সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা অর্জনের পথ কী

কলেরা, ডায়রিয়া, ম্যালেরিয়া, কালাজ্বরসহ সংক্রামক রোগ প্রতিরোধ; সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচি ও সম্প্রতি কোভিড-১৯ টিকাদান কর্মসূচিতে ব্যাপক সফলতা অর্জনসহ অনেক অসম্ভবকে সম্ভব করতে সক্ষম হয়েছে বাংলাদেশ।

কিন্তু সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা অর্জনে বেশ পিছিয়ে আছে। বিশ্বব্যাংকের সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা সূচকে বাংলাদেশের স্কোর ৫১, যেখানে নেপালের ৫৩, ভারতের ৬১, ভুটানের ৬২, শ্রীলঙ্কার ৬৭ ও মালদ্বীপের ৬৯। অন্যদিকে ৪৫ স্কোর নিয়ে বাংলাদেশের নিচে আছে পাকিস্তান, আর আফগানিস্তানের স্কোর ৩৭।

সব মানুষের জন্য বিনা মূল্যে বা স্বল্প মূল্যে গুণগত মানের প্রয়োজনমাফিক স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা হলো সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবার মূলনীতি। তবে সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা সম্পর্কে অনেকের ধারণা পরিষ্কার নয়। নীতিনির্ধারণী মহলের কারও কারও মতে, ১০ টাকা টিকিটে স্বাস্থ্যসেবা দেওয়ার অর্থই সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত হওয়া। কিন্তু ১০ টাকা টিকিটে যে সময়মতো সব স্বাস্থ্যসেবা বিনা খরচে পাওয়া যায় না, তা তাঁদের ধারণার বাইরে।

কেননা তাঁরা কখনো লাইনে দাঁড়িয়ে সাধারণ মানুষের মতো চিকিৎসাসেবা নেন না। ফলে ১০ টাকা টিকিটে স্বাস্থ্যসেবা নিতে গিয়ে জনগণকে যে দুর্ভোগ পোহাতে হয়, তা তাঁরা বোঝেন না। বাংলাদেশে মোট স্বাস্থ্য খরচের প্রায় ৬৯ শতাংশ ব্যক্তির পকেট থেকে ব্যয় করতে হয়। সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবার লক্ষ্য অনুযায়ী ২০৩০ সালের মধ্যে এ ব্যয় ৩০ শতাংশে নামিয়ে আনতে হবে। কাজটি কঠিন হলেও অসম্ভব নয়। তবে এর জন্য প্রয়োজন দৃঢ় রাজনৈতিক অঙ্গীকার, সঠিক কৌশল ও স্বাস্থ্য খাতে উপযুক্ত নেতৃত্ব।

স্বাস্থ্য খাতকে ঢেলে সাজানোর জন্য প্রথমে প্রয়োজন দৃঢ় রাজনৈতিক অঙ্গীকার। যুক্তরাজ্য, দক্ষিণ কোরিয়া, থাইল্যান্ড, চীন, তুরস্ক, তাইওয়ান, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, ভারতসহ যেসব দেশ স্বাস্থ্য খাতে ব্যাপক সাফল্য অর্জন করেছে, তা তাদের দৃঢ় রাজনৈতিক অঙ্গীকারের ফসল।

বর্তমান বাংলাদেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থা জনকল্যাণমুখিতার পরিবর্তে এ খাতে কর্মরত জনবল এবং এর পরিচালনা, নির্মাণ ও কেনাকাটার সঙ্গে যাঁরা জড়িত, তাঁরাসহ মধ্যস্বত্বভোগীদের স্বার্থ রক্ষার্থে ব্যস্ত। পর্যাপ্ত দক্ষ ও সহায়ক জনবলের অভাব, উপযুক্ত কর্মপরিবেশের অভাব, দুর্বল ব্যবস্থাপনাসহ নানা সীমাবদ্ধতার কারণে সরকারি স্বাস্থ্যব্যবস্থা জনগণকে কাঙ্ক্ষিত সেবা দিতে পারছে না।

যথোপযুক্ত নিয়ন্ত্রণের অভাবে অতি মুনাফালোভী ও সেবা প্রদানের মানসিকতাহীন ব্যক্তিদের অনুপ্রবেশের ফলে উচ্চমূল্যের বিনিময়েও মানুষ বেসরকারি খাত থেকে গুণগত স্বাস্থ্যসেবা পাচ্ছেন না। মেডিকেল শিক্ষার গুণগত মানের ভয়াবহ অবনতির ফলে স্বাস্থ্যসেবার গুণগত মান প্রশ্নবিদ্ধ।

স্বাস্থ্য খাতকে ঢেলে সাজানোর জন্য প্রথমে প্রয়োজন দৃঢ় রাজনৈতিক অঙ্গীকার। যুক্তরাজ্য, দক্ষিণ কোরিয়া, থাইল্যান্ড, চীন, তুরস্ক, তাইওয়ান, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, ভারতসহ যেসব দেশ স্বাস্থ্য খাতে ব্যাপক সাফল্য অর্জন করেছে, তা তাদের দৃঢ় রাজনৈতিক অঙ্গীকারের ফসল।

