির মাধ্যমে দায়িত্বশীলতা ও সম্মিলিত পদক্ষেপের বোধ জাগিয়ে তোলা হয়েছে এবং প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা বাস্তবায়নে ও মশার সম্ভাব্য প্রজননস্থানগুলো চিহ্নিত করার জন্য জনগণকে ক্ষমতায়ন করা হয়েছে। উপরন্তু, মালয়েশিয়ান মডেল শক্তিশালী নজরদারি ব্যবস্থার ওপর জোর দেয়, যা প্রাদুর্ভাবের প্রাথমিক শনাক্তকরণ ও তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা গ্রহণ করে। কার্যকর ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা—যেমন লক্ষ্যযুক্ত লার্ভিসাইডিং ও মশার উৎস হ্রাস—সারা দেশে প্রয়োগ করা হয়েছে। অধিকন্তু, মালয়েশিয়া জনসচেতনতামূলক প্রচারাভিযানের ওপর জোর দিয়েছে, বিভিন্ন মাধ্যম ব্যবহার করে জনগণকে ডেঙ্গু প্রতিরোধ, লক্ষণ ও প্রাথমিক চিকিৎসা সম্পর্কে শিক্ষিত করেছে।

মালয়েশিয়ায় কোনো ডেঙ্গু রোগী হাসপাতালে ভর্তি হলে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ সিটি করপোরেশনকে তথ্য প্রদান করে, রোগী সঠিক কোন এলাকা থেকে এসেছে। সিটি করপোরেশন রোগীর ওই বাড়িকে নির্দিষ্ট করে তার এক থেকে দুই কিলোমিটার পরিধির মধ্যে যত ধরনের মশা বিস্তার করার মতো ড্রেন, নালা ও বাসা আছে, তা ফগার মেশিনের মাধ্যমে ওষুধ দিয়ে লার্ভা সমূলে ধ্বংস করে দেয়, যার ফলে ওই এলাকায় ডেঙ্গুর বিস্তার আর লক্ষ করা যায় না।

এ প্রচেষ্টার ফলস্বরূপ সাম্প্রতিক পরিসংখ্যান অনুসারে, মালয়েশিয়ায় ২০১৭ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত ৬০ শতাংশের বেশি হ্রাসসহ ডেঙ্গুর বিস্তার উল্লেখযোগ্য পরিমাণে হ্রাস পেয়েছে। এ রোগের বিরুদ্ধে যুদ্ধে এই অর্জনগুলো ডেঙ্গু সংক্রমণ রোধে মালয়েশিয়ার বহুমুখী পদ্ধতির কার্যকারিতা তুলে ধরে এবং অন্যান্য দেশের জন্য অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করে।

ঢাকায় ডেঙ্গু জ্বরের বিস্তার নিয়ন্ত্রণে সিটি করপোরেশন বেশ কয়টি অনন্য চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। একটি বড় বাধা হলো শহরের জনসংখ্যার ঘনত্ব, যেখানে লাখ লাখ বাসিন্দা অপেক্ষাকৃত ছোট এলাকায় বসবাস করে। মানুষের এই উচ্চ ঘনত্ব ডেঙ্গু বহনকারী মশার বংশবৃদ্ধি ও সংক্রমণের জন্য অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করে। উপরন্তু, অপর্যাপ্ত স্যানিটেশন অবকাঠামো ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনার সমস্যাগুলো আরও ডেঙ্গু বিস্তারে অবদান রাখে। সঠিক নিষ্কাশনব্যবস্থার অভাব ও বর্জ্য অব্যবস্থাপনা মশার প্রজননক্ষেত্র তৈরি করে ডেঙ্গুর হুমকিকে বাড়িয়ে তোলে। অতীতে ঢাকা সিটি করপোরেশনের নানা প্রচেষ্টা দেখা গেলেও ডেঙ্গু মোকাবিলায় তাদের সাফল্য সীমিতই বলা যায়। যদিও জনসচেতনতামূলক প্রচারাভিযান ও মশা নিয়ন্ত্রণব্যবস্থার মতো উদ্যোগগুলো বাস্তবায়িত হয়েছে। কিন্তু সমস্যার ব্যাপকতা ও দ্রুত নগরায়ণের কারণে উল্লেখযোগ্য যে চ্যালেঞ্জগুলো তৈরি করে, সেসব মোকাবিলায় টেকসই ও উদ্ভাবনী সমাধান প্রয়োজন।

ঢাকা সিটি করপোরেশনের সম্মুখীন সুনির্দিষ্ট চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় মালয়েশিয়ান মডেল বাস্তবায়নের বিপুল সম্ভাবনা রয়েছে। মালয়েশিয়ান মডেল ভেক্টরবাহিত রোগ, অর্থাৎ ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়ার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে কার্যকর প্রমাণিত হয়েছে এবং একই ধরনের সমস্যায় জর্জরিত একটি শহর ঢাকার জন্য মূল্যবান অন্তর্দৃষ্টি প্রদান করতে পারে। এ মডেল গ্রহণ করার মাধ্যমে ঢাকা বর্ধিত জনগণের অংশগ্রহণ থেকে উপকৃত হতে পারে, যা মানুষকে তাদের পারিপার্শ্বিকতার জন্য দায়িত্ব নিতে এবং ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণব্যবস্থায় সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণে উৎসাহিত করবে।

