মতামত

ইসরায়েল কি সত্যিই গাজায় স্থলযুদ্ধের জন্য তৈরি

ইসরায়েলের বিমান হামলায় ধ্বংসস্তূপে পরিণত হওয়া ফিলিস্তিনের গাজা
ইসরায়েলের বিমান হামলায় ধ্বংসস্তূপে পরিণত হওয়া ফিলিস্তিনের গাজা

ইসরায়েল তাদের পরবর্তী সামরিক অভিযানের প্রস্তুতি নিচ্ছে। দেশটির প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু বলেছেন, স্থল অভিযানে তাঁরা হামাসকে গুঁড়িয়ে ও ধ্বংস করে দিতে চান। ইসরায়েল এরই মধ্যে এই ইঙ্গিত দিয়েছে যে হামাস যদি তাদের কাছে জিম্মি থাকা ইসরায়েলিদের মুক্ত করে দেয়, তারপরও তারা স্থল অভিযান শুরু করবে।

গাজা উপত্যকায় একটা স্থল অভিযান বিপজ্জনক, মারাত্মক এবং দুই পক্ষের জন্য খরুচে হবে। ইসরায়েলের পক্ষ থেকে সর্বশেষ উল্লেখ করার মতো স্থল অভিযান পরিচালিত হয়েছে ২০০৮ সালের ডিসেম্বর ও ২০০৯ সালের জানুয়ারি মাসের মধ্যে। তিন সপ্তাহের সেই অভিযানের নাম দেওয়া হয়েছিল ‘অপারেশন কাস্ট লিড’।

ইসরায়েলের সামরিক বাহিনী বলেছিল, হামাসের অবকাঠামো (যেখান থেকে তারা রকেট হামলা চালায়) লক্ষ্য করে তারা এই অভিযান চালিয়েছিল। সেই অভিযানে ইসরায়েলি বাহিনীর পক্ষে কয়েক হাজার সেনা অংশ নিয়েছিলেন। অভিযানে ইসরায়েলের ১৩ জন সেনা, ৬০০–৭০০ হামাস সদস্য ও গাজার ১ হাজার ৪০০ বেসামরিক নাগরিক নিহত হয়েছিলেন।

সেই সংঘাতের পর থেকে ৭ অক্টোবরের হামলা পর্যন্ত গাজায় ইসরায়েলি বাহিনীর অভিযানের বেশির ভাগই ছিল হামাসের অবকাঠামো লক্ষ্য করে চালানো বিমান হামলা। কিন্তু ৭ অক্টোবরের হামলার পর ইসরায়েলি বাহিনী বিমান হামলা শুধু বাড়ায়নি, গাজা সীমান্তে সেনা, ট্যাংক ও অন্যান্য যুদ্ধ সরঞ্জাম জড়ো করেছে।আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ও মনে করছে, স্থল অভিযানে দুই পক্ষের ক্ষয়ক্ষতি হবে। যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা বলেছেন, বেসামরিক লোকজনকে যদি পর্যাপ্ত সুরক্ষা দেওয়া না যায়, তাহলে ইসরায়েলের স্থল অভিযানে উল্টো ফল ফলতে পারে।

হামাসের পক্ষ থেকে তাদের প্রস্তুতির ব্যাপারে কখনোই বিস্তারিত খোলাসা করা হয় না। কিন্তু তারা বলে যে তারা প্রস্তুত আছে। যুক্তরাষ্ট্র সরকারের সাবেক গোয়েন্দা ও সন্ত্রাসবাদবিরোধী কর্মকর্তা এবং বর্তমানে এসব বিষয়ে ও জাতীয় নিরাপত্তা নিয়ে পড়ানোর অভিজ্ঞতা থেকে আমি মনে করি, গাজায় একবার যদি স্থল লড়াই শুরু হয়, তাহলে সেটা তীব্র আকার ধারণ করবে।

এই সংঘাত ইরাকসহ মধ্যপ্রাচ্যের অনেক জায়গায় ২০ বছর ধরে যে সংঘাত চলছে, সেই পরিস্থিতির সৃষ্টি করতে পারে। ঘনবসতিপূর্ণ শহরাঞ্চলে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া সমর পরিকল্পক ও সৈন্যদের জন্য নানা কারণেই বেশ জটিল। এ ধরনের শহরে ভৌত অবকাঠামো থাকে খুবই ঘন। মাটির ওপরে কিংবা ভূগর্ভস্থ নেটওয়ার্ক যথেষ্ট থাকে যে আক্রমণকারীরা অনায়াসে আক্রমণ করে নিজেদের কোনো ক্ষয়ক্ষতি ছাড়াই পিছু হটতে পারে।