প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের উপযুক্ত ব্যবস্থা নিশ্চিত করাই গণমানুষের প্রতি ভালোবাসা প্রদর্শনের উত্তম উপায়। স্বাস্থ্য খাতের উপযুক্ত সংস্কারের মাধ্যমে বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলো মানুষের প্রতি ভালোবাসা প্রদর্শনের সুযোগ নিতে পারে। পদ্মা সেতু ও মেট্রোরেলের মতো সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা অর্জনে দৃঢ় রাজনৈতিক অঙ্গীকার ব্যক্তকরণ এখন সময়ের দাবি। ১২তম জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে স্বাস্থ্য খাতের পরিবর্তনে রাজনৈতিক অঙ্গীকার ব্যক্ত করার এখনই সুবর্ণ সময়। কোভিড-১৯-পরবর্তী প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে রাজনৈতিক দলগুলোর ইশতেহারে জনকল্যাণমুখী স্বাস্থ্যসেবা চালুর সুস্পষ্ট ঘোষণা জনগণের একান্ত চাওয়া।

কিন্তু এর জন্য প্রয়োজন জনকল্যাণমুখী স্বাস্থ্যসেবার একটি সুনির্দিষ্ট রূপরেখা প্রণয়ন। অন্যান্য দেশের মতো এই রূপরেখার একদিকে যেমন প্রয়োজন প্রতিরোধমূলক সেবার ওপর অধিক গুরুত্ব প্রদানের মাধ্যমে গ্রাম ও শহরে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবার একটি শক্তিশালী নেটওয়ার্ক তৈরি করা, যা সরকারি-বেসরকারি অংশীদারির মাধ্যমে পরিচালিত হতে পারে। অন্যদিকে প্রয়োজন ইমার্জেন্সি, সেকেন্ডারি ও টারশিয়ারি সেবার জন্য সরকারি–বেসরকারি হাসপাতাল থেকে পরিবারপ্রতি বছরে নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকার সেবার বিধান রেখে একটি সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা কর্মসূচি প্রণয়ন করা। আর এসব কার্যক্রম পরিচালনার জন্য প্রয়োজন ভারতের মতো একটি জাতীয় স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষ প্রতিষ্ঠা করা।

এসব পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের জন্য স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, স্বাস্থ্যসেবা অধিদপ্তরসহ স্বাস্থ্য-সম্পর্কিত সব অধিদপ্তরে শক্তিশালী ও গতিশীল নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা অতি গুরুত্বপূর্ণ। মনে রাখা দরকার, স্বাস্থ্য খাত ব্যবস্থাপনা অন্যান্য খাত থেকে অধিক কঠিন।

অতীতের অভিজ্ঞতার আলোকে দেখা যায়, স্বাস্থ্য খাত ব্যবস্থাপনার অভিজ্ঞতা নেই, এমন কাউকে এসব প্রতিষ্ঠানের সর্বোচ্চ পদে অধিষ্ঠিত করলে তাঁরা রুটিন দায়িত্ব পালন ছাড়া উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডের পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন করতে সক্ষম হন না। আবার এসব পদে স্বল্পকালের জন্য কাউকে অধিষ্ঠিত করলে তিনিও উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডের পরিকল্পনা করার সুযোগ পান না। এ অবস্থা পরিবর্তনে সরকারকে সাহসী পদক্ষেপ নিতে হবে।

শুধু জ্যেষ্ঠতা নয়; সততা, অভিজ্ঞতা ও যোগ্যতাকেই এসব পদের প্রধান শর্ত হিসেবে বিবেচনা করতে হবে। সংশ্লিষ্ট পদে অধিষ্ঠিত হলে তাঁর ওপর অর্পিত দায়িত্ব ঠিকঠাক পালন করতে পারবেন কি না, তা তাঁদের নিয়োগের আগেই যাচাই করতে হবে।

এ ক্ষেত্রে স্বাস্থ্য খাত ব্যবস্থাপনায় তাঁদের কাজের অভিজ্ঞতা ও দক্ষতার পাশাপাশি স্বাস্থ্য খাতকে জনকল্যাণমুখী করার জন্য কীভাবে ঢেলে সাজাবেন, সে সম্পর্কিত সম্যক ধারণা ও পরিকল্পনাকে অধিক গুরুত্ব দিতে হবে।

অন্যদিকে যাঁরা সচিব বা মহাপরিচালক পদে অধিষ্ঠিত হবেন, তাঁদের চার বছর মেয়াদি কার্যকাল সুনির্দিষ্ট করে দেওয়া যেতে পারে, যা তাঁদের অবসরকালীন বয়সের সঙ্গে সম্পর্কিত হবে না। সরকারের সর্বক্ষেত্রে এ ব্যবস্থা চালু করা যেতে পারে।

আশা করি, সরকার এসব ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা অর্জনের পথ সুগম করবে।

  • ড. সৈয়দ আব্দুল হামিদ অধ্যাপক স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়