এই সম্মিলিত প্রচেষ্টা রোগ বহনকারী মশার প্রজননস্থল উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস ঘটাতে পারে। তা ছাড়া মালয়েশিয়ান মডেল সমন্বিত ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণের কৌশলগুলোর গুরুত্বের ওপর জোর দেয়, অর্থাৎ ডেঙ্গুর উৎস হ্রাস, লার্ভিসাইডিং ও অ্যাডাল্টিসাইডিংয়ের মতো বিভিন্ন পদ্ধতির সমন্বয় করে। এ ধরনের একটি সমন্বিত পদ্ধতি ঢাকার ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ প্রচেষ্টার কার্যকারিতা বাড়াতে পারে। উপরন্তু, মালয়েশিয়ান মডেল ডেঙ্গুজনিত রোগ ও প্রতিরোধের পদ্ধতি সম্পর্কে সচেতনতা বাড়াতে কার্যকর জনশিক্ষা প্রচারের গুরুত্বের ওপর জোর দেয়। জনসাধারণকে শিক্ষিত করা এবং ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণব্যবস্থাগুলো আরও ভালোভাবে বোঝানো যেতে পারে, যার ফলে ঢাকা সিটি করপোরেশনের বাসিন্দাদের জন্য একটি স্বাস্থ্যকর ও নিরাপদ পরিবেশ তৈরি হবে। মালয়েশিয়ান মডেল গ্রহণের মাধ্যমে ঢাকা এসব সুবিধাকে কাজে লাগাতে পারে এবং আরও শক্তিশালী ও টেকসই ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণব্যবস্থার ওপর কাজ করতে পারে।

মালয়েশিয়ান মডেল বাস্তবায়ন করতে চাইলে ঢাকা সিটি করপোরেশানকে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নিতে হবে। প্রথমত আন্তপ্রতিষ্ঠান সমন্বয় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

সরকারি সংস্থা, স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারী, সামাজিক সংস্থাসহ বিভিন্ন কর্তৃপক্ষকে অবশ্যই তথ্য, সম্পদ ও দায়িত্ব ভাগ করে নেওয়ার জন্য ঘনিষ্ঠভাবে একে ওপরকে সহযোগিতা করতে হবে। এই সমন্বিত কর্মকাণ্ডে ডেঙ্গু মোকাবিলায় প্রতিরোধ ও সচেতনতামূলক প্রচারণা থেকে শুরু করে কার্যকর চিকিৎসা ও মশা নিয়ন্ত্রণব্যবস্থা পর্যন্ত সব কিছুই যুক্ত থাকবে এবং সেগুলো প্রয়োগ, বাস্তবায়ন বা কার্যকরাও নিশ্চিত করা হবে। দ্বিতীয়ত, পর্যাপ্ত সম্পদ বরাদ্দ করা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। স্বাস্থ্যসেবা পেশাদারদের প্রশিক্ষণ, প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম ও সরবরাহ সংগ্রহ, জনস্বাস্থ্য প্রচারাভিযান বাস্তবায়নসহ ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণের উদ্যোগকে সমর্থন করার জন্য পর্যাপ্ত তহবিল বরাদ্দ করতে হবে। তারপরও একটি শক্তিশালী নজরদারি ব্যবস্থা স্থাপন অপরিহার্য। একটি বিস্তৃত সিস্টেম থাকতে হবে, যা রিয়েল টাইম ডেটা সংগ্রহ, বিশ্লেষণ ও রিপোর্টিং অন্তর্ভুক্ত করে ডেঙ্গু প্রাদুর্ভাবের প্রাথমিক শনাক্তকরণ, দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ ও লক্ষ্যযুক্ত হস্তক্ষেপে সক্ষম হবে।

মশাবাহিত এ রোগের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে ডেঙ্গু প্রতিরোধ–নিয়ন্ত্রণ সম্পর্কে জনসচেতনতা বৃদ্ধি করা অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। জনসচেতনতামূলক প্রচারাভিযানগুলো সঠিক তথ্য প্রচারে, মিথকে উড়িয়ে দিতে এবং ডেঙ্গু প্রতিরোধের জন্য কার্যকর কৌশল প্রচারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। অধিকন্তু, স্থানীয় বাসিন্দাদের সক্রিয় অংশগ্রহণে ডেঙ্গুর প্রজননক্ষেত্র নির্মূল, মশা নিয়ন্ত্রণব্যবস্থা বাস্তবায়ন এবং সম্মিলিত দায়িত্ববোধ গড়ে তোলার ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। স্বাস্থ্যসেবা পেশাদার ও সংশ্লিষ্ট অংশীজনদের যুক্ত করা—যেমন সরকারি সংস্থা, অলাভজনক সংস্থা ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান—সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ।

আমি ঢাকা সিটি করপোরেশনকে মালয়েশিয়ান মডেলের সাফল্য থেকে শিক্ষা নেওয়ার জন্য জোরালো আহ্বান জানাচ্ছি। মশা নিয়ন্ত্রণ, জনসচেতনতামূলক প্রচারণা এবং উন্নত স্বাস্থ্যসেবা অবকাঠামোর মতো প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা বাস্তবায়নের জন্য অবিলম্বে পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন। ব্যাপক কৌশল গ্রহণের মাধ্যমে ঢাকা সিটির ডেঙ্গুর ঘটনা উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস করা এবং জনস্বাস্থ্য উন্নত করার এখনো সম্ভাবনা রয়েছে।

  • মো. মোর্ত্তূজা আহমেদ পিএইচডি গবেষক সহযোগী অধ্যাপক, ব্যবসায় প্রশাসন ডিসিপ্লিন খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়
    ই–মেইল: amm203@gmail.com