রাস্তাঘাট, গলিপথ এতটাই সংকীর্ণ থাকে যে সেনাবাহিনীর কোনো ইউনিটের পক্ষে সেখান দিয়ে চলাচল করা খুব কঠিন। চারপাশ ঘিরে অসংখ্য বেসামরিক মানুষেরা থাকেন। এসব বাস্তবতাও বিশ্বের সবচেয়ে সেরা প্রশিক্ষিত বাহিনীকেও ঝুঁকির মধ্যে ফেলে। ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষ বলছে, ৭ অক্টোবরের হামলার পর তাদের হাতে হামাসের প্রায় ১ হাজার ৫০০ যোদ্ধা নিহত হলেও গাজায় সংগঠনটির কয়েক হাজার যোদ্ধা রয়েছেন। তাঁদের কাছে আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রও রয়েছে। ইসরায়েলি হামলার মুখে হামাস যোদ্ধাদের এখন গাজা ছেড়ে অন্য কোথাও যাওয়ার সুযোগ নেই। ইসরায়েলের সঙ্গে থাকা গাজার সীমান্ত পুরোপুরি বন্ধ রয়েছে। কেবলমাত্র গাজায় মানবিক সহায়তা পৌঁছানোর জন্য মিসরের রাফা সীমান্ত কিছু সময়ের জন্য খুলে দেওয়া হচ্ছে। সম্প্রতি, জাতিসংঘ বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির প্রধান সিন্ডি ম্যাককেইন সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন, গাজা ঘিরে ইসরায়েল যে অবরোধ সৃষ্টি করেছে, তাতে উপত্যকার বাসিন্দাদের গভীর মানবিক সংকটের মুখে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে। মানবিক ও পররাষ্ট্র নীতি—দুই বিবেচনাতেই মিসর গাজার বাসিন্দাদের তাদের দেশে নিতে আগ্রহী নয়।

অন্য কোথাও যাওয়ার সুযোগ না থাকায় অনেক বেশি সম্ভাবনা রয়েছে ইসরায়েলি বাহিনীর আগ্রাসনের বিরুদ্ধে হামাস লড়াই চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেবে। সে ক্ষেত্রে হামাস আত্মঘাতী হামলা এবং তাদের কাছে যে ধরনের অস্ত্র আছে, তাই দিয়ে হামলা চালাতে পারে। এ ছাড়া হামাস গাজার ভূগর্ভে ৩০০ মাইল বিস্তৃত যে টানেল নির্মাণ করেছে, সে পথে তাদের যোদ্ধারা অনায়াসেই লুকিয়ে থাকতে পারবেন এবং এক স্থান থেকে অন্য স্থানে আসা–যাওয়া করতে পারবেন। গাজায় ইসরায়েলি বাহিনীর চালানো বিমান হামলাও হামাসকে বাড়তি সুবিধা দেবে। কেননা, বিমান হামলায় অনেক ভবন ধ্বংস হয়েছে, সেসব ধ্বংসস্তূপ এখনো সরানো যায়নি। এতে করে ইসরায়েলি বাহিনীর পক্ষে চলাচল করা কঠিন হয়ে যাবে।

হামাসের কাছে বেশ কয়েক ডজন জিম্মি রয়েছেন। তাঁদের অবস্থান এখন পর্যন্ত অজানা। জিম্মিদের কারণে ইসরায়েলকে আরও রাজনৈতিক ও মানবিক ঝুঁকির মুখে পড়তে হবে। জিম্মি কয়েকজনকে যদি স্থল অভিযানের আগে ছেড়ে দেওয়াও হয়, তারপরও স্থল অভিযান চলাকালে ইসরায়েলি সেনাদের হাতে তাদের কেউ কেউ আহত বা নিহত হতে পারেন। একটা ছোট এলাকার মধ্যে যখন তীব্র লড়াই চলে, তখন উদ্ধার অভিযানের জন্য সুনির্দিষ্ট গোয়েন্দা তথ্যের পাশাপাশি খুব সূক্ষ্ম সামরিক পরিকল্পনা প্রয়োজন।

কিন্তু ইসরায়েলি বাহিনীর এ ধরনের অভিজ্ঞতা খুব বেশি নেই। কিন্তু অন্য অনেক দেশের সেই অভিজ্ঞতা আছে। ২০০৪ ও ২০০৫ সালে যুক্তরাষ্ট্রের মেরিন সেনাদের সঙ্গে অন্যান্য দেশের সেনাদের আন্তর্জাতিক জোট ইরাকের ফালুজাতে ইরাকি বিদ্রোহী ও আল–কায়েদার সঙ্গে লড়াই করেছিল। এই লড়াইয়ে বিপক্ষ শক্তির বড় ক্ষয়ক্ষতি হলেও যুক্তরাষ্ট্র ও তার জোট বাহিনীরও ক্ষয়ক্ষতি কম হয়নি।

২০০৪ সালের শুরুর দিকে প্রথম ফালুজা যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের ৩৮ জন সেনা নিহত হন, আহত হন ৯০ জন। সেই যুদ্ধে ২০০ আল–কায়েদা অথবা ইরাকি বিদ্রোহী নিহত হন। বেসামরিক নাগরিক হতাহতের সংখ্যা ছিল অজ্ঞাত। ২০০৪ সালের পরের দিকে দ্বিতীয় ফালুজা যুদ্ধে ৩৮ জন মার্কিন সেনা নিহত ও ২৭৫ জন আহত হন। এ যুদ্ধে ১ হাজার থেকে ১ হাজার ৫০০ বিদ্রোহী নিহত হন, আহতের সংখ্যাও ছিল প্রায় সমানসংখ্যক। ইরাক যুদ্ধে এ দুই যুদ্ধই ছিল শহরাঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন বাহিনীর সবচেয়ে বড় দুটি যুদ্ধ। এ ছাড়া এ দুই যুদ্ধে একসময়কার আড়াই লাখ জনসংখ্যার ফালুজা শহরের বেশির ভাগ অংশই ধুলার সঙ্গে মিশে যায়। শহরটি বসবাস উপযোগী করার জন্য বিশাল আকারের পুনর্গঠন কাজ করতে হয়েছিল।

  • জাভেদ আলী ইউনিভার্সিটি অব মিশিগানের জননীতি অনুশীলন বিষয়ে সহযোগী অধ্যাপক

এশিয়া টাইমস থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষিপ্তাকারে অনূদিত