পাহাড়ের একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পাঠদান। রাঙ্গামাটি।
পাহাড়ের একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পাঠদান। রাঙ্গামাটি।

চাকমা–মারমা ভাষায় পাঠদান কেন সফল হচ্ছে না

উদ্যোগ নিয়েও ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর ভাষায় পাঠদান সম্ভব হচ্ছে না। এক দশকের বেশি সময় ধরে চলা এই প্রচেষ্টা প্রায় মুখ থুবড়ে পড়ার মতো হয়েছে। এখন বিচার করা প্রয়োজন, কী কী কারণে এটি পুরোপুরি সফল হতে পারেনি। সমস্যা চিহ্নিত করে ব্যবস্থা না নিলে কয়েক বছরের মধ্যে এই প্রশংসনীয় উদ্যোগ পুরোপুরি থমকে যেতে পারে।

ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর শিশুদের পাঠদানের ক্ষেত্রে মাতৃভাষা নিশ্চিত করার জন্য কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেওয়া যায়, সেটি নিয়ে ভাবা দরকার। একই সঙ্গে ভাবা দরকার, দ্বিতীয় ভাষা হিসেবে বাংলা পড়ানোর কৌশল নিয়েও। 

২০১০ সালের জাতীয় শিক্ষানীতিতে আছে, ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর শিশু যাতে নিজের ভাষা শিখতে পারে, সে জন্য শিক্ষক ও পাঠ্যবইয়ের ব্যবস্থা করা হবে। এটি সফল করার জন্য জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) ২০১২ সালে একটি জাতীয় কমিটি গঠন করে।

২০১৩ সালে এই কমিটি সিদ্ধান্ত নেয়, প্রথম দফায় চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা (ককবরক), সাদরি (ওঁরাও) ও গারো (মান্দি) ভাষায় পাঠদানের ব্যবস্থা করা হবে। সে অনুযায়ী ২০১৭ সালে প্রাক্‌-প্রাথমিকের পাঠ্যবই লেখা হয়।

এরপর পর্যায়ক্রমে ২০১৮ সালে প্রথম শ্রেণির, ২০১৯ সালে দ্বিতীয় শ্রেণির এবং ২০২০ সালে তৃতীয় শ্রেণির পাঠ্যবই তৈরি করা হয়। তখন বলা হয়েছিল, সব মিলিয়ে ১৯ থেকে ২০টি ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর ভাষায় প্রাথমিকের পাঠ্যবই লেখা হবে। তবে পরে আর কোনো ভাষায় পাঠ্যবই তৈরি হয়নি। এমনকি ওই পাঁচ ভাষায়ও তৃতীয় শ্রেণির পরে আর কোনো বই লেখা হয়নি।

১৯৯৭ সালের পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির খ-এর ৩৩ ধারায়ও মাতৃভাষার মাধ্যমে প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু যাদের জন্য এসব বই তৈরি করা হয়, বাস্তব ক্ষেত্রে সেগুলো তাদের কাজে আসে না। এর প্রধান কারণ, এসব ভাষা পড়ানোর জন্য স্কুলগুলোয় উপযুক্ত শিক্ষক পাওয়া যায় না।

ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর শিক্ষিত বা উচ্চশিক্ষিত ব্যক্তিরা অধিকাংশ ক্ষেত্রে তাঁদের মাতৃভাষায় লেখা বই শিক্ষার্থীদের পড়াতে সক্ষম নন। তাঁরা বাংলা পড়তে ও লিখতে পারলেও নিজেদের ভাষায় লেখা বই পড়তে বা লিখতে পারেন না। তা ছাড়া শিশুর ভাষাশিক্ষার কৌশল কী হতে পারে, সেটিও তাঁদের অজানা।

বাংলাদেশে রেংমিতচা, কোডা, কন্দ, লুসাই, খাড়িয়া, সৌরা, পাত্র, পাংখোয়া, চাক, খুমি, খিয়াং, মালতো, কোলসহ ১৪টির বেশি ভাষা বিপন্ন। এসব ভাষার একেকটিতে ৪০-৫০ জন থেকে শুরু করে বড়জোর ২ থেকে ৩ হাজার মানুষ কথা বলে। বিপন্নপ্রায় ভাষাকে রক্ষা করার সবচেয়ে ভালো উপায় হতে পারে শিক্ষার্থীর জন্য সেই ভাষায় পাঠ্যবই তৈরি করে দেওয়া। এতে মাতৃভাষায় শিশুর পাঠ গ্রহণের অধিকারেরও স্বীকৃতি দেওয়া হয়।

সমস্যা আছে পাঠ্যবইয়ের লিপি ব্যবহারের ক্ষেত্রেও। কিছু ভাষার বর্ণমালা নেই। এমন সমস্যায় বাংলা, রোমান নাকি নতুন তৈরি করা লিপিতে বই লেখা হবে, সেটি নিয়ে সিদ্ধান্তের প্রশ্ন আছে।

