মতামত

বাল্যবিবাহের শিকার কিশোরীরা কেন ঝরে পড়বে

বাল্যবিবাহ নিয়ে ২০২৪-এর মার্চে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো প্রকাশিত প্রতিবেদনে যে চিত্র উঠে এসেছে, তা উদ্বেগজনক। প্রতিবেদনটি থেকে জানা যাচ্ছে, ২০২০ সালে ১৮ বছর বয়সের আগে বিয়ের হার ছিল ৩১ দশমিক ৩ শতাংশ, যা ২০২৩ সালে এসে দাঁড়িয়েছে ৪১ দশমিক ৬ শতাংশ। ১৫ বছর বয়সের আগে বিয়ের হার ২০২৩ সালে ছিল ৮ দশমিক ২ শতাংশ, যা ২০২০ সালে ছিল ৪ দশমিক ৯ শতাংশ। এ ছাড়া ১৫ থেকে ১৯ বছর বয়সী মেয়েদের সন্তান জন্মদানের হার ৭৩ শতাংশ।

গত এক দশকে বাংলাদেশে মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ভর্তির হার বাড়লেও মেয়েরা এখনো ঝরে পড়ছে এবং প্রয়োজনীয় দক্ষতা অর্জন করতে পারছে না। 

গ্রামাঞ্চলের অধিকাংশ মেয়ে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পর ঝরে পড়ে। বাংলাদেশ শিক্ষা তথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর (ব্যানবেইস) তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালে মাধ্যমিক স্তরে মেয়ে শিক্ষার্থীর মোট ভর্তির হার ছিল ৮৩ দশমিক ২০ শতাংশ, ঝরে পড়ার হার ৪০ দশমিক ৭৮ শতাংশ। 

বাল্যবিবাহ মেয়েদের অকালে লেখাপড়া থেকে ঝরে পড়ার অন্যতম কারণ। বিয়ের কারণে নানাভাবেই মেয়েরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। অল্প বয়সে বিয়ে হলে পারিবারিক সহিংসতার শিকার হওয়ার আশঙ্কা বেশি; সন্তান প্রসবের সময়েও কিশোরীরা অধিক ঝুঁকিতে থাকে। বাল্যবিবাহ রোধ না হলে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য নিয়ে টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্য অর্জন করা সম্ভব হবে না।

বাল্যবিবাহের কারণ

গত বছর দেশের ৫০ হাজার পরিবারের ওপর একটি জরিপ পরিচালনা করে ব্র্যাক। ‘বর্ন টু বি আ ব্রাইড’ (কনে হওয়ার জন্যই যেন জন্ম) শিরোনামে পরিচালিত জরিপটিতে দেখা যাচ্ছে, দরিদ্র ও ধনী—দুই ধরনের পরিবারেই বাল্যবিবাহ ঘটছে। বাল্যবিবাহের পেছনে দারিদ্র্য ও সামাজিক নিরাপত্তাবোধের অভাবের পাশাপাশি অভিভাবকেরা ‘উপযুক্ত পাত্র’ পাওয়ার কথা বেশি বলছেন।

আইন প্রয়োগের সীমাবদ্ধতাও বাল্যবিবাহের জন্য দায়ী। বাল্যবিবাহের সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা বিরাট সমস্যা। করোনা মহামারির সময় প্রায় দুই বছর বিদ্যালয় বন্ধ থাকা এবং দারিদ্র্য বেড়ে যাওয়া বাল্যবিবাহের হার বেড়ে যাওয়ায় ভূমিকা রেখেছে।

বাল্যবিবাহের শিকার মেয়েদের শিক্ষায় যত বাধা

বাংলাদেশে বিবাহিত মেয়েদের শিক্ষা অব্যাহত রাখতে আইন বা নীতিগত কোনো বাধা নেই। কিন্তু সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি এমন যে বাল্যবিবাহ হলেই একটি মেয়ের শিক্ষাজীবনের ইতি টানতে হবে। বিবাহিত কিশোরীরা শিক্ষক এবং শিক্ষার্থীদের বৈষম্যমূলক আচরণের শিকার হয়। অনেকের ধারণা, শ্রেণিকক্ষে বিবাহিত বা গর্ভবতী মেয়েদের থাকা উচিত নয়। কারণ, তাদের কাছ থেকে অন্য মেয়েরা দাম্পত্যজীবন নিয়ে তথ্য পাবে।

সম্প্রতি একজন প্রধান শিক্ষক জানালেন, এক বিবাহিত ছাত্রীকে তিনি বলেছেন বিদ্যালয়ে বিয়ের ব্যাপারটি গোপন রাখতে। ছাত্রীটির পড়াশোনা চালিয়ে যেতে আন্তরিক বলেই তিনি এটা করেছেন। কিন্তু এতে বিবাহিত কিশোরীরা পড়াশোনা করার ক্ষেত্রে যে বাধার মুখোমুখি হয়, তা বোঝা যায়। বিবাহিত কিশোরীদের মা হওয়ার পর সন্তান বড় করার দায়িত্ব নিতে হয়। পরিবার থেকে তাদের পড়াশোনার ব্যাপারে উৎসাহ বা সহায়তা দেওয়া হয় না। অনেকের আর্থিক সমস্যাও থাকে। ফলে তারা থেকে ঝরে পড়ে।

সুনামগঞ্জের হাওরাঞ্চল থেকে শুরু করে খুলনার বস্তি এলাকা পর্যন্ত অনেক কিশোরী শিক্ষার্থীর সঙ্গে কথা বলেছি। তারা পড়াশোনা শেষ করে নানা পেশায় যোগ দিতে আগ্রহী, কিন্তু বাল্যবিবাহের আশঙ্কায় দিন কাটায়। বিয়ে হয়ে গেলেও তারা পড়াশোনা চালিয়ে যেতে ইচ্ছুক।

বাল্যবিবাহের কারণে একটি মেয়ের জীবনে বাড়ে নানা ঝুঁকি। উপরন্তু তাকে পড়াশোনার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়ে তার সব সম্ভাবনা বিকাশের পথ রুদ্ধ হয়ে যায়। এসব কিশোরী যেন ‘অদৃশ্য’, তাদের জীবন নিয়ে কারও কোনো চিন্তাভাবনা আছে বলে মনে হয় না, তাদের শিক্ষা নিয়ে কার্যক্রমও নেই।

ভুক্তভোগী মেয়েদের শিক্ষায় ফিরিয়ে আনতে করণীয়

বাংলাদেশে অবকাঠামোগত উন্নয়ন হচ্ছে। আমরা অর্থনৈতিকভাবে ‘উন্নত’ দেশ হওয়ার স্বপ্ন দেখছি। কিন্তু দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশে বাল্যবিবাহের হার সর্বাধিক এবং বিশ্বে সর্বোচ্চ ১০টি দেশের মধ্যে আমাদের অবস্থান। এ অবস্থা বজায় রেখে কি আমরা নিজেদের ‘উন্নত’ বলে দাবি করতে পারব?

বাল্যবিবাহ নিরসনে সরকারি-বেসরকারি কার্যক্রমে আরও গতি আনার বিকল্প নেই। পাশাপাশি বিবাহিত মেয়ে ও কিশোরী মায়েদের বিদ্যালয়ে ফিরিয়ে আনার কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে। লেখাপড়া চালিয়ে নেওয়া তাদের অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের জন্য জরুরি।

এ জন্য যা যা করণীয়:

১. শিক্ষা, বাল্যবিবাহ ও কিশোরী স্বাস্থ্যের জন্য বিদ্যমান নীতিমালায় বিবাহিত মেয়ে ও কিশোরী মায়েদের জন্য সুস্পষ্ট নির্দেশনা থাকা।

২. স্বাস্থ্য ও শিক্ষাব্যবস্থার মধ্যে সমন্বয় করে কাজ করা, যাতে বিদ্যালয়ে গর্ভবতী কিশোরীদের শনাক্ত করা যায় এবং তাদের জন্য প্রসব–পূর্ববর্তী এবং পরবর্তী সেবা নিশ্চিত করা সম্ভব হয়।

৩. ঝরে পড়া কিশোরী বধূ ও মায়েদের খুঁজে বের করার জন্য ব্যবস্থা থাকা দরকার। সন্তান জন্মদানের পর তাদের বাড়িতে গিয়ে বিদ্যালয়ে ফিরতে উৎসাহিত করতে হবে। শিক্ষকেরা এই দায়িত্ব নিতে পারেন।

৪. শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্রের মাধ্যমে অথবা অন্য কোনোভাবে কিশোরী মায়েদের সন্তানের যত্নে সহায়তা দেওয়া প্রয়োজন। তাহলে তারা বিদ্যালয়ে গিয়ে পড়াশোনায় অংশ নিতে পারবে।

৫. কিশোরী বধূ ও মায়েদের শিক্ষার গুরুত্ব নিয়ে মা-বাবা, শ্বশুরবাড়ির লোকজন এবং সমাজের সবার সচেতনতা বাড়ানো দরকার। তাদের পড়াশোনা করার অধিকার সম্পর্কে শিক্ষক, শিক্ষা প্রশাসক এবং শিক্ষার্থীদের সংবেদনশীলতা বাড়াতে হবে।

লায়লা খন্দকার উন্নয়নকর্মী