এ সমস্যা দেখা দেওয়ায় সাঁওতাল ভাষায় পাঠ্যবই তৈরি করা সম্ভব হয়নি। অথচ প্রথম দফায় পাঁচটি ভাষার সঙ্গে সাঁওতাল ভাষায়ও বই লেখার কথা ছিল। তা ছাড়া শুধু পাঠ্যবই দিয়ে পাঠদক্ষতা পুরোপুরি অর্জনের আশা করা যায় না।

ভাষাদক্ষতা বাড়ানোর জন্য সাহিত্য নমুনাও পড়াতে হয়। এ জন্য নিজের জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে প্রচলিত ও পরিচিত গল্প-গাথা-কবিতা শিশুর উপযোগী বিবেচনা করা হয়। তাই পাঠ্যবই লেখার সঙ্গে সঙ্গে ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর বিভিন্ন লোককথা, উপকথা, গান ও কবিতা সংকলন করে আলাদা বই তৈরি করা প্রয়োজন। সেই সঙ্গে প্রয়োজন জরুরি ভিত্তিতে এসব ভাষার অভিধান প্রণয়ন করা।

এনসিটিবি আশা করছে, প্রাক্‌-প্রাথমিক থেকে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত চার বছরে ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর একটি শিশু মাতৃভাষায় পড়ার ও লেখার দক্ষতা অর্জন করবে। এই সময়ের মধ্যে বাংলা ভাষার সঙ্গে তার ব্রিজিং বা সংযোগপ্রক্রিয়াও শেষ হবে। কিন্তু ভাষাসংযোগের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত সময় সাত বছর। তা ছাড়া ক্ষুদ্র ভাষার শিশু কীভাবে বাংলা পড়ার ও লেখার দক্ষতা অর্জন করবে, সেটি এই পরিকল্পনায় স্পষ্ট নয়। এমনকি চতুর্থ শ্রেণি থেকে কীভাবে বাংলা ভাষায় লেখা সব বিষয়ের পাঠ গ্রহণ করতে পারবে, তা-ও নির্দেশ করা হয়নি।

ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর একটি শিশুকে বাংলা শিখতে হয় দ্বিতীয় ভাষা হিসেবে। আমাদের দেশের শিক্ষাক্রমে ও পাঠ্যপুস্তকে প্রথম ভাষা হিসেবে বাংলা শেখানোর ব্যবস্থা আছে।

দ্বিতীয় ভাষা হিসেবে বাংলা শেখানোর উপায় বিবৃত হয়নি। অথচ দ্বিতীয় ভাষা শেখার ব্যাপারটি মোটেও প্রথম ভাষা শেখার মতো নয়। ফলে বিদ্যমান প্রক্রিয়ায় ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর শিশুর পক্ষে বাংলা শেখাও কঠিন। আর বাংলায় দুর্বলতা থাকার কারণে শিক্ষার পরবর্তী ধাপগুলোয় এবং উচ্চতর শিক্ষায় সে মারাত্মকভাবে পিছিয়ে পড়তে থাকে।

বাংলাদেশে রেংমিতচা, কোডা, কন্দ, লুসাই, খাড়িয়া, সৌরা, পাত্র, পাংখোয়া, চাক, খুমি, খিয়াং, মালতো, কোলসহ ১৪টির বেশি ভাষা বিপন্ন। এসব ভাষার একেকটিতে ৪০-৫০ জন থেকে শুরু করে বড়জোর ২ থেকে ৩ হাজার মানুষ কথা বলে।

বিপন্নপ্রায় ভাষাকে রক্ষা করার সবচেয়ে ভালো উপায় হতে পারে শিক্ষার্থীর জন্য সেই ভাষায় পাঠ্যবই তৈরি করে দেওয়া। এতে মাতৃভাষায় শিশুর পাঠ গ্রহণের অধিকারেরও স্বীকৃতি দেওয়া হয়।

শিক্ষক-সংকটের কারণে যদি ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর ভাষায় পাঠদানের উদ্যোগ থেমে যায়, তবে সেটা হবে দুঃখজনক। এই কাজের জন্য জরুরি ভিত্তিতে একদল শিক্ষককে প্রশিক্ষণ দিয়ে তৈরি করা দরকার, যাঁরা স্কুলে স্কুলে গিয়ে পালাক্রমে পাঠদান করবেন।

তা ছাড়া একই শ্রেণিতে দুই বা তার বেশি ভাষার শিক্ষার্থী থাকতে পারে। সে ক্ষেত্রেও পাঠদানের কৌশল নির্ধারণ করা প্রয়োজন। মোটামুটি ১০ থেকে ১৫ বছর কার্যক্রমটি যথাযথভাবে পরিচালনা করা সম্ভব হলে ভবিষ্যতে ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর ভাষায় পাঠদানের ক্ষেত্রে শিক্ষকের অভাব হওয়ার কথা নয়। 

তারিক মনজুর, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক